ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ৯ অক্টোবর বিশ্বখ্যাত এনজিও অক্সফাম বৈষম্য কমানোর প্রতিশ্রুতি সূচকের (commitment to reducing inequality index) বিবেচনায় ১৫৭টি দেশের র্যাঙ্কিং ঘোষণা করেছে। ওই র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ১৪৮তম অবস্থানে, যা দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে সপ্তম, মানে খুবই হতাশাজনক। সামাজিক খাতে ব্যয়, করারোপ এবং শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সরকারের প্রয়াস—এই তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে সূচকটি তৈরি করা হয়েছে। একমাত্র ভুটান বাংলাদেশের চেয়ে এই সূচকে খারাপ অবস্থানে, ১৫২ নম্বরে। ওই র্যাঙ্কিংয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি ৬টি দেশের অবস্থান: মালদ্বীপ ৬৮তম, শ্রীলঙ্কা ১০২তম, আফগানিস্তান ১২৭তম, পাকিস্তান ১৩৭তম, নেপাল ১৩৯তম ও ভারত ১৪৭তম। এর মানে, বৈষম্য নিরসনের ব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তেমন মনোযোগী নয় এবং সূচকের তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতির অভাব প্রকটভাবে ধরা পড়ে যাচ্ছে। বৈষম্য নিরসনের ব্যাপারে আমাদের শীর্ষ নেতৃত্বের এহেন অবজ্ঞার মানসিকতাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ মনে করি। ‘ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ’ অর্জনের মাধ্যমে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার কলঙ্কতিলক এখন বাংলাদেশের কপালে শোভা পাচ্ছে। আর সেটি হচ্ছে বৈষম্য নিরসনে রাষ্ট্রের নিস্পৃহতার কারণেই।
পাঠকেরা স্মরণ করুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক ২০১২ থেকে ২০১৭—এই পাঁচ বছরে অতি ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে বিশ্বে ১ নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে ৩ কোটি ডলারের (প্রায় ২৫২ কোটি টাকা) বেশি নিট সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদের ‘আলট্রা-হাই নেট-ওয়ার্থ’ ইনডিভিজ্যুয়াল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বিশ্বে মোট ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৫৫ জন ধনকুবেরের সবচেয়ে বেশি ৭৯ হাজার ৫৯৫ জন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই তালিকায় দ্বিতীয় থেকে দশম অবস্থানে জাপান, চীন, জার্মানি, কানাডা, ফ্রান্স, হংকং, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড ও ইতালি। এই ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৫৫ জন ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ, কিন্তু তাঁদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়ে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন (মানে সাড়ে ৩১ লাখ কোটি) ডলারে। গত পাঁচ বছরে ধনকুবেরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চীন ও হংকংয়ে, কিন্তু ধনকুবেরের সংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে; ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। চীনে ধনকুবেরের প্রবৃদ্ধির হার ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা ২৫৫ জন। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এ দেশে যেভাবে নিজেদের আয় এবং ধনসম্পদ লুকোনোতে বিশেষ পারদর্শিতা প্রদর্শন করে থাকেন, তাতে হয়তো দেশে ধনকুবেরের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ‘লজ্জাজনক’ অর্জন। কারণ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের জিডিপি এবং জিএনআই প্রবৃদ্ধির হার ক্রমাগতভাবে যেভাবে বেড়ে চলেছে, সে প্রবৃদ্ধি এই ধনকুবেরদের সম্পদের প্রবল স্ফীতি ঘটানোর অর্থই হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সিংহভাগ সুফল দেশের ধনাঢ্যদের কাছে গিয়ে জমা হয়ে যাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে দেশের সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে ÿক্ষমতাসীন মহলের ভ্রান্ত নীতির কারণে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০১১ সালে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মহাজোট সরকার সে রায়কে সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা সত্ত্বেও সরকার এখনো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে মেতে রয়েছে। ‘স্বজনতোষণ পুঁজিবাদ’ বা ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ আজও নীতিপ্রণেতাদের কাছে ‘হলি রিটের’ মর্যাদায় বহাল রয়ে গেছে। ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ কনসেপ্টটি অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় একটি চাঞ্চল্যকর সংযোজন। ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫ সাল থেকে দীর্ঘ ৩৩ বছর ক্ষমতাসীন থাকার পর ১৯৯৮ সালে একনায়ক সমরপ্রভু সুহার্তোর পতনের পর তাঁর শাসনামলের অভূতপূর্ব প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পরিবারতন্ত্র, আত্মীয় ও দলতোষণ এবং সামরিক বাহিনী ও সিভিল প্রশাসনকে ব্যাপক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য এই ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ কনসেপ্টটি উন্নয়ন তাত্ত্বিকেরা বিশেষভাবে ব্যবহার করেছেন। ১৯৭৫-এর সামরিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারগুলোর আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এহেন ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের নিকৃষ্ট নজির করে ফেলা হয়েছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গত ৪৩ বছরের ইতিহাসে ক্ষমতার যতই পালাবদল হোক, সমরপ্রভু কিংবা ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক দল বা জোট যতবারই ক্ষমতায় আসুক, প্রতিটি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এ দেশে দ্রুত বেড়ে চলেছে শত শত ‘রেন্ট-সিকিং’ (তোলাবাজ) কোটিপতি। বৈষম্য বৃদ্ধির ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সব সরকার উদাসীন থাকার কারণেই আয় ও সম্পদের পুঞ্জীভবন বর্তমান বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। ১৯৭২ সালে বিআইডিএসের গবেষণায় নির্ণীত হয়েছিল, বাংলাদেশের আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগ ০.৩২। ২০১৬ সালের হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার জরিপ অনুযায়ী তা ০.৪৮৩-এ পৌঁছে গেছে। জিনি সহগ বেড়ে যেসব দেশে ০.৫ পেরিয়ে যায়, ওগুলোকে উন্নয়নতত্ত্বে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ বিবেচনা করা হয়, বাংলাদেশ এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সমস্যা মোকাবিলা করা দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন। কারণ, আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টন কঠিন কাজ, রাজনৈতিক নীতি পরিবর্তন ছাড়া অর্জন করা যায় না। সমাজের শক্তিধর ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর কায়েমি স্বার্থ আয় পুনর্বণ্টন নীতিমালাকে ভন্ডুল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইসরায়েল ও শ্রীলঙ্কা নানা রকম কার্যকর আয় পুনর্বণ্টন কার্যক্রম গ্রহণ ও সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জিনি সহগ বৃদ্ধিকে শ্লথ করতে বা থামিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, যদিও সাম্প্রতিক বিশ্বে জিনি সহগ কমানোর ব্যাপারে কিউবা ছাড়া অন্য কোনো উন্নয়নশীল দেশকে তেমন সাফল্য অর্জন করতে দেখা যাচ্ছে না। এই দেশগুলোর মধ্যে কিউবা, চীন ও ভিয়েতনাম এখনো নিজেদের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করে, বাকি দেশগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনুসারী হয়েও শক্তিশালী বৈষম্য-নিরসন নীতিমালা গ্রহণ করে চলেছে।
ওপরের বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে সফল ভূমি সংস্কার এবং/অথবা কৃষি সংস্কার নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়েছে। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির মতো ইউরোপের কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় নীতি অনেক বেশি আয় পুনর্বণ্টনমূলক, যেখানে অত্যন্ত প্রগতিশীল আয়কর এবং সম্পদ করের মতো প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে জিডিপির ৩০-৩৫ শতাংশ সরকারি রাজস্ব হিসেবে সংগ্রহ করে ওই রাজস্ব শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা (প্রধানত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পেনশন, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন), পরিবেশ উন্নয়ন, নিম্নবিত্ত পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা, গণপরিবহন, বেকার ভাতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয়। এই রাষ্ট্রগুলোর প্রতিরক্ষা বাহিনী, সিভিল আমলাতন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জন্য সরকারি ব্যয় জিডিপির শতাংশ হিসাবে খুবই কম। এই কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোতে এবং বৈষম্য-সচেতন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে কয়েকটি বিষয়ে মিল দেখা যাচ্ছে সেগুলো হলো:
১. রাষ্ট্রগুলোতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ের শিক্ষায় একক মানসম্পন্ন, সর্বজনীন, আধুনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার ব্যাপারে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে।
২. রাষ্ট্রগুলোতে অত্যন্ত সফলভাবে জনগণের সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু রয়েছে।
৩. রাষ্ট্রগুলোতে প্রবীণদের পেনশনব্যবস্থা চালু রয়েছে।
৪. রাষ্ট্রগুলোতে সর্বজনীন বেকার ভাতা চালু রয়েছে।
৫. এসব দেশে নিম্নবিত্ত জনগণের জন্য ভর্তুকি মূল্যে রেশন বা বিনা মূল্যে খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে।
৬. প্রবীণ জনগণের আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা উন্নত-উন্নয়নশীলনির্বিশেষে এসব দেশে চালু রয়েছে।
৭. এসব দেশে গণপরিবহন সুলভ ও ব্যয়সাশ্রয়ী এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয় ।
৮. এসব দেশে রাষ্ট্র ‘জিরো টলারেন্স অগ্রাধিকার’ দিয়ে দুর্নীতি দমনে কঠোর শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা চালু করেছে।
৯. এসব দেশ ‘মেগা সিটি’ উন্নয়নকে সফলভাবে নিরুৎসাহিত করে চলেছে এবং গ্রাম-শহরের বৈষম্য নিরসন ও আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসনে খুবই মনোযোগী।
১০. দেশগুলোতে ‘ন্যূনতম মজুরির হার’ নির্ধারণ করে কঠোরভাবে প্রতিপালনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
১১. নিম্নবিত্তদের আবাসনকে সব দেশেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
১২. এসব দেশে কৃষকেরা যাতে তাঁদের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্য দাম পান, তার জন্য কার্যকর সরকারি নীতি বাস্তবায়িত হয়েছে।
১৩. ব্যক্তি খাতের বিক্রেতারা যেন জনগণকে মুনাফাবাজির শিকার করতে না পারে, সে জন্য এসব দেশে রাষ্ট্র কঠোর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে।
আমাদের রাষ্ট্রকে জনগণের মালিকানাধীন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র’ করা গেলে ওপরে উল্লিখিত উন্নয়ন-কৌশলগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রহণ করা সম্ভব হবে।