।। Dr. Zaki Rezwana Anwar।।
মাত্র দু’দিন আগেই ইংল্যান্ডে হয়ে গেল স্থানীয় নির্বাচন। ফলাফল সম্পর্কে এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় – এটি ছিল ইউকিপের রক্তক্ষয়ী মৃত্যু, লিবারেল ডেমোক্রেকটসের পুনরুজ্জীবন আর লেবার ও কনজারভেটিভ কোনো দলেরই আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা। গুটিকতক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ছাড়া চার বছর আগের ফলাফলের খুব যে পরিবর্তন হয়েছে এবার – এমনটি জোর দিয়ে বলা যায় না। বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা টাওয়ার হেমলেটসে নিরঙ্কুশ বিজয় ছাড়াও ১৯৭১ সালের পর লন্ডনে লেবার এবারই সব চাইতে ভাল করেছে। তবে ট্রাফোর্ড, প্লিমাথ ও কার্কলির বিজয় নিয়ে উল্লাস করার দাবী রাখে লেবার। ওদিকে পিটারবারা ও বেসিলডনসহ লন্ডনের ওয়ান্ডসওয়ার্থ, ওয়েস্টমিনষ্টার, কেনসিংটন, বার্নেট ও হিলিংডন – এসব অথরিটিকে কব্জায় রাখতে পেরে কনজারভেটিভ যে শুধু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে তাই নয়, এটিকে দলের সাফল্যও বলা যায়। বার্নেটে বিজয়ী না হওয়ার কারণ হিসেবে অবশ্য খোদ লেবার এমপিরাই এন্টি স্যামেটিজম ইস্যুতে জেরমি করবিনের সময়মত ও যথাযথ ভূমিকা নিতে না পারাকেই দায়ী কোরছে। যে সব জায়গায় ইউকিপের ভরাডুবি হয়েছে সেসব জায়গায় টোরীর বিপুল বিজয় লক্ষ্য করা গেছে, অবশ্য ইউকিপ নিপাত যাওয়ায় লেবারেরও আসন সংখ্যা বেড়েছে। ওদিকে গত কয়েক মাসে লিব ডেমের অভ্যন্তরে ভিন্স ক্যবলের নেতৃত্ব নিয়ে যে গুন্জন শোনা যাচ্ছিল তা এবার হয়তো স্তিমিত হয়ে আসবে লিব ডেমের রিচমন্ডে বিজয় ছাড়াও টোরীর কাছ থেকে লিব ডেমের কিংস্টন ও সাউথ ক্যামব্রিজশায়ার পুনরুদ্ধারের পর।
এখানে দু’টো প্রশ্ন সামনে এসেই যায়।
প্রথমত: এই স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফলটি কি আগামী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিস্থাপিত হতে পারে? দ্বিতীয়ত: এই স্থানীয় নির্বাচন আমাদেরকে কি ম্যাসেজ দিচ্ছে অথবা এই ফলাফল দেখে কনজারভেটিভ ও লেবারের পরবর্তী’ ‘রাজনৈতিক টেকটিক’ কি হতে পারে?
প্রথম প্রশ্নেই আসা যাক। যদি আগামীকালই সাধারণ নির্বাচন হয় তাহলে কি ঠিক একই ফলাফল দেখা যাবে? যদি ইতিহাস ঘেঁটে কথা বলি তাহলে উত্তর হবে ‘সম্ভবত না।’ ১৯৮৩ ও ১৯৮৭ সালে স্থানীয় নির্বাচনের পর পরই সাধারণ নির্বাচন ডেকেছিলেন মার্গারেট থেচার। ১৯৮৩ সালে স্থানীয় নির্বাচনে টোরী লেবার থেকে মাত্র তিন পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও সাধারণ নির্বাচনে টোরী লেবারকে গুঁড়িয়ে দেয় ষোল পয়েন্টের ব্যবধানে। একইভাবে ১৯৮৭ সালে স্থানীয় নির্বাচনে ছয় পয়েন্টে এগিয়ে থাকা টোরী সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয় এগারো পয়েন্টের ব্যবধানে। তার কারণ, মানুষ স্থানীয় ও সাধারণ নির্বাচনে একই ভাবে ভোট দেয় না। অনেকে স্থানীয় ইস্যুগুলোর উপরই ভোট দেন স্থানীয় নির্বাচনে। তাছাড়া স্থানীয় নির্বাচনের টার্ণ আউট বেশীরভাগ সময়ই সাধারণ নির্বাচনের চাইতে কম হয়। ২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ২০১৫ সাল থেকে বৃটেনে যুব সমাজের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ বেড়েছে যদিও স্থানীয় নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ এখনও কম। তরুণ সমাজ ভাল ভাবেই জানে যে স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল টেরিসা মে বা জেরেমি করবিনকে ক্ষমতায় রাখা না রাখার ব্যাপারে সরাসরি কোনো প্রভাব ফেলবে না।
এবারে দ্বিতীয় প্রশ্ন : এবারের নির্বাচনের ফলাফল আমাদের কি ম্যাসেজ দিচ্ছে? এবারের নির্বাচনের ফলাফল আমাদের স্পষ্ট জানান দিয়ে দিয়েছে যে সমসাময়িক বৃটিশ রাজনীতিতে ডান-বাম, ধনী-দরিদ্র — এসব যতটা না বিভক্তির কারণ তার চাইতে বড় হচ্ছে ‘লীভ’ ও ‘রিমেইন’ ফ্যাক্টর। একেবারে চায়ের টেবিলের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় ‘ব্রেক্সিট আমাদের কতটা ম্যাটার কোরছে!’ সাধারণভাবে বলা যায়, বড় বড় শহরে যেখানে ‘রিমেইন’ – এর পক্ষে ভোট পড়েছিল সে সব জায়গায় লেবার ভাল করেছে আর যসব জায়গা ‘লীভ’ – এর পক্ষে ছিল সেসব জায়গায় টোরী ভাল করেছে। ব্রেক্সিটের এই বিভাজন এতই গভীর এবং প্রকট যে আমরা এই নির্বাচনের ফলাফলে দেখলাম লেবার বা টোরী কোনো দলের পক্ষেই এই ব্রেক্সিট বিভাজনকে ডিঙিয়ে অপর সীমার বূহ্য ভেদ করা সম্ভব হয় নি। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে বৃটিশ রাজনীতির দাবা খেলায় এই ‘ষ্টেইলমেট’ অবস্থা আরও কিছু কাল চলবে।
তাহলে এই স্থানীয় নির্বাচনের পর লেবার ও টোরীর পরবর্তী রাজনৈতিক ‘টেকটিক’ কি হবে বা হওয়া উচিত?
টেরিসা মে’র যতটুকু জনপ্রিয়তা তা মূলত’ লীভ’ভোটারদের কারণে। এই নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করেছে, সাম্প্রতিক কালে ব্রেক্সিট দরকষাকষিতে কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ার পরও ‘লীভ’ ভোটাররা এখনও মে’ র প্রতি তাদের লয়ালটি দেখিয়েছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে এই লয়ালটির পাশাপাশি টেরিসা মে’র কাছে তাদের একটি চাওয়া নিশ্চয়ই আছে। এই বিরাট ‘লীভ’ গ্রুপটিকে হাতছাড়া কোরে মে নিশ্চয়ই অপরিণামদর্শীতার পরিচয় দেবেন না। তাই টেরিসা মে’কে ব্রেক্সিটের ব্যাপারে এখন আরো বেশী কোরে ‘লীভ’ ভোটারদের ইচ্ছার প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। যারা ‘লীভ’ ভোটার ছিলেন তারা যে ‘সফ্ট ব্রেক্সিট’ মাথায় রেখে ভোট করেছিলেন – এমনটি ভাবা ভুল। তাই টেরিসা মে এখন আরো জোর গলায় ‘হার্ড ব্রেক্সিট’ – এর গীত গাইবেন- এটাই ধরে নিতে হবে।
এবার লেবারের দিকে তাকানো যাক। গত স্ন্যাপ ইলেকশনের ফলাফলের জন্যে জেরেমি করবিনের কাছে লেবার দলের কোনোই ঋণ নেই – এমন কথা বলা যাবে না। তবে এবারের নির্বাচনের পর লেবারকে হয়তো ভেবে দেখতে হবে করবিনের লেবার দলকে যা দেওয়ার ছিল তার সবটুকুই কি দেওয়া শেষ? আর বাড়তি কোনো কিছু তিনি কি দিতে পারবেন? আগামী দু’ তিন বছরে লেবার পার্টি যাতে নেতিয়ে না পড়ে সেজন্যে লেবারকে একেবারে মাছির মত মাথার চারিদিকে চোখ রাখতে হবে। পাশাপাশি ডমেষ্টিক কিছু ইস্যু নিয়ে কার্যকরী প্রস্তাব রাখতে হবে এবং তা যে বিশ্বাসযোগ্য সে ব্যাপারে জনগণের আস্থা অর্জন করাও জরুরী।
তবে এসবের বাইরেও লেবার এবং টোরী উভয়েরই আরো একটি কষ্টসাধ্য কাজ করা প্রয়োজন। গত স্ন্যাপ ইলেকশন এবং এবারের নির্বাচনে দেখা গেছে লেবার এবং কনজারভেটিভ তাদের নিজ নিজ ‘কমফোর্ট জোন’ – এর ভেতরেই আছে। লেবারের ‘কমফোর্ট জোন’ হচ্ছে যুব সমাজ অধ্যুষিত বড় বড় মেট্রোপলিটন শহর আর টোরীর কমফোর্ট জোন হচ্ছে এর বাইরের ছোট শহরগুলো। বৃটিশ রাজনীতির বর্তমান যা অবস্থা তাতে এটি বলা যায়, যতদিন বড় দু’টি দলের অন্তত একটি দল তাদের কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে অপর পক্ষের টেরিটরিতে প্রভাব না ফেলবে ততদিন লেবার বা কনজারভেটিভ কারোরই সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে এককভাবে সরকার গঠন করা অনেকটা স্বপ্ননই থেকে যাবে, ততদিন বৃটেন ‘হাঙ’ রাজনীতির মধ্যেই ঘুরপাক খাবে – ততদিন বৃটিশ রাজনীতির পেন্ডুলাম ডানে – বামে কোনো দিকেই দোল খাবে না।
লেখক : ডক্টর জাকি রেজোয়ানা আনোয়ার, মা ও শিশু বিশেজ্ঞ। চ্যানেল এসের সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার এবং সিনিয়র কমিউনিটি এক্টিভিস্ট।