॥ ডক্টর এম মুজিবুর রহমান ॥
দ্বিতীয় পর্ব :
এক:
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ–রাজনীতি নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে বিভিন্ন মিডিয়া বিশ্লেষণমূলক লেখা প্রকাশ করছে । সম্প্রতি চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত সংঘাতের পর থেকে এটা এখন আর মিডিয়ার আলোচনায় সীমাবদ্ব নেই। কূটনীতি ও রাজনীতি এ নিয়ে সরগরম। ১৮ আগস্ট মঙ্গলবার করোনার মধ্যেও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এক ঝটিকা সফরে ঢাকা এসেছেন। ভারতের সংবাদ মাধ্যম দ্য প্রিন্ট‘র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রিংলার ঝটিকা সফরের খবর এমন সময়ে এলো যখন বাংলাদেশ খুব দ্রুত তিস্তা নদী প্রকল্পে চীন থেকে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার পেতে যাচ্ছে বলে ঘোষণা হয়েছে । এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা ইস্যুর আশু সমাধান হবে বলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে কথা দিলেও এখন পর্যন্ত এতে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সেই বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি । ভারতীয় মিডিয়া বলছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিদেশ দূত হিসাবে শ্রিংলা একটি বিশেষ বার্তা হস্তান্তর করেছেন। বলা হচ্ছে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ, সম্প্রতি প্রকাশিত একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার বহুল আলোচিত সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গ নাকি আলোচনায় স্থান পেয়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো হাই প্রোফাইল বৈঠক প্রশ্নে মিডিয়াকে তেমন কিছু জানানো হয়নি।
বাস্তবিক অর্থে দু‘দিক থেকেই পরিষ্কার করে কিছু বলা হচ্ছে না। কূটনীতিতে সাবধানতার সাথে শব্দচয়ন করার চেষ্টা করা হয়। তাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকেরা রুঢ় বাস্তবতাকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন । যেসব দেশে তুলনামূলকভাবে সহনশীল রাজনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন সর্বোপরি জনগণের ভোটাধিকার বিদ্যমান সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতার একটা বাধ্যবাধকতা থাকে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের বিশেষজ্ঞরা তাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্য দেশের সাথে সম্পাদিত সমঝোতাস্মারক বা চুক্তিসমূহের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, যাতে করে নিজ দেশের স্বার্থ অক্ষুন্ন থাকে। আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে মেঠো বক্তৃতার একটা রেওয়াজ থাকলেও কূটনীতিতে দেয়া–নেয়ার বিষয় জড়িত। তাই বিভিন্ন পক্ষের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে নিজের স্বার্থটুকু আদায় করে নিতে হয়। এখানে অন্য দেশের প্রতি দায়বোধ বা আবেগের বিষয় প্রাধান্য পাবার কথা নয় । তবে এটা নির্ভর করে আভ্যন্তরীন রাজনীতি ও দেশের জনগণের স্বার্থের ব্যাপারে দায়বোধ ও জবাদিহিতার উপর ।
ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ বিরোধী কুৎসিত প্রচারণার ব্যাপারে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশন প্রতিবাদ জানিয়েছে । চীন–ভারত সীমান্ত যুদ্ধে ভারত তাদের ভূমি হারিয়ে এবং পরিবর্তিত আঞ্চলিক ভূ–রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে হয়তো পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ বিশেষ করে বাংলাদেশ ও নেপালের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে চাইছে । বিশ্লষেকেরা মনে করেন, বিগত দিনগুলোতে প্রতিবেশী দেশসমূহ বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অবজ্ঞা, অভিন্ন নদীর ন্যায্য হিস্যা না দেয়া, সীমান্ত হত্যা এবং সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিকত্ব আইনসংশোধনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ লোককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি প্রদান, মুসলমান হিন্দু বিভাজনকে উস্কে দেয়া ইত্যাদি নানা ইস্যূতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতের ইমেজ একেবারে তলানিতে। এর পরে গত দু‘তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ নিয়ে দেশের জনগণ, সুশীল সমাজ ও বিরোধীদলসমূহের চাপা ক্ষোভ রয়েছে বলে মনে করা হয় । এক্ষেত্রে বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের বিতর্কিত ভূমিকার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত । ঐ সময় তিনি দেখা করলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রয়াত এইচ এম এরশাদের সাথে। সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেই এরশাদ ঘোষণা দেন, ‘ওনারা বলেছেন, নির্বাচন করুন। আমি নির্বাচন না করলে নাকি জামায়াত–শিবিরের মতো মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসবে।’ বলা হয় – তিনি তাকে অনুরোধ করেছিলেন পরের বছর ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেবার জন্য। বিষয়টি মিডিয়ার কাছে এরশাদ ফাঁস করে দিলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। (সূত্র: প্রথম আলো, ৭ ডিসেম্বর ২০১৩) । তাই ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সফর নিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যা বলা হচ্ছে বিষয়টি হয়তো এতো সাদামাটা নয়। অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের এই বাস্তবতা বিশ্বাস করার সাহস দেয় না। আগেই যে চুন খেয়ে আমাদের মুখ পুড়ে আছে। কথায় আছে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।
দুই:
চীন ও ভারত উভয়ে যার যার স্বার্থে বাংলাদেশকে ঘিরে আগ্রহ রয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ভূ–রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই শক্তি বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ–রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে যারা খোঁজ খবর রাখেন তাদের মধ্যেও ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানী ও কাঁচামাল সরবরাহে জল প্রবাহের গুরুত্ব অপরিসীম। শিপিং লাইন দিয়ে প্রতি বছর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার সমপরিমাণের পণ্যদ্রব্যাদি এবং তৈল–গ্যাসের বাণিজ্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই এ শিপিং লাইন কোনো কারণে বন্ধ বা অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে উন্নয়নের চাবিকাঠি আমদানী–রপ্তানী বাণিজ্যসম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়াও রয়েছে সমুদ্র থেকে অফুরন্ত সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতা। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্রের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, জ্বালানি–ভান্ডার ও নৌ–পথে মালামাল সরবরাহে নিষ্কন্টক নিরাপত্তা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়টি মাথায় রেখে অনেক দেশের বিদেশ নীতি পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের ভূখণ্ড বঙ্গোপসাগরের পূর্ব তীরে অবস্থিত। পশ্চিম তীরে রয়েছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার ভূখণ্ড । আর বঙ্গোপসাগরের উত্তর তীরে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ড অবস্থিত। তীরবর্তী দেশগুলোর ব্যবসাবাণিজ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে নৌ পথে যেতে পারে। স্বভাবতই বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলো বঙ্গোপসাগরে তাদের প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখতে চাইবে। এক্ষেত্রে কোনো দেশ একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখবে নাকি সম্মানজনক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে তা নির্ভর করে দেশগুলোর আভ্যন্তরীন রাজনীতির ধরণ, দেশের স্বার্থ রক্ষায় পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক শক্তির ওপর।
ভারত যেমন বাণিজ্যিক ও সামরিক স্বার্থে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করতে চায়, তেমনই চীনও নিজের বাণিজ্যিক ও সামরিক স্বার্থে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করতে চাইতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কমন সীমান্ত না থাকায় চীনকে মিয়ানমারের সীমান্ত হয়ে বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করতে হয়। এক্ষেত্রে কোনো বৃহৎ অর্থনীতির দেশ শুধুমাত্র একটি দেশের উপর নির্ভর করে থাকতে চায় না। তাই বাণিজ্যিক স্বার্থের পাশাপাশি ভূ–কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে চীনের আগ্রহ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
চীন একটি বৃহৎ দেশ। এর পূর্ব থেকে পশ্চিমের দৈর্ঘ্য কল্পনা করাই কঠিন। দক্ষিণ–পশ্চিম অংশ থেকে চীনের মালামাল যদি সমুদ্র পথে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় নিতে হয়, তাহলে সেই মালামাল প্রথমে নিতে হবে চীনের পূর্ব অংশের বন্দরে। এটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। তাই চীন যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সময় ও খরচ বাঁচাতে পারে, তাহলে তার অর্থ সাশ্রয় হয়। অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টি চীন চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক।
ব্রস ভৌগন (Bruce Vaughn) নামে একজন এশীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ‘বাংলাদেশ: পলিটিক্যাল এন্ড স্ট্রাটেজিক ডেভেলপমেন্টস এন্ড ইউএসইন্টারেস্টস‘ (Bangladesh : Political and Strategic Developments and US Interests) শিরোনামে ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট আমেরিকান কংগ্রেস সদস্যদের জন্য একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করেন । এটি কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস (Congressional Research Service) (সিআরএস-CRS) রিপোর্ট সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। ওয়েবসাইটে যে কেউ তা দেখতে পারেন।
রিপোর্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চারজন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে মূখ্য ভূমিকা পালনকারী বা মূল খেলোয়াড় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন (১) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, (২) প্রধান বিরোধীদল বিএনপি’র চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, (৩) ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং (৪) সামরিক বাহিনী।কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বক্তব্যটি এই রিপোর্টে লেখা হয়েছে তা হচ্ছে– ‘Bangladesh is situated at the northern extreme of the Bay of Bengal and could potentially be a state of increasing interest in the evolving strategic dynamics between India and China. This importance could be accentuated by the development of Bangladesh’s energy reserves and by regional energy and trade routes to China and India’ (‘বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের একেবারে উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। তাই এখন ভারত ও চীনের মধ্যে কৌশলগত কারণে যে ধরনের গতিশীল সম্পর্কের সূচনা হয়েছে তাতে করে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে (মার্কিন) স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের জ্বালানি মজুদ বৃদ্ধি পেলে আঞ্চলিক জ্বালানি–ভান্ডার এবং চীন–ভারতের মধ্যেকার বাণিজ্য পথের জন্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়বে’) ।
চীন, ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও ভূ–রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এ কারণে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা বাংলাদেশের ওপর নানা রকম চাপ বাড়বে । বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র তার আগামীর কৌশলগত স্বার্থে সহযোগিতা পেতে বাংলাদেশকে হাতে রাখতে চায়। এই শঙ্কাও একদম উড়িয়ে দেয়ার মত নয় যে, তারা এমন চুক্তি করতে চায় যাতে বাংলাদেশে প্রয়োজনে তার সামরিক উপস্থিতির পথ সুগম হয়। সে লক্ষ্য অর্জনেই দেশটিকে অতিমাত্রায় সক্রিয় মনে হচ্ছে। নিজের স্বার্থ এবং শুধু স্বার্থই তাদের কাছে একমাত্র বিবেচ্য। এই পরিস্থিতি অনেকটাই যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ‘কোল্ড ওয়ার’ বা স্নায়ু যুদ্ধের ছায়া হিসেবে দেখা দিয়েছে।
তিন:
বাংলাদেশকে নিয়ে এখন অনেকেরই জোর আগ্রহ। সে আগ্রহ ক্রমবর্ধমান। বলা যায়, প্রতিবেশী বা নিকট প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান বা শ্রীলংকার চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশ। নেতৃত্ব বা অন্য কিছু নয়, বাংলাদেশের এই গুরুত্ব ভূ–রাজনীতি ও বিশাল জনসংখ্যার বাজার এর অন্যতম কারণ। ভারত যে কোনো অবস্থায় বাংলাদেশকে হাতে রাখতে চায়। উত্তরপূর্ব ভারতের ব্যাপারে শঙ্কামুক্ত থাকতে এটাই তার একমাত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এসব রাজ্যসমূহের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অখণ্ড ভারতে একীভূত রাখাও ভারতের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে রাখতেও তার বাংলাদেশকে প্রয়োজন। ভারতের ব্যাপারে চীন–বাংলাদেশকে অন্তত নিষ্ক্রিয় রাখার আশা হয়ত পোষণ করে।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তি কারো কাছেই আজ বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুষ্ঠূ নির্বাচন অনুষ্ঠান বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তারা বাংলাদেশকে তাদের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যবহার করছে ও করতে চায়, যা কিছু নেয়া সম্ভব নিচ্ছে ও নিতে চায়। অতীতে এতো কিছু দেখা না গেলেও সাম্প্রতিক ইতিহাসতার ব্যতিক্রম। ২০১৮ সালের মে মাসে ভারত সফর শেষে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন–উত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে’ । এর আগে ভারতের আনন্দ বাজার পত্রিকা ‘বাংলাদেশ ভারতের কাছে প্রতিদান চায়’ শীর্ষক প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে একজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, ‘আপনি কোন প্রতিদান চেয়েছেন কিনা? চাইলে কোনও আশ্বাস পেয়েছেন কিনা।জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কোনও প্রতিদান চাই না।প্রতিদানের কী আছে? আর কারও কাছে পাওয়ার অভ্যাস আমার কম। দেওয়ার অভ্যাস বেশি।’
কিছুদিন পূর্বে অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইস্ট এশিয়া ফোরাম ‘চায়না এন্ড ইন্ডিয়া‘স জিওপলিটিক্যাল টাগ অব ওয়ার ফর বাংলাদেশ‘ । অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ নিয়ে চীন এবং ভারতের ভূ–রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যুদ্ধ‘ নামে একটি নিবন্দ্ব প্রকাশ করে। আর নিউইয়র্কভিত্তিক ‘ওয়ার্ল্ড পলিসি রিভিউ‘ ঠিক এ বিষয়েই ‘উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারসের‘ একজন গবেষকের অভিমত প্রকাশ করে । লেখাটির শিরোণাম ছিল, হোয়াই ইন্ডিয়া এন্ড চায়না আর কম্পিটিং ফর বেটার টাইস উইথ বাংলাদেশ।” অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়তে কেন ভারত আর চীনের মধ্যে এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা?
এসব লেখাতে বাংলাদেশের সঙ্গে চীন এবং ভারতের সম্পর্ক, ব্যবসা–বাণিজ্য, নিরাপত্তা সহযোগিতা, বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন এবং দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য এই দুই বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের বিষয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ রয়েছে। এ নিয়ে বিবিসি বাংলার ‘কার অবস্থান কোথায়?’, ‘অবকাঠামো খাতে প্রতিযোগিতা‘, ‘আভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রশ্নে অবস্থান‘, ‘বাংলাদেশ যেভাবে খেলছে‘, ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাই শেষ কথা নয়‘, উপ শিরোনাম থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে চীন ও ভারতের মনোভাবকে অনেকটা উপলব্দি করা যায় ।
বাংলাদেশকে নিয়ে চীন এবং ভারতের প্রতিযোগিতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারসে‘র মাইকেল কুগেলম্যান তার পর্যবেক্ষণে বলেন, দুটি দেশ একই সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে। যুক্তরাষ্ট্রের উদাহারণ টেনে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের ঘনিষ্ঠতা বহু বছর ধরেই বাড়ছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বাধা হয়নি। মাইকেল কুগেলম্যান অবশ্য ভারত যে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রেখেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যিক, সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্বি করছে তা উল্লেখ করেননি।
তিনি মনে করেন যে, দিল্লি হয়তো এক সময় এই বাস্তবতা মেনে নেবে যে, ঢাকা অবশ্যই চীনের পুঁজি এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করবে। তাদের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে চাইবে। তবে এক্ষেত্রে ভারত হয়তো চাইবে চীন যেন কেবল অর্থনৈতিক খাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, তারা যেন বঙ্গোপসাগরে কোন ধরণের নৌ স্থাপনা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর না হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও দিল্লীকে এখনো প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। অনেকের ধারণা ভারতের ইশারাতেই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ চীন পায়নি। বরং সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করে জাপানকে পায়রা বন্দরের কাজ দেয়া হয়েছে।
আভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রশ্নে অবস্থান নিয়ে ‘ইস্ট এশিয়া ফোরামে‘ প্রকাশিত নিবন্ধে ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক মনে করেন, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসলে সেটা ভারতকে বিচলিত করবে। তাঁরা আরও বলছেন, এ বিষয়ে দিল্লির কৌশল একেবারেই স্বলমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা তাড়িত। তাদের কৌশলটা হচ্ছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখা, সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব ঠেকিয়ে দেয়া। অন্যদিকে বাংলাদেশে চীন খেলছে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য সামনে রেখে। তারা একদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। অন্যদিকে, এই দু’জনের ভাষায়, ‘ভারত বিরোধী এবং সেনাপন্থী‘ বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে তারা একটা ভারসাম্য রাখছে।
অনেক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বিমাতাসুলভও বটে । এটা হয়তো তার নিজের বৃহত্তর স্বার্থেই করতে হয়। আর এজন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্বি ও মর্যাদাবান উত্থানে ভারত বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে । কারণ বাংলাদেশের মর্যাদাবান উত্থান ভারতের উত্তর–পূর্ব অঞ্চল এবং এর বাইরের রাজ্যসমূহে স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে আরো বেগবান করবে বলে ভারতশংকিত থাকতেও পারে ।
উপসংহার:
ভূ–রাজনীতির প্রতিযোগিতা ও সহযোগীতাকে কাজে লাগিয়ে কূটনীতিতে দর কষাকষির সুযোগ থাকে। যেনতেন উপায়ে ক্ষমতায় ঠিকে থাকার স্বার্থে নাকি জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে এই শক্তি কাজে লাগানো হবে সেটা অন্য বিষয় । বিশ্বায়নের এই যুগে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে শুধু পার্শ্ববর্তী দেশ নয়, গোটা দুনিয়ার সাথে অর্থনীতির সংযোগের প্রয়োজন রয়েছে। তবে তা আত্মমর্যাদাকে ভুলন্ঠিত করে নয়। পৃথিবীতে যারা আত্মমর্যাদা সমুন্নত রেখে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমরনীতিতে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে কাজ করছে তাদের অতীত ইতিহাস যে খুব মসৃণ ছিল, তা কিন্তু নয়। পাকিস্তানের কথাই ধরা যাক। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ সাহসিকতার স্বাক্ষর রাখতে না পারলে আজও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখতো তারা।
ব্রিটেন–ফ্রান্স, জার্মানি–ফ্রান্স, ব্রিটেন–আমেরিকা সভ্যতার সৃষ্টি থেকে এরকম শত শত উদাহরণ রয়েছে যারা একে অন্যের সাথে যুদ্ধ করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনিভাবে প্রতিটি জাতি ঐক্যবদ্ব হয়ে ত্যাগ স্বীকার করে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরেই একে অন্যের সাথে মর্যাদার ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে মাত্র । জানান দিতে হবে, বাংলাদেশ কারো করুণার পাত্র নয়। সশস্রযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জাতিকে যারা ‘খয়রাতি‘ বলে অবজ্ঞা করে তাদেরকে সম্মিলিতভাবে জবাব দিতে হবে। অন্যথায় সামনে আরো অনেক কিছু দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পপুলিস্ট ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ডামাডোলের বিপরীতে উদার গণতন্ত্র, সহনশীল ও মধ্যপন্থী রাজনীতির প্রতি এ অঞ্চলের জনগণ ও সুশীলসমাজকে ঐক্যবদ্ব হয়ে কাজ করা উচিত। গ্লোবাল বিশ্বে এখন একাচলার অবকাশ নেই। পার্শ্ববর্তী বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতের সাথে মর্যাদাপূর্ণ ভারসাম্যের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতেই পারে । একবিংশ শতকের আধুনিক দুনিয়ায় বন্ধুত্বকে জোরদার করতে হবে ন্যায্য হিস্যা দেয়া–নেয়ার ভিত্তিতে। অন্য কোন রাস্তা খোলা নেই এখানে। শুধু দেয়ার অভ্যাস থাকলে ন্যায্য হিস্যা পাওয়া যায় না। আর ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে প্রয়োজন আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতা। অন্যথায় শুধু দিয়েই যেতে হয়। কারণ সমর শক্তির চেয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতির শক্তি অনেক বেশি।
আমরা যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে থাকাই তাহলে দু‘একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দেখতে পাই যে, প্রধানত দুটি বা তিনটি রাজনৈতিক দল পালাক্রমে দেশ শাসন করে আসছে। এক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়া ও মর্যাদার আসনে উন্নীত করা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ক্রমান্বয়ে জবাবদিহিতার কাঠামোতে নিয়ে আসতে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এক ধরনের ‘লিভ এন্ড লেট লিভ‘র সমঝোতা থাকা চাই। যাতে সুযোগ সন্ধানীরা রাজনীতিকদের ক্ষমতাপ্রীতি ও দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ নিয়ে যাচ্ছে তাই খেলা করতে না পারে। আর এতে করেই রাষ্ট্র পেতে পারে একটি আত্মমর্যাদাবান ও অগ্রসর জাতি আর জনগণ পাবে একটি কল্যাণকর মানবিক রাষ্ট্র ।
তবে আঞ্চলিক ও বিশ্ব শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যখন নিজেদের ক্ষমতাবৃদ্ধির লড়াইয়ে মগ্ন থাকে, তখন গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার, দুর্নীতি, আইনের শাসনের মতো মৌলিক বিষয়গুলো গৌণ হয়ে পরে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক শক্তির উচিত বাকসর্বস্ব রাজনীতির বিপরীতে মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতির চর্চা এবং গণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে নিজ দেশের জনগণকে অনুপ্রাণিত করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্ভুদ্ধ করা । এটাই একমাত্র রাস্তা। এখানে কোনো কিন্তু নাই। অতীত ইতিহাস ঘাটলে এর অজস্র উদাহরণ পাওয়া যায়। আর অতি সাম্প্ৰতিক বালির অভ্যুত্থান, বেলারুশের জনআন্দোলন তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
পরিশেষে বলা যায়, অন্য দেশের সাথে দেয়া–নেয়ার মর্যাদা ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক নির্ভর করে সরকারের প্রজ্ঞা ও জনগণের প্রতিদায় ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার উপর। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমালে চলে না। দেশের গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ সর্বোপরি জনগণেরও নিজের প্রাপ্য আদায়ে সচেতন ও সোচ্চার হওয়া জরুরি । ঘটনার সাক্ষী হয়ে শুধু পর্যালোচনা নয়, যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক মহল বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মনে করেন যে, বাংলাদেশ সরকার দেশের কৌশলগত অবস্থান ও ভূ–রাজনৈতিক গুরুত্বের প্রতি আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তি সমূহের আগ্রহ ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সুবিবেচনার পরিচয় দেবে। এটাই সর্বতোভাবে কাঙ্খিত । চলবে।
লেখক: ডক্টর এম মুজিবুর রহমান। সংবাদ বিশ্লেষক, সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ওপ্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট।
লন্ডন, ১৯ অগাস্ট ২০২০ ।