ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: মাদকের মাফিয়া ডন মধুসুদন। শ্রীলংকার এই নাগরিক দুবাইতে বসে হেরোইন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। পশ্চিমা বিশ্বে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে হেরোইন পাচারের মধুসদন। শ্রীলংকার সরকার দুবাই থেকে তাকে দেশে আনার বহু চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি।
সম্প্রতি দুবাই পুলিশ নগদ ১শ’ কোটি দিরহামসহ মধুসুদনকে গ্রেফতার করেছে। তবে তার শতাধিক বাহক এখনো কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলংকা, চীন ও ভারত এই ছয় দেশে তার বেতনভুক্ত বাহক আছেন শতাধিক।
মধুসুদনের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে আরিফ ও শেখ সুমনের। আরিফ বাংলাদেশি এবং শেখ সুমনের নাগরিকত্ব নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। সে পাকিস্তানের নাগরিক, কিন্তু বাংলাদেশের পাসপোর্ট দুবাই ব্যবহার করছে। হেরোইন বহনকারীদের নিয়োগ দেওয়ার দায়িত্বও তারা পালন করছেন। গত জানুয়ারি মাসে শ্রীলংকার পুলিশ বাংলাদেশি নাগরিক সূর্য মনি, মো. রাফিউল ইসলাম ও মো. জামাল উদ্দিনকে আটক করে। তাদের কাছ থেকেও হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।
এদিকে শ্রীলংকার পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব ও সিআইডি হেরোইন চোরাচালানে সম্পৃক্ত বাংলাদেশের সাত জনকে গ্রেফতার করেছে। শ্রীলংকার পুলিশ ব্যুরো অব নারকোটিকস’র (পিএনবি) দুই শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসে গ্রেফতারকৃত ওই সাত জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা পুলিশ সদর দপ্তর, র্যাব ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) পুলিশের ডিআইজি মাসুম রাব্বানি জানান, হেরোইন পাচারের জন্য বাংলাদেশ একটি রুট হিসেবে দাবি করেছে শ্রীলংকা। এটা সঠিক নয়। হেরোইন পাচারে বাংলাদেশ কোন রুট নয়। তবে এদেশের কিছু মানুষ পাচারে বাহক হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা হলো হেরোইন পাচারের প্রধান রুট। শ্রীলংকার দুই ভাগ মানুষ হেরোইনে আসক্ত।
আফগানিস্তান মূলত হেরাইন উত্পাদনের দেশ। সেখান থেকে পাকিস্তান হয়ে শ্রীলংকায় হেরোইনের চালান যায়। শ্রীলংকা থেকে মধুসুদনের চালান পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যায় বলে তিনি জানান।
জানা গেছে, গত ১৪ ডিসেম্বর শ্রীলংকান পিএনবি’র সার্ভিলেন্স টিমের সদস্যরা বাংলাদেশি নাগরিক সূর্য মনিকে অনুসরণ করতে শুরু করেন। ১৫ ডিসেম্বর কলম্বোর মাউন্ট লাভিয়ানা এলাকার রাস্তা থেকে কেকের বক্সে রাখা ১ কেজি হেরোইনসহ তাকে আটক করে। পরে তার দেয়া তথ্য মতে, কলম্বোর লাভিয়ানা এলাকার যে বাসায় সূর্য মনি বসবাস করতো, সেই বাসা এবং সূর্য মনির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী একই এলাকার অন্য একটি বাসা থেকে তার উপস্থিতিতে আরো ৩১ কেজি হেরোইন উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে গত ৩১ ডিসেম্বর কলম্বোর উপকণ্ঠে মাউন্ট লাভিয়ানায় একটি বহুতল ভবন থেকে ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ার সময় শ্রীলংকার পিএনবি’র সদস্যরা বাংলাদেশি নাগরিক মো. রাফিউল ইসলাম এবং মো. জামাল উদ্দিনকে ৯ কেজি হেরাইনসহ আটক করে।
আটককৃত রাফিউল ইসলামের কাছে একটি রিমোট কন্ট্রোল চাবি পাওয়া যায়। ঐ চাবি একই এলাকায় অবস্থিত অন্য একটি বাসার বলে রাফিউল শ্রীলংকার পুলিশকে জানান। ঐ একতলা বাসা তল্লাশি করে শ্রীলংকান পিএনবি’র সদস্যরা রুমের মধ্যে ব্যাগে ও ছড়ানো ছিটানো থাকা প্যাকেটজাত আর ২৬৩ কেজি হেরোইন ও ৫ কেজি কোকেন উদ্ধার করে।
শ্রীলংকার পিএনবি’র সদস্যরা লাভিয়ানা এলকায় ৪টি বাসা থেকে মোট ৩০২ কেজি ৩০ গ্রাম হেরোইন ও ০৫.২৯৮ কেজি কোকেন উদ্ধার এবং উপরোক্ত তিন বাংলাদেশিকে আটক করে।
এদিকে আটককৃত বাংলাদেশিদের জিজ্ঞাসাবাদ, শ্রীলংকান কর্তৃপক্ষের সাথে তদন্ত দলের মতবিনিময় এবং পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশনের তথ্যাদি পর্যালোচনা করে তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে সন্দেহভাজন চক্রকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
তাদের কথোপকথনের সূত্র ধরে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে আরিফ, শারমনি আক্তার মায়া এবং তাদের অন্যতম সহযোগী পাকিস্তানি শেখ সুমন দুবাইয়ে অবস্থান করার বিষয়টি তারা নিশ্চিত হয়। দুবাই ভিত্তিক এককটি শক্তিশালী মাদক ব্যবসায়ী চক্র এ কাজ সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে আসছে।
শ্রীলংকার পুলিশের আইজিপি সেদেশের একজন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী মধুসুদন দুবাইয়ে বসে মাদক ব্যবসা করছে মর্মে মত ব্যক্ত করেছেন, যাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।
শ্রীলংকায় আটককৃত মাদকের চোরাচালান কোনভাবেই বাংলাদেশ দিয়ে হয়নি যেমন সত্য, তেমনি এ চক্রের সাথে চীনের গুয়াংজু, কুয়ালালামপুর এবং দুবাইয়ের সম্পর্ক রয়েছে। এসব স্থানে বাংলাদেশিদের সাথে অন্য দেশের নাগরিকদের সম্পৃক্ততার আলামত পাওয়া যায়। বিশেষ করে চীনে আটক হওয়া বাংলাদেশি রায়হানা আক্তার, রোমানা রশিদ আলীকে জিজ্ঞাবাবাদ, দুবাইয়ে অবস্থানরত আরিফ, শারমিন আক্তার মায়া, অন্যতম সন্দেহভাজন শেখ সুমনের বিষয়ে দুবাই কর্তৃপক্ষ বা কিভাবে শেখ সুমন দুবাইয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট গ্রহণ করেছে, সেই বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময়য়ের আবশ্যকতা রয়েছে বলে শ্রীলংকার আইজিপি জানান।
অপরদিকে সিআইডির তদন্তে এবং আটককৃত আসামী চয়েস রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদে বাংলাদেশে আরো একাধিক ব্যক্তির এ মাদক চক্রে জড়িত থাকার তথ্য এসেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্যানুসন্ধান চলছে। র্যাবের পক্ষ থেকে এই চক্রে জড়িত ফতেমা ইমাম (২৯), আফসানা মিম (২৩), সালমা সুলতানা (২৯), শেখ মোহাম্মদ বাধন পারভেজ (২৮) ও রুহুল আমিনকে (২৯) গ্রেফতার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন মোতাবেক উত্তরা থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে কেউ যাতে অন্য দেশে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য এসবির পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ইউনিটকে অবহিত ও সতর্ক করা হয়েছে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে আরিফের সাথে দেশে তার আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু মহলের যোগাযোগ থাকার তথ্য এসেছে। ইতিপূর্বে পালিয়ে যাওয়া অন্যতম সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী আরিফের পক্ষে আইয়ুব নামক ব্যক্তি তার উত্তরার ভাড়াকৃত বাসার মাসিক ভাড়া পরিশোধ করেছে। ধারনা করা হচ্ছে আইয়ুবের সাথে আরিফের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের গতিবিধি জানার চেষ্টা চলছে।
শ্রীলংকার পিএনবি জানায়, তারা এ ঘটনায় সেদেশের কাউকে এখন পর্যন্ত আটক করতে পারেনি। কেবলমাত্র শ্রীলংকার একজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে সনাক্ত করে তাকে আটকের চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের আটককৃত তিন জন ছাড়াও শাহিনা আক্তার নামে এক নারীর বিরুদ্ধে লাভিয়ানার কোর্ট কর্তৃক ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়েছে। আফসানা মীম নামক অন্য একজন বাংলাদেশী নারীকেও ঘটনায় জড়িত রয়েছে তারা সন্দেহ করেছে।