ভালোবাসা এবং ভালোবাসা

:: মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মার্চ মাসের তিন তারিখ শনিবার বিকালে আমি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের তৈরি করে আনা রোবটদের যুদ্ধ দেখছি, হঠাৎ করে মনে হল আমার মাথায় বুঝি ‘আকাশ ভেঙে’ পড়েছে। বড় কোনো দুঃসংবাদ পেলে আমরা বলি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে, তবে এটি পুরোপুরি আক্ষরিক। মনে হচ্ছে মাথার উপর সত্যি কিছু ভেঙে পড়েছে- একবার, দুইবার, বারবার।

কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না, মানুষের চিৎকার, হইচই- তার মাঝে আমি উঠে দাঁড়ালাম। বুঝতে পারলাম যেটাই ঘটে থাকুক সেটা শুধু আমাকে নিয়ে। মঞ্চ থেকে আমি নিচে তাকিয়েছি, ছাত্রছাত্রীরা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছে। একজন ছাত্রীর চোখে অবর্ণনীয় আতঙ্ক, সে দুই হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করছে।
আমি তাদের শান্ত করার চেষ্টা করলাম। হাত নেড়ে বললাম, ‘আমার কিছু হয়নি, আমি ঠিক আছি’- কিন্তু আমার কথায় কোনো কাজ হল না। নিচে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েরা চিৎকার করতেই থাকল। আমি মাথায় হাত দিলাম এবং রক্তের উষ্ণ ধারা অনুভব করলাম। হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম ভয়ানক কিছু একটা ঘটে গেছে, কেউ একজন আমাকে মেরে ফেলার জন্য আক্রমণ করেছে।

সেই মুহূর্তের অনুভূতিটি আমি কখনও ভুলব না। অনুভূতিটি ভয়ের নয়, অনুভূতিটি যন্ত্রণার নয়, অনুভূতিটি হতাশা কিংবা ক্রোধেরও নয়। অনুভূতিটি ছিল লজ্জার। আমি বিস্ময়কর একধরনের লজ্জায় কুঁকড়ে উঠেছিলাম। আমার মনে হল এই পৃথিবীতে এমন মানুষ আছে যে আমাকে এত ঘৃণা করে যে সে আমাকে প্রকাশ্য দিবালোকে মেরে ফেলতে চায়? আমি কী করেছি?

চারপাশে কী হচ্ছে আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। মঞ্চের একপাশে একজনকে অনেকে মিলে মারছে, কাছে একটা চাকু পড়ে আছে। আমি দুর্বলভাবে তাকে না মারতে বললাম। আমার কথা কেউ শুনতে পেল কিনা জানি না। আমার ছাত্র আর সহকর্মীরা ততক্ষণে আমাকে জাপটে ধরে টেনে সরিয়ে নিতে থাকে। পুলিশের যে সাদা মাইক্রোবাসটি ক্যাম্পাসে সারাক্ষণ আমাকে অনুসরণ করতে থাকে এবং এতদিন যেটাকে আমি পুলিশ বাহিনীর একটা অর্থহীন কাজ বলে ভেবে এসেছি, হঠাৎ করে সেটি আমার জীবন বাঁচানোর কাজে লেগে গেল। একটা ছেলে তার শার্ট খুলে আমার মাথায় চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে। অন্যরা আমাকে রীতিমতো পাঁজাকোলা করে মাইক্রোবাসে তুলে নিল এবং মুহূর্তের মাঝে মাইক্রোবাসটি আমাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটে যেতে থাকে।

প্রথম আমার যে কথাটি মনে হল সেটি হচ্ছে- আমি এখনও জ্ঞান হারাইনি, কাজেই আমাকে আমার স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে নিজে কথা বলতে হবে যেন তাদের খবরটি অন্য কারও কাছ থেকে পেতে না হয়। সাধারণত আমি এবং আমার স্ত্রী দু’জনে সবসময়ে একসঙ্গে থাকি, কিন্তু আজকে এ মুহূর্তে সে ঢাকায়। প্রথমে আমার মেয়ের সঙ্গে তারপর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে যতটুকু সম্ভব শান্তভাবে তাদের খবরটি দিলাম। বললাম, এখনও জ্ঞান আছে এবং এখনও চিন্তা করতে পারছি, তবে যেহেতু অনেক রক্ত পড়ছে তাই পরে কী হবে জানি না। আমি আমার ছেলে, ভাইবোন সবাইকে খবরটা দিতে বললাম। এ ধরনের খবর টেলিভিশন থেকে পেতে হয় না। মনে হল ভাগ্যিস আমার মা বেঁচে নেই, না হলে তাকেও এ খবরটি দিতে হতো!

মাইক্রোবাস মোটামুটি ঝড়ের বেগে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে এবং তখন আমি একটু বোঝার চেষ্টা করলাম আমার আঘাত কতটুকু গুরুতর। সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে যাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম আমার আঘাত মাথায়, তাই একটা শার্ট দলামোচা করে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে; কিন্তু পিঠেও একটা অনেক বড় আঘাত আছে আমি যেটার কথা তখনও জানি না। আমার একমাত্র সম্বল আমার মস্তিষ্কটি, মাথার আঘাতে সেটার কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা কে জানে? আমি ভাবলাম পরীক্ষা করে দেখি মস্তিষ্কটি ব্যবহার করতে পারি কিনা। তাই ফিবোনাচি সিরিজটি বের করার চেষ্টা করলাম, ‘১ যোগ ১ সমান ২, ২ যোগ ১ সমান ৩, ২ যোগ ৩ সমান ৫…।’ গোটাদশেক পদ বের করে আমি বুঝতে পারলাম এখনও হিসাব করতে পারছি। তখন আমি আমার স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করার চেষ্টা করলাম। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি আমার খুব প্রিয়, মনে মনে তার প্রথম কয়েকটা লাইন আওড়ে গেলাম- ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…।’ যখন দেখলাম বনলতা সেন কবিতাটি মনে আছে, তখন নিজেকে নিজে বোঝালাম- মস্তিষ্কের সম্ভবত গুরুতর ক্ষতি হয়নি!

হাসপাতালে পৌঁছানোর পর সেখানে বিশাল হইচই শুরু হয়ে গেল। এত দ্রুত কীভাবে খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং এত দ্রুত কীভাবে হাসপাতাল লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় সেটি আমার জন্য একটি রহস্য! আমাকে প্রথমে হুইলচেয়ারে তারপর একটি ট্রলিতে শুইয়ে হাসপাতালের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতে লাগল। একটি ট্রলি দু’জনই ঠেলে নিতে পারে; কিন্তু আমি দেখলাম কয়েক ডজন ছাত্র, শিক্ষক এবং অপরিচিত মানুষরা আমার ট্রলিটি ঠেলে হাসপাতালের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। তার মাঝে বিপজ্জনক জায়গায় দাঁড়িয়ে টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানরা ছবি নেয়ার চেষ্টা করছে। দেখলাম কমবয়সী একজন একটা ক্যামেরা নিয়ে ভিড়ের মাঝে অনেক ঠেলাঠেলি করে একটা মোক্ষম ছবি তোলার চেষ্টা করছে! আমার কী মনে হল কে জানে, সকৌতুকে ছেলেটিকে ডেকে বললাম, ‘এসো, একটা সেলফি তুলে ফেলি!’ ছেলেটি লজ্জা পেয়ে সরে গেল- এখন মনে হচ্ছে ছেলেটাকে এভাবে লজ্জার মাঝে ফেলে দেয়া ঠিক হয়নি; কিন্তু তখন আমি যথেষ্ট সন্তুষ্টি অনুভব করেছিলাম। মনে হয়েছিল যেহেতু এরকম অবস্থাতেও আমার সেন্স অফ হিউমার অক্ষত আছে, তার মানে আমার মস্তিষ্কটিও নিশ্চয়ই অক্ষত আছে!

হাসপাতালের নানা জায়গা ঘুরে আমাকে অপারেশন থিয়েটারে আনা হল। ততক্ষণে ডাক্তার ও নার্সরাও চলে এসেছেন। শুধু ডাক্তার ও নার্স নয়, সেই সঙ্গে অসংখ্য মানুষ : ক্যামেরাসহ সাংবাদিক, ছাত্র, শিক্ষক, সহকর্মী, পুলিশ এবং অসংখ্য কৌতূহলী দর্শক! আমার অনেক সহকর্মী এবং পরিচিত মানুষ ভেঙে পড়ে কান্নাকাটি করছেন এবং আমি তাদের নানাভাবে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছি! আমি ডাক্তার নই, কিন্তু কমনসেন্স থেকে বুঝতে পারছি আমার রক্তপাত বন্ধ করতে হবে এবং রক্ত দিতে হবে। অপারেশন থিয়েটারের এই বাজারের ভেতর সেটা কেমন করে করা হবে আমি জানি না। এর মাঝে আমার রক্তের গ্রুপের কথা বলা হয়েছে (শুনে অনেকে বিশ্বাস নাও করতে পারেন, আমি আমার রক্তের গ্রুপ জানি, এ পজিটিভ!), আমি যদিও এ পজিটিভ বলেছি, অপারেশন থিয়েটারে শুয়ে মনে হল উৎসাহী কেউ কেউ সেটাকে ও পজিটিভ শুনতে পেরেছে! যে ডাক্তার আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাকে বললাম, ‘রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা না করে আমাকে রক্ত দেবেন না প্লিজ!’ ডাক্তার আমাকে অভয় দিলেন, বললেন, রক্তের গ্রুপ না মিলিয়ে কখনও রক্ত দেয়া হয় না।

অপারেশন থিয়েটার বোঝাই মানুষজনের মাঝেই ডাক্তাররা কাজ শুরু করে দিলেন। আমাকে জানালেন, আমার আঘাতটা যাচাই করে চিকিৎসা শুরু করার আগে আমাকে জেনারেল এনেসথেসিয়া দিতে হবে। ঠিক কী কারণ জানা নেই, আমার মনে হচ্ছিল আমাকে অজ্ঞান করা হলে আমি বুঝি আর জ্ঞান ফিরে পাব না! মাঝে মাঝেই আমার মনে হচ্ছিল আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলব; কিন্তু আমি দাঁতে দাঁত চেপে জ্ঞান ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। আমি অবুঝের মতো ডাক্তারদের সঙ্গে তর্ক করতে শুরু করেছি, তাদের বলতে শুরু করেছি- আমাকে অজ্ঞান না করে চিকিৎসা শুরু করেন। ডাক্তাররা বললেন, তাহলে আপনার এত যন্ত্রণা হবে যে সেই যন্ত্রণাতেই আপনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। আমি তাতেই রাজি, কিন্তু ডাক্তাররা আমার মতো অবুঝ মানুষের ছেলেমানুষী আবদার মেনে নিশ্চয়ই চিকিৎসা করতে আসেননি- তাই আমি নিজেও জানি না কখন আমি জ্ঞান হারিয়েছি।

এরপর আবছা আবছাভাবে যখন আমার জ্ঞান হল তখন মনে হল আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যতক্ষণ জ্ঞান ছিল ততক্ষণ নিশ্চয়ই আমার শরীরে এড্রেনেলিনের বন্যা বইছিল, তাই সবকিছুতে সজাগ হয়েছিলাম। এখন আমি পুরোপুরি নির্জীব! কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। একসময় চোখ খুলে তাকিয়েছি, মনে হল আমাদের শিক্ষামন্ত্রী আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা বলছেন। আমি শোনার চেষ্টা করলাম, মনে হল তিনি বলছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্য আমাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমি যেন কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা না করি।

তখন আমার চিন্তা করার বিশেষ ক্ষমতা নেই। চেতনা ও অচেতনার মাঝে ঝুলে আছি। হেলিকপ্টারে আমার এক-দু’জন সহকর্মীকে দেখতে পেলাম। একসময় হেলিকপ্টার উড়তে শুরু করল, কতক্ষণ উড়েছে জানি না, মনে হল বুঝি অনন্তকাল পার হয়ে গেছে। একসময় হেলিকপ্টার থেমেছে, আমাকে স্ট্রেচারে করে নামানো হল, সবাই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত, তাই কেউ উপরে আকাশের দিকে তাকায়নি! শুধু আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি- নির্মেঘ বিশাল একটি আকাশ, তার মাঝে ভরা একটি চাঁদ øেহভরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি শিহরণ অনুভব করলাম, পৃথিবী এত সুন্দর? এ সুন্দর পৃথিবীতে আমি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারব?

আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে সিএমএইচ হাসপাতালে নেয়া হল, সেখানে আমার সব আপনজন অপেক্ষা করছে। কেউ কাছে আসছে না, সবাই দূর থেকে দেখছে। ডাক্তাররা আমাকে পরীক্ষা করলেন, আমার স্ত্রী এসে একটু কথা বলল, তারপর আবার আমাকে সরিয়ে নেয়া হল। কিছুক্ষণের মাঝে সিসিইউয়ের অসংখ্য জটিল যন্ত্রপাতির মাঝে আমি আটকা পড়ে গেলাম! আবছা আবছাভাবে মনে পড়ে, কোনো একসময় ডাক্তারদের কাছে চিঁ চিঁ করে জানতে চাইলাম আমার অবস্থা কেমন? তারা বললেন, ভালো। আমি জানতে চাইলাম, সবাইকে কি এটা জানানো হয়েছে? তারা বলছেন, হ্যাঁ, জানানো হয়েছে, আমার অবস্থা আশঙ্কামুক্ত। আমি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমি এখনও জানি না কারণটা কী; কিন্তু আমি অনুভব করতে পারি এ দেশের অসংখ্য ছেলেমেয়ের আমার জন্য একধরনের ভালোবাসা আছে, ‘ধুম’ করে মরে গিয়ে তাদের মনে কষ্ট দেয়ার আমার কোনো অধিকার নেই।

বাইরে কী হচ্ছে আমি কিছু জানি না। চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার পর শুনতে পারলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেখতে আসবেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার- আমি কে? আমাকে দেখার জন্য এদেশের প্রধানমন্ত্রী চলে আসবেন?

সত্যি সত্যি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেখতে এলেন, ডাক্তাররা আমার সম্পর্কে রিপোর্ট দিলেন। সিলেট ওসমানী হাসপাতালের ডাক্তাররা অবিশ্বাস্য চাপের মাঝে থেকেও কী অসাধারণভাবে আমাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়েছেন সেটা বললেন। প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে কথা বললেন, খোঁজখবর নিলেন। চলে যাওয়ার সময় আমি কুণ্ঠিত স্বরে বললাম, ‘আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে ষোলো কোটি মানুষের দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী আমার মতো একজনকে দেখতে চলে এসেছেন!’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে আপনজনের মতো হেসে বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কোনো বড় কিছু না, আজ আছি কাল নেই। কিন্তু এটা সত্যি যে আমি হচ্ছি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে! এটা আমার অনেক বড় অহংকার, কেউ এটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।’

আমার মনে হল এর চেয়ে বড় সত্যি কথা আর কী হতে পারে? সঙ্গে সঙ্গে আমার এটাও মনে হল যে, আমার কত বড় সৌভাগ্য, যার ধমনীতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত তিনি আমাকে দেখতে চলে এসেছেন! কী অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার!

যাই হোক, আমি আমার জীবনে এভাবে এর আগে কখনও হাসপাতালে থাকিনি। হাসপাতালে থাকার অভিজ্ঞতাটুকু খুবই বিস্ময়কর- কাউকে যদি বলতে হয়, আমাকে শুধু একটি কথা দিয়ে বোঝাতে হবে- সেটি হচ্ছে ভালোবাসা! যে মেয়েটি আমার ঘরের মেঝেটি মুছে দিয়েছে, সেখান থেকে শুরু করে যার নেতৃত্বে এ বিশাল প্রতিষ্ঠানটি চলছে- সবাই আমার জন্য যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, আমি কোনোদিন তার প্রতিদান দিতে পারব না। কথা প্রসঙ্গে আমি তাদের বলেছি, যদি কোনোভাবে আমার এ হাসপাতালের অভিজ্ঞতাটুকু আগে হতো তাহলে আমি নিশ্চিতভাবে আমার অগ্রজ হুমায়ূন আহমেদকে তার চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে না গিয়ে এখানে চিকিৎসা করার জন্য বলতাম। আমার জন্যই সবার বুকের ভেতর এত ভালোবাসা, হুমায়ূন আহমেদকে তারা সবাই না জানি কত গভীর মমতা দিয়ে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করতেন।

আমার এ ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর শুনেছি সারা দেশে একধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে, দেশের অনেক মানুষ নানাভাবে আমার জন্য তাদের ভালোবাসাটুকু প্রকাশ করেছেন। আমি সেই দিনগুলোর খবরের কাগজ দেখিনি, টেলিভিশনের খবর শুনিনি, তারপরও আমি সবার ভালোবাসাটুকু অনুভব করতে পারি। সবার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের অস্থিরতার খবর জানতাম বলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় না এসে সরাসরি এয়ারপোর্টে গিয়েছি, একটা প্লেন ধরে সিলেট গিয়েছি। যে মুক্তমঞ্চে বিভ্রান্ত ছেলেটি আমাকে আক্রমণ করেছিল সেই একই মুক্তমঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় আমার ঘুরেফিরে অভিজিৎ, অনন্ত, নিলয়, ওয়াসিক, দীপন এ রকম সবার কথা মনে পড়ছিল যারা কেউ বেঁচে নেই। আমি কীভাবে বেঁচে গিয়েছি, কেন বেঁচে গিয়েছি এখনও জানি না। যখন এ লেখাটি লিখছি তখন আমার প্রিয় ছাত্র মাহিদ আল সালামের কথা মনে পড়ছে। শাহবাগে আমার ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ সভায় সে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছেন অথচ দুর্বৃত্তের আক্রমণে দু’দিন আগে একেবারে হঠাৎ করে তাকে জীবন দিতে হল। কে জানে পৃথিবীটা কেমন করে এত নিষ্ঠুর হয়ে যেতে পারে।

দেশের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য আমি এ লেখাটা লিখছি। অসংখ্য মানুষ আমাকে ভালোবাসা জানিয়ে চিঠি লিখেছেন, তাদের সবার জন্য ভালোবাসা। যারা আমাকে লিখেছে, আলাদা করে আমি তাদের সবার কথা উল্লেখ করতে পারব না, শুধু ছোট একটা মেয়ের কথা লিখি। যে আমাকে সাহস দিয়ে লিখেছে, একটু বড় হয়েই সে কারাটে ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাবে। তারপর ব্ল্যাক বেল্ট হয়ে আমার বডিগার্ড হয়ে বাকি জীবন আমাকে পাহারা দিয়ে বেড়াবে যেন আর কেউ কখনও আমার ওপর আক্রমণ করতে না পারে!

আমার ওপর এ আক্রমণটি না হলে আমি কি কখনও জানতে পারতাম কতজনের বুকের ভেতর আমার জন্য কত ভালোবাসা জমা হয়ে আছে?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক; অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিশ্ববিদ্যালয়

Advertisement