:: ড. আবদুল লতিফ মাসুম ::
সন্ত্রাস প্রতিশব্দ হিসেবে নতুন কিন্তু প্রকৃতি হিসেবে মানুষের ইতিহাসের মতোই পুরনো। ষাটের দশকের দিকে ফিলিস্তিনি বীর কন্যা লায়লা খালেদ বিমান হাইজ্যাক করে পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের প্রতি। সে সময়ে কালো আফ্রিকার গহীন গভীরে অথবা স্বর্ণ উপকূলে মুক্তি সংগ্রাম চলছিল। তখনও উত্তপ্ত ছিল মিন্দানাও, পাত্তানি এবং কাশ্মির। ভিয়েতনামে চলছিল মুক্তিযুদ্ধ। এসব যুদ্ধবিগ্রহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে ‘দুষ্কৃতকর্ম’ বলে পদবাচ্য হলেও পৃথিবীর তাবত্ মানুষের কাছে মুক্তিসংগ্রাম বলেই বিবেচিত ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তীকালেও এসব স্বাধীনতাকামী প্রয়াস নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত হয়নি। কিন্তু ৯/১১-এর ঘটনাবলী সবকিছু তছনছ করে দেয়। ‘সাত সমুদ্র তের নদী’র ওপারে এই প্রথম বারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ হত্যা, ধ্বংস ও বিভীষিকা অবলোকন করে। পৃথিবীর এই গোলার্ধ যুদ্ধ ও ধ্বংসের লীলায় বিধ্বস্ত হলেও প্রশান্ত আর অতলান্তিকের নিযুত জলরাশি রক্ষা করেছে পশ্চিম গোলার্ধকে। তাই ৯/১১ ভীরু আমেরিকানদেরকে আরো ভীতু করে তোলে। সামরিক শৌর্য ও বীর্যের প্রতীক পেন্টাগন আক্রান্ত হয়। প্রচণ্ড আঘাত লাগে মার্কিন অহমে। গর্জে ওঠেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ। তিনি ‘ওয়্যার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্তকাল অব্যাহত যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নিজের অজান্তেই উচ্চারণ করেন ‘ক্রুসেড’ শব্দটি। ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেন মার্কিন সমরবিদরা। অঙ্গুলি উত্তোলিত হয় ‘প্রধান সন্দেহভাজন’ ওসামা বিন লাদেনের দিকে। তাত্পর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো হত্যার আগেও এই বাক্যটিকে নিশ্চিত করতে পারেনি মার্কিন প্রশাসন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এস. পি. হান্টিংটন ‘সভ্যতার দ্বন্দ্বের’ যে তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করেছিলেন তা বাস্তব যুদ্ধের রূপ লাভ করে। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে আফগানিস্তানকে ‘স্বাধীন’ (!) করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র পাশ্চাত্য শক্তিকে একত্রিত করে আফগানিস্তানে হামলা চালায়। এ যুদ্ধে এক ইঞ্চি মাটিও অবশিষ্ট ছিল না যেখানে মার্কিন বোমারু বিমান বোমা বর্ষণ করেনি। সেই থেকে বিগত ১৬ বছর ধরে মার্কিন দখলদারিত্ব অব্যাহত রয়েছে আফগানিস্তানে। স্বাধীনতার স্বাদ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলেও নির্বোধ আফগানরা এখনও যুদ্ধ করছে। বিগত বছরগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের বদল হয়েছে কিন্তু আফগান নীতির বদল হয়নি। মজার ব্যাপার কয়েকবার বিজয়ের ঘোষণা দিয়েও বিজয় সুদূর পরাহত দেখছেন মার্কিন সেনাপতিরা। প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছিলেন, যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে। ক্রমশ সৈন্য সংখ্যা হ্রাস করতে করতে এক সময় সম্পূর্ণভাবে আফগানিস্তান হবে মার্কিন সেনামুক্ত। তিনি পর্দার অন্তরালে শান্তি আলোচনাও শুরু করেছিলেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। তিনি সেখানে আরো সৈন্যসামন্ত প্রেরণ করেন। অর্থ সম্পদ বরাদ্দ করেন। চির স্বাধীন আফগানদের অধীন করতে না পারার মনোবেদনা থেকে মার্কিন সামরিক ব্যর্থতার দায় চাপাতে চান অন্য কারো প্রতি।
এই সেদিন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স অতি গোপনে আফগানিস্তান সফর করেন। পরিচয় ও পতাকাবিহীন সি-১৭ পরিবহন বিমানে তিনি আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় মার্কিন বিমান ঘাঁটি বাগ্রামে অবতরণ করেন। তার আগমন ও প্রস্থানের সকল খবর গোপন রাখা হয়। আফগানিস্তান ত্যাগের এক ঘণ্টা পরে তা মানুষকে জানতে দেওয়া হয়। তিনি সেখানে চল্লিশ ফুট দীর্ঘ মার্কিন পতাকার সামনে সমবেত ৫০০ সৈনিককে আশার বাণী শোনান যে, ‘বিজয় অতি নিকটে’। তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়গান শোনান সৈনিকদের। তিনি বলেন, মার্কিন সেনাবাহিনী হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাহিনী । তিনি আশ্বস্ত করেন যে, মার্কিন বিমান হামলা ইতোমধ্যেই বাড়ানো হয়েছে। একজন পর্যবেক্ষক বলেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বড় বড় কথা বললেও তার সমর্থনে কোনো করতালি দেয়নি সমবেত সৈনিকরা। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বিজয় নিকটতর দেখলেও পৃথিবীর যুদ্ধবিশারদরা বিজয়ের কোনো সম্ভাবনা দেখেন না সেখানে। সমাজতাত্ত্বিকরা আফগান জনগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আফগানরা চির স্বাধীনমনা। সোভিয়েত পরাশক্তি প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও আট বছরেও তাদের কাবু করতে পারেনি। অবশেষে সোভিয়েতরা সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধের মধ্যেই জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে আফগান জাতি। পাকিস্তানের সরকার মার্কিনিদের গোলামির খাতায় নাম লেখালেও জনগণ ভ্রাতৃপ্রতিম আফগানদের প্রতি সহানুভূতিশীল। মার্কিন এই অভিযোগ মিথ্যা নয় যে, আফগান জঙ্গিরা সীমান্তে এপাশ ওপাশ করে প্রায়শই। মার্কিন ড্রোনগুলো অসংখ্যবার দুর্গম পার্বত্য এলাকায় সফল আক্রমণ করার পরেও যুদ্ধের কোনো শেষ দেখা যাচ্ছে না। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন বংশ-পরম্পরায় আফগানরা যুদ্ধ করবে। যতদিন মানচিত্রে পাকিস্তান আছে ততদিন আফগান জঙ্গিদের নিঃশেষ করা কঠিন হবে। কয়েক সপ্তাহ আগে আফগান জঙ্গিরা প্রতিরোধব্যুহ অতিক্রম করে দুটো বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে। সেখানে নতুন উপদ্রব ইরাক ও সিরিয়া থেকে বিতাড়িত আই এস যোদ্ধারা। আফগানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জঙ্গিদের প্রাধান্য রয়েছে। এখন যদি উত্তর-পশ্চিমাংশে আই এসদের হামলা বেড়ে যায়, তাহলে যুদ্ধ আরো তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পৃথিবীব্যাপী যে যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন তা এখন পৃথিবীকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। যখন এ যুদ্ধ শুরু হয় তখন একটি মাত্র রাষ্ট্র ছিল লক্ষ্য। এখন তা এশিয়া আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ায় বিস্তার লাভ করেছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ৯/১১ এর ঠিক পরের দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ডোনাল্ড র্যামসফিল্ড ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, বিশ্বের ৬০টি দেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব রাষ্ট্রের প্রায় সবই মুসলিম রাষ্ট্র। ঐ ঘোষণার পর সবার জানা আছে যে, মিথ্যা অজুহাতে ইরাক আক্রমণ করা হয়। সাদ্দাম হোসেনের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং ইরাকের তেল ও খনিজ সম্পদ অধিকারের জন্য সে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ পরিচালিত হয়। ইরাককে পদানত করার পর তাদের লক্ষ্য ছিল ইরান। কারণ, প্রকৃতপক্ষে গোটা ইসলামি বিশ্বে ইরানই একমাত্র শক্তি যারা আপসহীনভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াই করে যাচ্ছে। তখন নিউজ উইক এর একটি প্রতিবেদনে একজন বৃটিশ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে লেখা হয় যে, ‘এভরি ওয়ান ওয়ান্টস টু গো টু বাগদাদ। রিয়াল ম্যান ওয়ান্ট টু গো টু তেহরান।’ এ মন্তব্যের মাধ্যমে ইরানের প্রতি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায়। ওবামা প্রশাসনের আমলে একটি কষ্টকর কূটনীতি লব্ধ পারমাণবিক সমঝোতা অর্জিত হলেও এখন ট্রাম্প চুক্তিটি বাতিলের হুমকি দিচ্ছেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ট্রাম্পের গত এক বছরে বিস্তৃত হয়েছে ব্যাপক। বিস্ময়কর বিষয় ডোনাল্ড ট্রাম্প পৃথিবীব্যাপী মার্কিন আগ্রাসনের দাপট কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি ন্যাটো ত্যাগের হুমকিও দিয়েছিলেন। সেই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পরই ইরাকে আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জোরদার করেন। সিরিয়ায় তার পূর্বসূরিদের নীতি পরিত্যাগ করে কৌশলগত ভাবে ইরানবিরোধী সমীকরণে একমত হন। ট্রাম্প সমর্থিত যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়েছে ইয়েমেনে। সেখানে তারা সৌদি মিত্র বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে ইরান সমর্থিত হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত রয়েছে। সোমালিয়ায় আস সাবাহ-এর বিরুদ্ধে মার্কিনিরা যুদ্ধরত রয়েছে। আফ্রিকার মালি নাইজার এবং নাইজেরিয়ায় তারা লড়ছে বোকো হারাম-এর বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসবিরোধী এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোটি কোটি ডলার খরচ করছে। একটি হিসাবে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী এর ব্যয়ভার ৫.৬ ট্রিলিয়ন ডলার। লিবিয়া হচ্ছে আর একটি যুদ্ধ ক্ষেত্র যেখানে মার্কিন যোগসাজশে কার্যত দেশটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। ২০১৫-২০১৭ সালে প্রণীত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ৭৬টি রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সক্রিয় রয়েছে। পরিসংখ্যানবিদরা হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, ৩৯% স্থলভাগে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ব্যাপ্ত রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাঁটি এবং ড্রোন হামলার সুযোগ রয়েছে। পনেরটি দেশে মার্কিন সেনাবাহিনী যুদ্ধরত রয়েছে। ৪৪টি রাষ্ট্রে মার্কিন সেনাবাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে। আর ৫৮টি রাষ্ট্রে সন্ত্রাসবিরোধী প্রশিক্ষণে মার্কিন সেনারা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব কারণে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ক্রমশ ঐসব দেশে বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে। এমনকি জাপানের মতো বিশ্বস্ত মিত্র দেশের জনমত এখন মার্কিন সেনা অবস্থানের বিরোধী। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। বিষয়টা এরকম যে, যেখানে মার্কিন উপস্থিতি সেখানেই বিরোধী গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটছে। এখন এটি আর কোনো দেশ বা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। গোটা বিশ্বব্যাপী এর তত্পরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু কিভাবে এই কঠিন, কুটিল, জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের অবসান হতে পারে তার কোনো সুচিন্তিত পরিকল্পনা মার্কিন প্রশাসনে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহল প্রশ্ন তুলছেন, মূলত কারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মার্কিন তত্পরতা কি প্রকারান্তরে যুদ্ধকে দেশে দেশে সম্প্রসারিত করছে না? তাই সংগতভাবে মন্তব্য করা যায়, এটা কি বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাস’ নাকি ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। তবে এটাও অনস্বীকার্য যে সন্ত্রাসকেই যারা লক্ষ্য হাসিলের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাদেরকে অন্যের উপর হামলার আগে তার পরিণতির ভয়াবহতা নিয়েও ভাবতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়