নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে জিতেছে ২৫৭টি আসনে, জাতীয় পার্টি জিতেছে ২২টি আসনে এবং মহাজোটের অন্য শরিকেরা ৯টি আসনে। ভোটের হিসাবে মহাজোট ও তার শরিকেরা পেয়েছে মোট প্রদত্ত ভোটের ৭৫ শতাংশ (প্রথম আলো, ২ জানুয়ারি ২০১৯)। অর্থাৎ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের মহাবিজয় অর্জিত হয়েছে।
অপরদিকে নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক দল বিএনপি জিতেছে পাঁচটি আসনে এবং গণফোরাম দুটি আসনে। ভোটের হিসাবে ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছে মোট প্রদত্ত ভোটের মাত্র ১২-১৫ শতাংশ (প্রথম আলো, ২ জানুয়ারি ২০১৯)। ঐক্যফ্রন্টের অনেক প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী। অর্থাৎ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের মহাপরাজয় ঘটেছে, যদিও অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে ও বিরাজমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ ফলাফল ছিল অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক। আর এ অস্বাভাবিক ফলাফল দলমত-নির্বিশেষে অনেক নাগরিকের মনে একধরনের অস্বস্তির উদ্রেক করেছে।
নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমে, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন বেরিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ইভিএমের মাধ্যমে নেওয়া আসনগুলোর তুলনায় অন্যান্য আসনের ভোট পড়ার হারের তফাত নিয়ে। বিদেশি গণমাধ্যম ও আমাদের উন্নয়ন–সহযোগী অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র এসব অনিয়ম নিয়ে বেশ সোচ্চার। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে একটি সুষ্ঠু তদন্ত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ উঠলে তদন্ত সাপেক্ষে নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করার ÿক্ষমতাও কমিশনের রয়েছে (নূর হোসেন বনাম নজরুল ইসলাম, [৫ বিএলসি (এডি) ২০০০])।
মহাজোটের মহাজয় ও ঐক্যফ্রন্টের মহাপরাজয় আমাদের মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যদি উভয় জোটই এই অস্বাভাবিক ফলাফল ও এর পরিণতির একটি নির্মোহ পর্যালোচনা না করে এবং তা থেকে শিক্ষা না নেয়। বিশেষ করে তারা যদি পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘উইল অব দ্য পিপল’ বা জনসম্মতির ভিত্তিতে ক্ষমতার রদবদলের সুযোগ তৈরি না করে। তা না হলে বাঘের পিঠের সমতুল্য ক্ষমতার মসনদে যাঁরা একবার আসীন হবেন বা হয়েছেন, তাঁরা সে আসন থেকে আর নামতে চাইবেন না—তাঁদের পক্ষে নামা সম্ভবও হবে না—ফলে মানুষের ভোটাধিকারের গ্যারান্টিও নিশ্চিত হবে না। আর মানুষের ভোটের অধিকার এবং তার মাধ্যমে ক্ষমতা রদবদলের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে অনিয়মতান্ত্রিক ও অস্বাভাবিকভাবে তা ঘটার আশঙ্কা দেখা দেবে, যা কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাই জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আজ আমাদের রাজনীতির শান্ত মস্তিষ্কগুলোকে ধৈর্য, সহ্য ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সামনে পা ফেলতে হবে, যাতে আমরা বিরাজমান অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং ক্ষমতার রদবদল-সম্পর্কিত ভবিষ্যতের অনিয়মতান্ত্রিকতা এড়াতে পারি।
ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অনিয়মতান্ত্রিকতা এড়াতে হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই—যিনি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেন—অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। পদক্ষেপ নিতে হবে অনেকগুলো সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের। বস্তুত তাঁর সামনে একটি ঐতিহাসিক সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে আমাদের জন্য একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ সৃষ্টির পথরেখা রচনা করার নেতৃত্ব প্রদর্শনের।
গত ৩১ ডিসেম্বর একদল নির্বাচন পর্যবেক্ষকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি সব নাগরিকের প্রধানমন্ত্রী হতে চান। তিনি সবাইকে নিয়ে সামনে এগোতে চান। স্মরণ করা যেতে পারে যে এখন থেকে ঠিক ১০ বছর আগে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করার পরও, ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে তিনি একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিলেন—আমাদের সরকার হবে সবার এবং আমরা ক্ষমতার অপব্যবহার করব না। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। হানাহানির রাজনীতি পরিহার করতে চাই। দেশে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি উপহার দিতে চাই…বিরোধী দলকে আমরা সংখ্যা দিয়ে বিচার করব না…যেহেতু বিজয় অর্জন করেছি, তাই সবকিছু ÿক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। আসুন, সব ভেদাভেদ ভুলে দেশের মানুষের জন্য একসঙ্গে কাজ করি। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলও রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদার। বিরোধী দলের ইতিবাচক সমালোচনা, পরামর্শ এবং সংসদকে কার্যকর করতে তাদের ভূমিকা ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখব।’ (প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি ২০০৯)।
১০ বছর আগে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার মতো পরিস্থিতি বিরাজ না করলেও এবং তা সম্ভব না হলেও, আজ তার সময় এসেছে। ইতিহাসের পাতায় তিনি কীভাবে নিজেকে দেখতে চান, সে বিবেচনায়। তাই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটানোর নেতৃত্ব শেখ হাসিনাকেই দিতে হবে—বল আজ তাঁরই কোর্টে।
তবে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে নতুন ধরনের রাজনীতির চর্চা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীকে শুরু করতে হবে। এ রাজনীতি হতে হবে অসাম্প্রদায়িকতার ও ‘প্লুরালিজম’ বা বহুত্ববাদের রাজনীতি, যা আমাদের ‘ফাউন্ডিং প্রিন্সিপল’ বা বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল চেতনার অংশ। আর এই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে আজ জরুরি ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধের দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ এবং বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে, যাতে আমাদের জাতীয় জীবনের এ গভীর ক্ষতকে আমরা চিরতরে দূর করতে পারি। আর যাতে জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের মতো মৌলবাদী প্রতিপক্ষকেও নিয়ে আর আমাদের খেলায় মত্ত না হতে হয়।
একই সঙ্গে এ পরিবর্তিত রাজনীতি হবে অন্তর্ভুক্তকরণের রাজনীতি। নিশ্চিহ্ন করার পরিবর্তে সম্প্রীতির রাজনীতি। কিছু বিপথগামী ছাড়া ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হওয়া সত্ত্বেও আজ আমরা একটি চরম বিভক্ত, পরস্পরের সঙ্গে অনেকটা ‘যুদ্ধে’ লিপ্ত জাতিতে পরিণত হয়ে পড়েছি—রাজনৈতিক কারণে একে অপরকে খতম করার রাজনীতিতে যেন মত্ত হয়ে গিয়েছি, যা জাতির জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ফলে আমাদের সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রাজনীতি চর্চা করতে হবে, আর বর্তমান বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীকেই এর নেতৃত্ব দিতে হবে।
বস্তুত প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে এক ‘গ্র্যান্ড কম্প্রোমাইজ’ বা মহাসমঝোতায় পৌঁছার কথা ভাবতে হবে, যে সমঝোতার অংশ হতে হবে কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কার এবং এর লক্ষ্য হবে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ে শিক্ষার্থীদের উত্থাপিত ও বহু কাঙ্ক্ষিত ‘রাষ্ট্রের মেরামত’। এ মেরামতের সুস্পষ্ট অর্জন হতে হবে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ, তাদের অধিকারের সম্প্রসারণ, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অবসান ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিতকরণ। তাহলেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে ও আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পথও সুগম হবে।
একটি গ্র্যান্ড কম্প্রোমাইজ অর্জনের লক্ষ্যে চতুর্থবারের মতো শপথ নেওয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার সামনে আজ যেসব করণীয়, সেগুলো সহজসাধ্য নয়। এতে ঝুঁকিও রয়েছে। ভেতর-বাহির থেকে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিরোধিতার আশঙ্কাও একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর পক্ষ থেকে প্রয়োজন হবে অসামান্য সহনশীলতা , প্রজ্ঞা ও অসম সাহসিকতা।