ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে অনেকেই মার্ক্সবাদেরও পতনের সম্পর্ক খোঁজে পান। রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে মার্ক্সবাদ ব্যর্থ হয়েছে—এমনটাই অনেকে মনে করেন। কার্যত কমিউনিজম সোভিয়েত রাশিয়ায় একধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের সৃষ্টি করেছিল। সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় ভরপুর। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন? পূর্ব ইউরোপজুড়েই তো কমিউনিজমের পতন হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। কমিউনিজমের তথাকথিত পতনের পর পুঁজিবাদই একমাত্র সমাধান হয়ে এল সবার সামনে। কমবেশি বলা হতে থাকল, ইতিহাসের পাতা থেকে কমিউনিজম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
কিন্তু কমিউনিজমের পতনের পর যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ইউরোপ প্রবেশ করল, এর ফলাফল হিসেবে বিশ্ব কী পেল? বৈশ্বিক রাজনীতি থেকে কমিউনিজম পতনের প্রায় ২০ বছরের মধ্যেই ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার অভিজ্ঞতা হলো সবার। কৃচ্ছ্র সাধনের নামে ইউরোপের দেশে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সুযোগ-সুবিধা হ্রাস করা হলো। বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেল। পৃথিবীর ১ শতাংশ মানুষের হাতে সিংহভাগ সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। বিস্ময়করভাবে এই মন্দার মধ্য দিয়েই গ্রিস, স্পেন ও যুক্তরাজ্যে মার্ক্সবাদী চিন্তাধারা আবারও মূলধারার রাজনীতিতে জায়গা করে নিচ্ছে। মার্ক্সবাদের ফিরে আসার অকল্পনীয় চিন্তা এখন আর অচিন্তনীয় নয়।
মার্ক্সের জন্মদিন ৫ মে। ২০০তম জন্মবার্ষিকী। ফেব্রুয়ারি মাসে কার্ল মার্ক্সের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো প্রকাশের ১৭০ বছর পালন করা হয়েছে। মার্ক্সের জন্মদিনে ইউরোপের সাম্প্রতিক রাজনীতির গতিধারা, নির্বাচনে লোকরঞ্জনবাদীদের উত্থান ঘিরে রাজনৈতিক দার্শনিকদের মধ্যে ঘুরে-ফিরে আলোচনা হচ্ছে, মার্ক্সবাদ কি আবারও ইউরোপের রাজনীতিতে পূর্ণ শক্তিতে ফিরে আসবে? যদি ফিরে আসে, কীভাবে আসবে? কারণ, পশ্চিম ইউরোপে বামপন্থীদের অনেক কর্মসূচি দখল করেই লোকরঞ্জনবাদীরা ভোটারদের আকৃষ্ট করছে। ইউরোপের বামপন্থীরা অনেকটাই নিজেদের কর্মসূচি থেকে সরে গিয়ে পুঁজিবাদের প্রতি অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। বাম ও মধ্যবাম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা বিবর্তিত পুঁজির বিকাশ ও শ্রমব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি।
গত শতকে মূলত দুই ধরনের বামপন্থা বা মার্ক্সবাদী রাজনীতি দেখা যায়। এক দিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ, চীন বা উত্তর কোরিয়ার কমিউনিজম, অন্যদিকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে কখনোই বামপন্থী, কমিউনিস্ট রাষ্ট্র বলে অভিহিত করা হয় না। কিন্তু স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো এবং জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপের অনেক দেশেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোতে মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষ করা যায়।
মূলত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ, চীন বা উত্তর কোরিয়ার কমিউনিজমের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিস্তর ফারাক রয়েছে। পশ্চিম ইউরোপ বাদে উল্লেখিত দেশগুলোয় কমিউনিজম শাসনের নামে কার্যত এক ব্যক্তির একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল। মার্ক্সবাদের নামে কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক সমাজ গঠন করা হয়েছিল এসব দেশে। চীন আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কাঠামোগতভাবে পৃথক ছিল। বরং বলা যায়, চীন পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্য থেকেই কমিউনিস্ট শাসনের নামে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে আজীবন প্রেসিডেন্ট ঘোষণার মধ্য নিয়ে এখন আবার এক ব্যক্তির শাসন কায়েম করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, মার্ক্স নিজেই কমিউনিজম নিয়ে বিশদ কোনো রূপরেখার বিষয়ে আলোচনা করেননি। বরং মার্ক্স পুঁজির সমালোচনা করেছেন। মার্ক্স বিশ্বাস করতেন, নিজস্ব ত্রুটির কারণে পুঁজিবাদ নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে দেবে। সাম্প্রতিক মন্দাই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ, চীন বা উত্তর কোরিয়ার কমিউনিজমের বিপরীতের পশ্চিম ইউরোপের মার্ক্সবাদী রাজনীতি ছিল ভিন্ন। এসব দেশে সোশ্যালিস্টরা সর্বতোভাবে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে অনুসরণ করেননি; বরং রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত একধরনের উদার অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রবর্তন করেছিল, যা রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। আমরা যদি পুঁজির সমালোচনা ও উৎপাদনব্যবস্থার ওপর সমাজের মালিকানা নিশ্চিত করাকে মার্ক্সীয় চিন্তার দুটি মূল উপাদান ভাবি, তবে দেখব পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। পুঁজির ওপর পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় মালিকানা বজায় রাখেনি। আবার উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থায় মোটামুটি সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে। অভ্যন্তরীণ নীতি ছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষ করে ইউরোপের রাজনীতিতে এসব দেশ মার্ক্সবাদী ‘কমন গোল’ বা গণলক্ষ্যকে ভিত্তি করেই নীতি গ্রহণ করেছে। সেই গণলক্ষ্য বাস্তবায়নেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভিন্ন দেশের মধ্যে একই শ্রমবাজার প্রতিষ্ঠায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের গঠনে মার্ক্সবাদী নীতিই প্রতিফলিত হয়। এসব কারণেই পশ্চিম ইউরোপে মধ্যবাম সোশ্যালিস্টরা জনপ্রিয়তা অর্জন করে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিল। এবং রাজনীতিতে সোশ্যালিস্টদের প্রভাব দীর্ঘ সময় ধরেই ছিল।
মন্দার কারণে ইউরোপের বাম ও মধ্যবামরা ঝাঁকুনি খেলেও রাজনৈতিকভাবে আবারও ফিরে আসছে। মজার বিষয় হচ্ছে শৌখিন বামপন্থী দলগুলোর থেকে অধিক জনসমর্থনপুষ্ট বড় দলগুলোও মার্ক্সবাদকে গ্রহণ করছে। যেমন ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনসহ অনেকই মার্ক্সকে উদ্ধৃত করছেন। গ্রিসে বামপন্থী সিরিজা পার্টি তো সরকারই গঠন করেছে। আর পশ্চিম ইউরোপের মধ্যবামরা অনেক দিনই সরকারেই ছিল।
পরিশেষে কার্ল মার্ক্সের ২০০তম জন্মবার্ষিকীতে বলা যায়, কিছু দেশে প্রায়োগিক ত্রুটির কারণে মার্ক্সবাদ ব্যর্থ হয়েছে বলা সমীচীন নয়। আর ৭০ থেকে ৮০ বছরের হিসাবে কোনো রাজনৈতিক তত্ত্বকে পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়াও যুক্তিযুক্ত নয়। ইতিহাসের ধাপগুলো অনেক লম্বা হয়। আর এই লম্বা ধাপে সামাজিক গঠন ও পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দর্শন ও তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। তাই পুরোপুরি না হলেও মার্ক্সের দর্শন-প্রভাবিত রাজনীতি যে আবারও ইউরোপের রাজনীতিতে মন্দা-উত্তর পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন মাধ্যমে ফিরে আসছে, এর নিদর্শন স্পষ্ট।
ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি।