Dr. Zaki Rezwana Anwar FRSA
পৃথিবীর অনেক দেশের মত বৃটেনেও ভ্যাকসিন কার্যক্রমকে বেগবান করার জন্যে বৃটিশ সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছিল। এ ধরনের মহামারী একশো বছর পরে এসেছে – পৃথিবীময় এই দুর্যোগে একটি দেশের সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা যেতেই পারে। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বরিস প্রসাশনে ধারাবাহিকভাবে একটি চিত্র বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
টীকাদান কর্মসূচিতে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছিল; গত অক্টোবরে তেল সঙ্কটে সেনাবাহিনীকে তেল সরবরাহ করতে তেলের ট্যাঙ্কার চালাতে হয়েছিল; গত মাসে ঝড়ে হাজার হাজার স্থাপনায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে সেখানেও সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো হয়েছিল; স্টকল্যান্ডে একাধিকবার বিনম্যানদের হরতালের সময় সেনাবাহিনীকে ময়লার গাড়ী চালানোর জন্যে ব্যবহার করা হয়েছিল; এরপর অমিক্রন হানা দেওয়ার পর বুষ্টার ডোজকে ত্বরান্বিত করতে সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়েছে; এ বছর বন্যা ও জলাবদ্ধতায়ও সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল; এখন আবার হাসপাতালে কর্মী সঙ্কটের কারণে রোগীদের সেবা দিতে এবং এম্বুলেন্স চালানোর জন্যেও সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা হয়েছে।
বরিস প্রসাশনের কাছে এটা যখন স্পষ্ট যে নিত্যকার সাপ্লাই চেইন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, দুর্যোগ — প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার যন্ত্রের চাকাকে চালু রাখতে স্বস্ব বিভাগের কর্মীদের বাইরে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে হচ্ছে, নইলে সরকার যন্ত্রটি স্থবির হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যায় ঠিক তখনই বরিস সরকার চাইছে বৃটিশ সেনাবাহিনীতে যতটা সম্ভব কাটছাঁট করে সংখ্যার দিক থেকে একে একেবারে নেপোলিয়নিক যুদ্ধের পর থেকে সব চাইতে ক্ষুদ্র একটি বাহিনীতে পরিণত করতে এবং যে বাহিনী হবে আধুনিক, চৌকস, বৈজ্ঞানিক ও তৎপর।
এটা ঠিক যে সাত আট যুগ আগে যেভাবে যুদ্ধ হতো আধুনিক যুগে সেভাবে যুদ্ধ হয়না। সামরিক আক্রমণের ধরন অনেকটা বদলে গেছে। এখন আমাদের সাইবার সমরবিদ্যা প্রয়োজন যার জন্যে প্রয়োজন বিশেষ প্রশিক্ষণের, গতানুগতিক সেনা প্রশিক্ষণে তা অন্তর্ভুক্ত ছিল না বা যার প্রয়োজনও ছিল না। নাগোর্নো কারাবাকের সংঘর্ষে ড্রোনের ব্যবহার আমাদের জানান দিয়ে গেছে যে অত্যাধুনিক সামরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। তবে এটাও ঠিক যে গত দু’তিন দশকে মধ্য-এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ঘটে যাওয়া যুদ্ধগুলো থেকে আমরা বেশ বুঝতে পারি যে আধুনিক যুদ্ধ কৌশল গতানুগতিক সমর বিদ্যাকে এখনো একবারে বাতিল করে দিতে পারেনি। যদি শুধু বোতাম টিপে দিয়েই প্রতিপক্ষকে যুদ্ধে পরাস্ত করা যেত তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তানের দখল তালিবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসতে হতো না।
রাশিয়া যখন এক পা দিয়ে রেখেছে ইউক্রেনের দিকে যে কোনো সময়ে দখলের অভিপ্রায়ে তখন ইউরোপ যে একটি থমথমে যুদ্ধ ভীতির মধ্যে আছে তা তো কোনো রাজনীতিকের জন্যে অজানা একটি বিষয় নয়। এমন অবস্থায় মাঝারি বা মোটামুটি বড় একটি সেনা বহরও বৃটেনকে হাতে গোণার জন্যে একটি ফ্যাক্টর। সম্প্রতি বৃটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী লিজ ট্রাস এসটোনিয়া সফর ক’রে এসে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতি ও তৎপরতার প্রশংসা করেছেন, অথচ অবিশ্বাস্য হলেও এটাই বাস্তবতা যে সেখানে বৃটেন প্রথম দিকে মাত্র দশজন সেনা পাঠিয়েছিল। পরে অবশ্য শতাধিক সেনা পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়টিতে ব্লেয়ার প্রশাসন ও বরিস প্রশাসনের মধ্যে একটি মিল রয়েছে। পাঠকদের মনে থাকার কথা – টনি ব্লেয়ার যখন ইরাকের বসরায় বৃটিশ সেনা পাঠিয়েছিল তখন সেই সেনা বহর এতটাই ক্ষুদ্র ছিল যে বসরা নগরীতে শান্তি নিরাপত্তা রক্ষা করা তো দুরের কথা, বৃটিশ সেনারা বিমান বন্দরে তাঁদের ঘাঁটি সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছিল। একদিকে বরিস সরকার চীনকে ঠেকাতে দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট বাঁধার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ওদিকে বৃটেন প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী ইউরোপে বৃটিশ সেনা মোতায়েন রাখবে নাকি অভ্যন্তরিণ নিত্যকার সমস্যা সামাল দিতে সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রাখবে সেটা ভাববার বিষয়।
সরকারের প্রয়োজন কাল ক্ষেপন না ক’রে স্বাস্থ্য এবং এর মত জরুরী বিভাগের সমস্যাগুলো নিজ নিজ বিভাগের (কর্মী সঙ্কট মিটিয়ে) কর্মী দিয়ে নিজেদের সমস্যার সমাধান করা এবং সামরিক বাহিনীকে শেষ সম্বল হিসেবে ব্যবহার করা। যখন দেখা যায় স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা, জ্বালানী – এসব ক্ষেত্রে সমস্যার জন্যে বৃটিশ সরকার স্ব স্ব কর্মী দ্বারা মোকাবেলা করতে পারছেনা ; যখন দেখা যায় ইউরোপে বৃটিশ সেনা অনুপস্থিত থেকে এন এইচ এস এর কর্মী সঙ্কট সামাল দেওয়ার জন্যে বৃটিশ সেনাবাহিনী এম্বুলেন্স চালাচেছ — তখন ভ্লাদিমির পুতিন যে ক্রুর হাসি হাসছে না, তা কি ভাবা যায়?
লেখক : Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।
Advertisement