ব্যবসায়ীদের হাতেই এখন নাটাই

ড. বদিউল আলম মজুমদার : গত ৬ অক্টোবর ২০১৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদ বলেছিলেন, ‘আমাদের গ্রামে প্রবাদ আছে গরিবের বউ নাকি সবারই ভাউজ (ভাবি)। রাজনীতিও হয়ে গেছে গরিবের বউয়ের মতো। যে কেউ যে কোনো সময় ঢুকে পড়তে পারেন, বাধা নেই।’ আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে তাকালে এ কথা অস্বীকার করার অবকাশ নেই, কারণ আমাদের রাজনীতি আজ বহুলাংশে অরাজনীতিবিদদের করায়ত্তে। আরও ভেঙে বললে, আমাদের রাজনীতির নাটাই আজ বলতে গেলে ব্যবসায়ীদের হাতে।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে বেড়েছে এবং এখন তা মূলত তাদের দখলে চলে গেছে। আমাদের সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব ১৯৫৪ সালে মাত্র ৪ শতাংশ হলেও ১৯৭৩ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশ, ১৯৭৯ সালে ৩৪ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৪৮ শতাংশ, ২০০১ সালে ৫১ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে ৬৩ শতাংশ। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা দেখেছি, ৫৪৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশির পেশা ছিল (৫২.৩% বা ২৮৪ জন) ব্যবসা। আর নির্বাচিত ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে অধিকাংশই (১৭৫ জন বা ৫০%) ব্যবসায়ী। আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে এ অনুপাত আরও বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সিলেটের ছয়টি সংসদীয় আসনে ৬৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন, যার মধ্যে ৩৩ জনই ব্যবসায়ী (প্রথম আলো, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮)। একইভাবে খুলনার ছয়টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ৫১ জনের মধ্যে ৩১ জনই ব্যবসায়ী (মানবজমিন, ৭ ডিসেম্বর ২০১৮)। উল্লেখ্য, পেশায় ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও অনেকে তাদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায় ব্যবসার পরিবর্তে অন্য কিছুকে পেশা হিসেবে ঘোষণা দেন। এ ছাড়াও কেউ কেউ সংসদ সদস্য হওয়ার পর ব্যবসায়ী হয়ে যান। আমাদের জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের আধিক্যের কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিইয়ের বর্ধিত অংশ বলে অনেকে আখ্যায়িত করেন।

রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রবেশ কেন এমন ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি? এর অন্যতম কারণ হলো, আমাদের দেশে রাজনীতিই ক্রমাগতভাবে ব্যবসায়ে পরিণত হয়ে গিয়েছে এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে পড়েছে বহুলাংশে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটে। সংসদ সদস্য হতে আগ্রহী ব্যক্তিরা কোটি কোটি টাকা ‘বিনিয়োগ’ করেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর তার বহুগুণ কামাই করেন তাদের পদ-পদবিকে কাজে লাগিয়ে। আমাদের বর্তমান ও নিকট অতীতের সংসদ সদস্যদের অনেককেই মাত্র পাঁচ বছরের মেয়াদকালেই বিরাট অর্থবিত্তের মালিক হতে দেখা গিয়েছে। অনেকেই এসব অর্থবিত্ত কামাই করেন চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও নিয়োগবাণিজ্য ইত্যাদির মাধ্যমে। আর এসবের সুযোগ আছে বলেই এখন ‘যে যা বলিস ভাই, আমার এমপি হওয়া চাই’- এমন মানসিকতা আজ আমাদের দেশে সর্বব্যাপী।

রাজনীতি আর এখন জনসেবা নয়- এটি এখন অনেকটাই ব্যক্তি-গোষ্ঠী-কোটারি সেবার উত্তম উপায়। অতীতের ত্যাগী নেতাদের অনেকেই এখন রাজনীতি থেকে হয় বিতাড়িত হয়েছেন, না হয় নিজেরাও রাজনৈতিক ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছেন। ‘গ্রেসামস ল’ আমাদের রাজনীতিতেও কাজ করছে- খারাপ রাজনীতিবিদরা ভালো রাজনীতিবিদদের ক্রমাগতভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিতাড়িত করছেন। এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতি হয়ে পড়েছে বহুলাংশে নীতি-আদর্শ বিবর্জিত একটি স্বার্থান্বেষী কার্যক্রম। বস্তুত আমাদের দেশে আদর্শিক রাজনীতির মৃত্যু ঘটেছে। তাই তো রাজনীতিতে যুক্ত হতে ব্যবসায়ীরা, বিশেষত কালো টাকার মালিক ব্যবসায়ীরা উন্মুখ হয়ে থাকেন, কারণ রাজনৈতিক মুখোশ পরলে অতি সহজেই কালো টাকা সাদা করা যায়।

রাজনীতি ক্রমাগতভাবে ব্যবসায়ে পরিণত হওয়ার এবং রাজনীতিতে অধিক হারে ব্যবসায়ীদের প্রবেশের কারণে আমাদের দেশে শুধু রাজনীতির ব্যবসায়ীকরণই হয়নি, ব্যবসায়েরও রাজনীতিকরণ হয়েছে। এর ফলে রাজনীতি এবং ব্যবসা কোনোটাই সঠিকভাবে চলছে না। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমাগতভাবে কলুষিত হয়েছে। একইভাবে আমাদের মহান জাতীয় সংসদ হয়ে পড়েছে বহুলাংশে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। আমাদের নীতি নির্ধারণও হয়ে পড়েছে ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত, যার মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের এবং অন্যান্য অনেক শ্রেণির স্বার্থহানি হয়।

রাজনীতিতে নগ্ন টাকার খেলা আমাদের কলুষিত রাজনীতিরই ফসল। বর্তমানে মনোনয়নবাণিজ্য আমাদের দেশে একটি বিরাট সমস্যা। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও এখন মনোনয়নবাণিজ্য অনুপ্রবেশ করেছে। এ ছাড়াও টাকা দিয়ে ভোট কেনাবেচা হয়। টাকা দিয়ে নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবিত করতে পারে এমন ব্যক্তিদের সহায়তা কেনা হয়। এ ছাড়াও টাকা দিয়ে কর্মী পালা হয়। মাস্তান কেনা যায়। টাকার খেলা সহিংসতারও জন্ম দেয়, যা তরুণ ও নারীদের রাজনীতি বিমুখ করে। আর আমাদের আজ হয়ে পড়েছে ‘বেস্ট ডেমোক্রেসি মানি ক্যান বাই’- টাকা দিয়ে কেনা যায় এমন উন্নত গণতন্ত্র, যা কোনো গণতন্ত্রই নয়।

রাজনীতিতে নগ্ন টাকার খেলার ফলে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার থাকলেও তারা প্রতিনিধিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ আমাদের সাধারণ নাগরিকরা জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচনে ভোট দিতে পারলেও তাদের পক্ষে এখন সংসদ সদস্য হওয়ার পথ পরিপূর্ণভাবে রুদ্ধ। ফলে এখন গণতন্ত্রের সেই কালজয়ী সংজ্ঞা ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল এবং ফর দ্য পিপলে’র- জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য সরকারের ধারণা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে। ‘সিটিজেন লেজিসলেটরে’র – নাগরিক প্রতিনিধির কথা আর আমরা কল্পনাও করতে পারি না।

আমরা ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে প্রবেশের বিপক্ষে নই। ব্যবসায়ীদেরও রাজনীতিতে প্রবেশের অধিকার আছে। তাদেরও সংসদ সদস্য হওয়ার অধিকার আছে। তবে সেই অধিকার প্রয়োগ হতে হবে ব্যবসায়িক স্বার্থ সিদ্ধির পরিবর্তে জনকল্যাণের লক্ষ্যে। আর জাতীয় সংসদ হতে হবে সমাজের সকল ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্বের সমন্বয়ে- শুধু ব্যবসায়ীদের নিয়ে নয়- যাতে রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে সব নাগরিকের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।

আমরা রাজনীতিতে নতুনদের প্রবেশেরও বিপক্ষে নই। আমাদের রাজনীতি এখন বহুলাংশে মেধাশূন্য হয়ে গিয়েছে এবং ছকবাঁধা চিন্তায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আর এ মেধাশূন্যতা দূর করতে হলে এবং রাজনীতিতে সৃজনশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটাতে হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত করতে হবে। রাজনীতিকে পরিবারতন্ত্রের বলয় থেকে বের করতে হবে। রাজনীতির শিরা-উপশিরায় নতুন রক্ত সঞ্চালন করতে হবে। নতুনদের প্রবেশাধিকার প্রদানের মাধ্যমেই তা নিশ্চিত করা যাবে। চার্লস দ্যগলের ভাষা ধার করে বলতে গেলে, ‘পলিটিক্স ইজ টু ইমপরট্যান্টে বি লেফ্‌ট টু দ্য পলিটিশিয়ান এলোন’- রাজনীতি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, তা শুধু রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না।

Advertisement