ব্রিট বাংলা ডেস্ক : শুক্রবার বিকেল চারটা। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী কর্ণফুলি এক্সপ্রেস ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে ঢোকার পথে টিএ রোডের গেইট অতিক্রম করার সময় হঠাৎ হৈ-হুল্লোড়। রেলগেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বুট, বাদাম বিক্রেতাসহ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা নিলেন। যানবাহন দাঁড় করালেন তাঁরা। এখানেই শেষ নয়। ট্রেনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রাবিরতি না দিয়েই পরবর্তী স্টেশনের উদ্দেশ্যে চলে যায়। যে কারণে একজনকে আক্ষেপ করে বলতে শোনা গেল, ‘এমন ট্রেনও (মেইল) আজ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জন্য আন্ত:নগর হয়ে গেল।’
তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইনটি এখন কাজে আসছে না বলে গত এক সপ্তাহ ধরেই এভাবে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন গেইটটি পার হয়। ট্রেন থামে না বলে হাজার হাজার যাত্রীর দুর্ভোগেরও যেন শেষ নেই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে।
সব মিলিয়ে তাণ্ডবের ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জনভোগান্তি এখন চরমে। সেবা বন্ধ রয়েছে জেলা পরিষদ, ভূমি অফিস, পৌরসভাসহ বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ব্যক্তিভাবে ক্ষতিগ্রস্থদের এখন মাথায় হাত। স্থবিরতা নেমে এসেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সঙ্গীতাঙ্গনেও।
এদিকে বৃহস্পতিবার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের নেতৃবৃন্দ। এ সময় তাঁরা সাংবাদিকদের উপর আঘাতকে গণতন্ত্রের উপর আঘাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব ঠেকাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগও ব্যর্থ ছিল বলে বৃহস্পতিবার সাংবাদিক সম্মেলন করে মন্তব্য করেছেন দলটির কার্যকরী কমিটির ‘বহিস্কৃত সদস্য’ মাহমুদুল হক ভূইয়া।
নি:স্ব মতিন
দিনের বেশিরভাগ সময় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর ও সুর সম্রাট ওস্তাদ দি আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তনে সময় কাটে মতিন মিয়ার। এখানে এসে শুধু চোখের পানি ফেলে সমাধানের পথ জানতে চান এর কাছে ওর কাছে। বলতে গেল মতিন মিয়া এখন পাগলপ্রায়।
২৮ মার্চের হরতালে কপাল পুড়ে ‘মতিন সাউন্ড সিস্টেম’ এর সত্ত্বাধিকারি আব্দুল মতিন মিয়ার। সেদিনের তাণ্ডবে ওই দুইস্থানে থাকা তাঁর অন্তত ১৮ লাখ টাকার মালামাল পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। এর মধ্যে ছিলো ছয়টি সাউন্ডবক্স, সাউন্ড বক্সের তিনটি মেশিন, একটি মিকচার মেশিন, ১৬টি ভয়েজ প্রসেসর (মাইক্রোফোন), ১৪টি মাইক্রোফোন স্ট্যান্ড, একটি জেনারেটর। জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানের জন্য এগুলো ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি।
মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী ও তিন মেয়েসহ নয় জনের সংসার চলতো মতিনের আয়ে। এখন তিনি পরিবার চালানো নিয়ে শঙ্কায় আছেন। পোড়াস্থানে স্বপ্নের মালামালগুলো খুঁজে বেড়ান। এসব স্থান পরিদর্শনে যারাই আসছেন তাঁদের কাছে মালামালের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়ে আশ্বাস চান।
পুড়ে যাওয়া স্থানে কথা হয় মতিন মিয়ার সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘রোজগারের মাধ্যমগুলো পুড়িয়ে দেওয়ায় আমি এখন নি:স্ব। আমার সংসারে এখন খাবার নেই। বন্ধুদের থেকে চেয়ে-চিন্তে সংসার চালাচ্ছি। এমন ভাবে চলতে থাকলে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না।’
প্রেস ক্লাব নেতৃবৃন্দের পরিদর্শন
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াছমিন বলেছেন, ‘সাংবাদিক সমাজের মধ্যে বিভক্তি আছে বলেই দুস্কৃতিকারী-মৌলবাদীরা হামলার সাহস পায়। নাহলে সাংবাদিকরা কেন টার্গেট হবে? কেন সাংবাদিকদের গাড়ি পোড়াবে? আগে তো কখনো এমন ঘটেনি। পেশার কাজে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
শুক্রবার দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় ফরিদা ইয়াছমিন এসব কথা বলেন। ফরিদা ইয়াছমিনের নেতৃত্বে জাতীয় প্রেস ক্লাবের একটি প্রতিনিধি দল হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব পরিদর্শনে আসেন। এ সময় প্রেস ক্লাবে হামলার বিষয়টি জাতীয় প্রেস ক্লাব নেতৃবৃন্দের কাছে বর্ণনা করেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রহিম বিজন। এছাড়াও হেফাজত কর্মী-সমর্থকদের হামলার শিকার প্রেস ক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি তাঁর ওপর হামলার বিবরণ দেন।
ফরীদা ইয়াছমিন বলেন, ‘যে কোনো প্রান্তে সাংবাদিকদের ওপর আঘাত মানে, প্রত্যেকের মনে করতে হবে এটা আমার নিজের ওপর আঘাত। কারণ এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পেশাগত কাজের ক্ষেত্রে আমরা এক হয়ে দায়িত্ব পালন করব। কারণ ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবসহ দেশের সকল সাংবাদিক সমাজের পাশে আমরা আছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘সংস্কৃতির রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষকে অনেক বেশি প্রগতিশীল মনে করা হয়। সাংবাদিকরা সবসময় প্রগতি, গণতন্ত্র এবং মানুষের কথা বলে। সাংবাদিকরা অন্য আর দশটা মানুষের মতো দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে আঘাতকে আমরা আমাদের ওপর আঘাত মনে করেই ছুটে এসেছি। বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে যদি সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়, আমরা মনে করি এটা আমাদের ওপর হামলা।’
হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ ছিল আওয়ামী লীগ
হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব ঠেকাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগও ব্যর্থ ছিল বলে মন্তব্য করেছেন দলটির কার্যকরী কমিটির ‘বহিস্কৃত সদস্য’ মাহমুদুল হক ভূইয়া। শুক্রবার বেলা ১১টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। দলের কর্মী হিসেবে নিজেও ব্যর্থতার দায় নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিগত ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা নির্বাচেন দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করায় মাহমুদুল হক ভূইয়াকে জেলা আওয়ামী লীগের সুপারিশের প্রেক্ষিতে দল থেকে বহিস্কার করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। যদিও, মাহমুদুল হক ভূইয়া বহিস্কারের কোনো চিঠি পাননি বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে পৌর নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকরা জড়িত থাকতে পারে এ হামলায়।
নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা ঢাকার কৌশল উল্লেখ করে মাহমুদুল হক ভূইয়া বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আছে। কিন্তু তাণ্ডব ঠেকাতে জেলা আওয়ামী লীগ ব্যর্থ ছিল। সেই ব্যর্থতার দায় এড়াতেই বিগত পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। শুধু আমি কেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কেউ এরকম কোন কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারে- সেটি আমি বিশ্বাস করতে পারি না’।
ঘটনার সূত্রপাতের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোকতাদির চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের নেতৃত্বে মিছিল হয়েছিল। সেই মিছিলের পেছন থেকে যারা উস্কানি দিয়েছিল মাদারা ছাত্রদেরকে, ভিডিও ফুটেজগুলো ভালো করে পর্যালোচনা করলে দেখবেন- তারা আওয়ামী লীগ নামধারী ছদ্মবেশী এবং অনুপ্রবেশকারী, তারা কেউই বঙ্গবন্ধুর সৈনিক না।’
তিনি বলেন, ‘কান্দিপাড়া ও শিমরাইলকান্দি বিএনপি-ছাত্রদল অধ্যুষিত এলাকা। বড় মাদরাসাটাও ওই এলাকায়। আমার বাসার গেইটের ভেতর থেকে যা দেখার সুযোগ হয়েছে, আমার কাছে মনে হয়েছে হুজুরদের সঙ্গে কান্দিপাড়া-শিমরাইলকান্দির বহুসংখ্যক ছাত্রদলের উশৃঙ্খল যুবক ঘটনার সাথে জড়িত।’
‘মোদিবিরোধী’ আন্দোলনকে সামনে রেখে গত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তান্ডব চলে। ওই তিনদিনে শতাধিক সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাড়ি পুড়ে ছাই করে দেয়া হয়। সংঘর্ষে নিহত হয় অন্তত ১৩ জন।