”ব্রেক্সিট এক্সিট“ By Dr. Zaki Rezwana Anwar

Dr. Zaki Rezwana Anwar

এখন থেকে ঠিক আশি বছর আগে আসন্ন যুদ্ধ ঠেকানোর লক্ষ্যে জার্মান নাৎসী নেতা হিটলারকে তুষ্ট রাখতেই ‘মিউনিক এগ্রিমেন্টে’ স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন কনসারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেইন। আশা ছিল, এটি ইউরোপে সংঘাত ঠেকাবে – যুদ্ধ ঠেকাবে। তাই চেম্বারলেইন এই চুক্তিকে আখ্যা দিয়ে ছিলেন ‘পিস ফর আওয়ার টাইম। কিন্তু বছর না ঘুরতেই পোল্যান্ডে হিটলার বাহিনী আক্রমণ করায় চেম্বারলেইন জার্মানীর বিপক্ষে বিশ্বযুদ্ধের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। ইতিহাস কিন্তু কখনোই এই ‘মিউনিক এগ্রিমেন্ট’-কে আপাত: শান্তির উদ্যোগ হিসেবে গণ্য কওে না, বরং এই দুর্বল, অতি নমনীয় ও আপোষমূলক চুক্তির জন্যে আজও নেভিল চেম্বারলেইনকে শক্তিশালী অপর পক্ষের কাছে নতি স্বীকার করা একজন দূর্বল প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই চিন্তিত করে আসছে।

২৮ মে ১৯৩৭ সাল থেকে ১০ মে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কনজারভেটিভ পার্টির নেভিল চেম্বারলেইন

আশি বছর পর টেরিসা মের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে করা ব্রেক্সিট ডিলটি একবার হলেও কি বৃটেনবাসীকে আট দশক আগের চেম্বারলেইনকে মনে করিয়ে দেয় না? কারণ ই-ইউ থেকে বেরিয়ে আসার পরে ট্রানজিশন পিরিয়ডের পরে আইরিশ – উত্তর আয়ারল্যান্ড সীমান্তে ব্যাক স্টপের কি হবে তা নিয়ে শঙ্কা থাকাটা অমূলক নয়।

এই ডিলটি এখন বৃটিশ পার্লামেন্টে পাশ করানো মিসেস মে’র পরবর্তী কাজ। কিন্তু রবিবারে ছুটির সকালে চোখ সেঁটে গেল সানডে এক্সপ্রেস, অবজারভার, দ্যা মেইল, সানডে টেলিগ্রাফের এবং সানডে টাইমস – প্রতিটি পত্রিকার প্রথম পাতায়। প্রধানমন্ত্রী মে বৃটেনবাসীকে সরাসরি অনুরোধ করছেন তার পেছনে থেকে তার ডিলকে সমর্থন দিতে। এর আগে কোনো বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর দেশবাসীকে এরকম খোলা চিঠি দেওয়ার ঘটনা আমাদের জানা নেই। শুধু তাই নয়, টেরিসা মে সফর করছেন ওয়েলস, উত্তর আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড – অনেকটা নির্বাচনী ক্যম্প্যাইন ষ্টাইলে।

বৃটিশ রাজনীতির ভাষায় এমপি-দের মিনিংফুল ভোট হবে ১১ই ডিসেম্বরে এবং তার জন্যে বিতর্ক শুরু হয়ে যাবে ডিসেম্বরের ৪ তারিখ থেকে। তবুও প্রধানমন্ত্রী এ মূহুর্তে এমপিদের সাথে আলোচনার চাইতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে ছুটে বেড়ানোকে প্রাধান্য দিলেন কেন? এসব নিশ্চয়ই আমাদের কিছুর আলামতের কথাই জানান দিচ্ছে।

১৯২২ কমিটির কাছে ম্যাজিক নাম্বার ৪৮ হোক আর না হোক ১১ই ডিসেম্বরে ভোটাভুটিতে টেরিসা মে’র এই ডিলটি যে পাশ হবে না তা মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যদিও হুইপ এবং ফিলিপ হ্যমন্ডের নেতৃত্বে মিসেস মে’র রিমেইনার ৫ সহযোগীর চেষ্টায় আগামী কয়েক দিনে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হবে ব’লে অনেকে ধারণা করছেন। এই ডিলটি পাশ না হলে টেরিসা মে সঙ্গে সঙ্গেই কন্ফিডেন্স ভোটের মুখোমুখি হবেন। মিসেস মে’র যে কোনো সংকটময় মূহুর্তে ডি ইউ পি যে সাপ্লাই এন্ড কন্ফিডেন্স এগ্রিমেন্ট ভেঙে ফেলবে তার সমূহ সম্ভাবনা আমি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি।

এই ডিলটি পাশ না হলে নরওয়ে ষ্টাইলে ডিল টেবিলে স্থাপন করারও সুযোগ কতটা সফল হবে সে বিষয়েও কোনো আশার আলো দেখছিনা। নতুন কোরে নিগোশিয়েট করার মত ম্যনুভারিং স্পেইস যে বৃটেনের রয়েছে – এমনটিও নয় কিন্তু। তাছাড়া যেহেতু নরওয়ে ষ্টাইল ডিলে ইউরোপিওদের অবাধ চলাচল বন্ধ করা যাবে না, কাজেই যারা ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট কোরেছেন তাদের কাছে এটি একটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব হওয়ার কথা না। নো ডিল ব্রেক্সিট যে উভয় দলই ঠেকাবেন তাও পরিস্কার।

সাধারণ নির্বাচনের কথাও উঠতে পারে যা সঙ্গত কারণেই লেবার দলের কাম্য হতে পারে। কেউ কেউ ভাবতেও পারেন যে রাণী জেরেমি করবিনকে ডেকে মাইনরিটি গভর্নমেন্ট (সংখালঘু সরকার) গঠন কোরতে বলবেন এবং জেরেমি করবিন এস এন পি-র সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করবেন। সেরকম কিছু এখন হবে ব’লে আমার মনে হয় না। ইউরোপ নিয়ে টোরি দলের মধ্যে যতই রক্তক্ষরণ হোক না কেন – টোরির অপারগতার কারণে বর্তমান ব্রেক্সিট সমস্যাকে অমিমাংসিত অবস্থায় রেখে দিয়ে সাধারণ নির্বাচনের পক্ষে একজন টোরি এমপিরও সমর্থন জানানোর কথা নয়। কারণ টোরি দল জানে তাদের তৈরী অমিমাংসিত ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে নির্বাচনে গেলে বৃটেনের জনগণ তাদের চিরতরে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেবে।

একে একে সকল দুয়ার বন্ধ হবার পর যে পথে দু’দলই হাঁটতে পারে তা হচ্ছে দ্বিতীয় রেফারেন্ডম, যেটিকে বৃটিশ রাজনীতিকগণ হালে রেফারেন্ডম না ব’লে রিব্রেন্ডিং করে বলতে শুরু করেছেন ‘পিপলস ভোট।’ বৃটেনের পার্লামেন্টের রাজনীতিকগণ হাঁটু গেঁড়ে বসে বলবেন ‘হে বৃটেনবাসী, আমরা তোমাদের দেওয়া গণতান্ত্রিক রায়ের বাস্তবায়ন করতে পারিনি, আমাদের ত্রাণকল্পে তোমরা আরেকবার এগিয়ে আস।’ এবং এটি হবে গণতন্ত্রের সূতিকাগার বৃটেনের জন্য একটি চপেটাঘাত। তবে মনে হচ্ছে তেঁতো হলেও এই কুইনিনটিই সবাইকে গিলতে হবে শেষ পর্যন্ত।

পুরো ব্যাপারটাতে লেবার পার্টি খুব সাবধানে আধ-পা এক-পা করে এগুচ্ছে। সেই প্রথম থেকেই ব্রেক্সিট বিষয়ে জেরেমি করবিন ফেন্সের উপরই বসে আছেন। কারণ দেশের উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলে তাদের যে বহু সংখ্যক ভোটার রয়েছে তাদেরকে নিশ্চয়ই তিনি হারাতে চাইবেন না। বিশেষ করে ব্রেক্সিট অঞ্চলে যেসব লেবার এমপি রয়েছেন তারা বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করবেন বৈকি। লেবার পার্টির মনে যত রকমের অভিলাষই থাকুক না কেন জনগণের কাছে এভাবেই তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে যে তারা লাফিয়ে পড়ে প্রথমেই নির্বাচন বা দ্বিতীয় রেফারেন্ডমের প্রস্তাব দিচ্ছেনা বরং অপেক্ষা করছে সবগুলো উপায় খতিয়ে দেখা পর্যন্ত। তবে সাংবাদিকদের সমূহ চাপের মুখে একদিন জেরেমি করবিন বলে ফেলেছিলেন ‘সেকেন্ড রেফারেন্ডম ইজ নট এন অপশন ফর টুডে, বাট এন অপশন ফর টুমোরো।’

একটি অশনি সংকেতের কথা উল্লেখ না করে লিখাটির ইতি টানতে পারছিনা। জাতির এধরনের দুর্যোগের অপেক্ষায় সুবিধাবাদী বর্ণবাদী কুরাজনীতিকরা উঁৎ পেঁতে থাকে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আজ বৃটেনের এই অবস্থার পেছনে নাইজেল ফারাজের মত একজন কুরাজনীতিক কতটা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে ইউকিপের জনপ্রিয়তা কিছুটা বেড়ে গেছে। তার কারণ বোধকরি এই যে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি যখন জনগণ বিতশ্রদ্ধ হয়ে যায় তখন কিছু লোক ‘সামহোয়্যার সামবডি’-কে ভোট করে। এর একটি সাম্প্রতিক এবং জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে ফ্রান্সে মেরিন-লো-পেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রায় জিতে যায় যায় অবস্থা। তাই আমি মনে করি আমাদের ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্টিং মিডিয়ার এ ব্যাপারে অত্যন্ত দ্বায়িত্বশীলতার পরিচয় রাখতে হবে, যেটি করতে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছিল রেফারেন্ডমের আগে। কে কাকে ভোট করবে সেটি তার ব্যক্তিগত ও গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে বৃটিশ জনগণ যে যথেষ্ট জ্ঞান নিয়ে রেফারেন্ডমে ভোট দেয়নি তার প্রমাণ হল ব্রেক্সিটের সঙ্গে সঙ্গেই বৃটেনের গুগুলের কাছে জানতে চাওয়া প্রথম প্রশ্ন ছিল ‘ই-ইউ থেকে বেরিয়ে আসার অর্থ কি’ এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল ‘ইইউ কি।’ মিডিয়া কি কিছুটা হলেও এর দায় নেবে না?

লেখক : ডক্টর জাকি রিজওয়ানা আনোয়ার, মা ও শিশু বিশেজ্ঞ। চ্যানেল এসের সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার এবং সিনিয়র কমিউনিটি এক্টিভিস্ট।

ব্রিটবাংলায় প্রকাশিত ডক্টর জাকি রিজওয়ানা আনোয়ারের অন্যান্য লেখার লিঙ্ক নিচে।

https://britbangla24.com/news/47070

https://britbangla24.com/news/36629

https://britbangla24.com/news/28055

এছাড়াও ডক্টর জাকি রিজওয়ানা সম্পর্কে জানতে পড়ুন

https://britbangla24.com/news/62120

Advertisement