ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই একটি বিতর্ক দানা বাধে যে, সকলের কি মাস্ক পরার প্রয়োজন আছে? সবাই যদি মাস্ক পরে তাহলে কি করোনার সংক্রমণের গতি বা তীব্রতা হ্রাস পাবে?
শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উত্তরে বলে আসছিল: না, মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই। সংস্থাটি বলছিল, অসুস্থ রোগী, স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা কর্মীদেরই কেবল মাস্ক পরা উচিত। যারা সুস্থ আছেন তাদের মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই।
সরকারিভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই পরামর্শই মেনে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও সিঙ্গাপুর। এই দেশগুলো বেশি বেশি হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদেরই মাস্ক প্রয়োজন বেশি। ১০ দিন আগেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি স্বাস্থ্য প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক ডা. মাইক রায়ান বলেছিলেন, “গণহারে মাস্ক পরলে কোনো উপকার পাওয়া যায় বলে নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।”
কিন্তু চলতি সপ্তাহেই সব পাল্টে গেছে। শুক্রবার প্রকাশ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ থেকে সরে আসে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুর। দেশ দু’টি নাগরিকদের পরামর্শ দেয়, ঘর থেকে বের হলে যেন তারা মাস্ক পরেন।
সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টে ফেলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। মাইক রায়ানই বললেন যে, “আমরা স্পষ্টভাবে এমন কিছু ঘটনা দেখতে পেয়েছি যে, কমিউনিটি পর্যায়ে বাড়িতে বানানো বা কাপড়ের মাস্ক পরলেও সামগ্রিকভাবে এই রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হয়।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই অবস্থান পরিবর্তনের নেপথ্যে যে বিষয়টি কাজ করেছে তা হলো, ক্রমেই এটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কিছু মানুষের লক্ষণই দেখা যায় না। ফলে নিজের অজ্ঞাতেই তারা অন্যদের অসুস্থ করে তুলতে পারেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পও বলেছেন, আমেরিকানদের এখন বাইরে গেলে “নন-মেডিকেল” কাপড়ের তৈরি মুখবন্ধনী ব্যবহার করতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। শুক্রবার অবধি যুক্তরাষ্ট্রে ২ লাখ ৪৫ হাজার নিশ্চিত রোগী পাওয়া গেছে। মারা গেছেন ৬ হাজারেরও বেশি। অবশ্য ট্রাম্প এ-ও বলেছেন যে, মাস্ক পরার বিষয়টি বাধ্যতামূলক কিছু নয়। তার নিজেরও মাস্ক পরার সম্ভাবনা কম।
তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান পরিবর্তনকে আশ্চর্য্যজনকই বলতে হবে। এই সেদিনও যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল জেরেওম অ্যাডামস টুইট করে বলেছেন, “মাস্ক কেনা বন্ধ করুন! আমি সিরিয়াসলি বলছি। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে মাস্ক আপনাকে রক্ষা করবে না। কিন্তু অসুস্থ রোগীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা যদি পর্যাপ্ত মাস্ক না পেয়ে থাকেন, তাহলে তারা ও আমরা সকলে ঝুঁকিতে পড়বো।”
সিঙ্গাপুরও নাগরিকদের মাস্ক না পরার পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু দেশটির নিশ্চিত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার পার হওয়ার পর অবস্থান পরিবর্তন করেছে। রোববার থেকে দেশটি সকল বাড়িতে পুনঃব্যবহারযোগ্য মাস্ক সরবরাহ করবে।
এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ হলো, কভিড-১৯ আক্রান্ত অনেকের খোঁজ পাওয়া গেছে, যাদের সংক্রমণের সূত্র জানা যায়নি। অর্থাৎ কীভাবে বা কার কাছ থেকে তারা ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছেন তা জানা যায়নি। এছাড়া নতুন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, কিছু রোগীর মধ্যে রোগের কোনো উপসর্গই দেখা যায় না। এ সকল কারণেই সিঙ্গাপুর সকলকে মাস্ক পরার পরামর্শ দিচ্ছে।
মাস্ক কিন্তু ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে না। কিন্তু কেউ যদি মাস্ক পরেন, আর তিনি যদি আক্রান্ত হন, তাহলে তার কাছ থেকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। মাস্ক এজন্য পরতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে যেন, উপসর্গহীন রোগীরা নিজের অজ্ঞাতে রোগ না ছড়াতে পারেন। সকলে মাস্ক পরলে উপসর্গবিহীন রোগীরাও পরবেন। ফলে তাদের কাছ থেকে ছড়ানোর হার কমে যাবে।
আরেকটি বিষয় হলো, ইতালি ও স্পেনের মতো দেশে যেখানে আক্রান্ত ও মৃতের হার ভয়াবহভাবে বেড়েছে, কিছু দেশে ভাইরাসের গতি কমেছে। হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে প্রায় সকলেই বাইরে বের হলে মাস্ক পরেছেন। ইউরোপের মধ্যে চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়াও সকলকে মাস্ক পরতে বলা হয়েছে। এসব দেশে ভাইরাসের গতি ঠিকই হ্রাস পেয়েছে, কিংবা বেশি ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং-এর সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডেভিড হুই শু-চেওং বলেন, “সামাজিক দূরত্ব ও হাত পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সার্বজনীন মাস্ক পরিধান কভিড-১৯ রোগের বিস্তার ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।”
তবে হংকং-এর অধিবাসীদের মধ্যে মাস্ক পরিধানের ইতিহাস পুরোনো। ২০০৩ সালেই ভয়াবহ শ্বাসযন্ত্রীয় সিন্ড্রমের মহামারী হয় সেখানে। তখন থেকেই বাসিন্দারা মাস্ক পরতে অভ্যস্ত। এ কারণেই ৭৪ লাখ অধিবাসীর ছোট এই শহরে শুক্রবার পর্যন্ত আক্রান্ত পাওয়া গেছে মাত্র ৮৪৫ জন। মারা গেছেন মাত্র ৪ জন। চীনের এত নিকটবর্তী হওয়া ও আন্তর্জাতিক বিমান যোগাযোগের অন্যতম বৈশ্বিক কেন্দ্রবিন্দু হওয়া সত্ত্বেও সেখানে ভাইরাস খুব ভয়াবহ হতে পারেনি।
ইউরোপে চেক রিপাবলিকে প্রথম প্রকাশ্যে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। দেশটি বলছে এ কারণেই সেখানে আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। সোমবার অস্ট্রিয়াও সুপারমার্কেটে যেতে হলে মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করেছে। চ্যান্সেলর সেবাস্তিয়ান কার্জ বলেন, “আমি সম্পূর্ণ অবগত যে, মাস্ক আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। কিন্তু বড় ধরণের অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রয়োজন।”
এছাড়া সরাসরি রোগী ব্যবস্থাপনায় কর্মরত ডাক্তার ও গবেষকরা বলছেন, তারা এমন কিছু লক্ষণ পেয়েছেন যে, শুধু মুখ ও শ্বাসযন্ত্র দিয়েই এই ভাইরাস প্রবেশ করে না। নাক দিয়েও প্রবেশ করতে পারে। সেক্ষেত্রে শুধু নিজের কাছ থেকে ভাইরাস ছড়ানো নয়, ভাইরাসের প্রবেশ ঠেকাতেও মাস্ক উপকারী হতে পারে।
তবে বলে রাখা ভালো যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুর এখনও বলছে যে, সাধারণ মানুষকে কাপড়ের পুনর্ব্যবহারযোগ্য মাস্ক পরা উচিত। সার্জিক্যাল মাস্ক শুধু ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীদের জন্যই রেখে দেয়া হবে।
এ বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রশাসনে বেশ বিতর্ক হয়েছে। মঙ্গলবার ৩১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক ব্যাধি ইন্সটিটিউটের পরিচালক অ্যান্থনি ফাউচি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার এসে তিনি ইঙ্গিত দেন যে, মানুষকে মাস্ক পরতে বলা হবে। তিনি বলেন, “আমরা এখন জানছি যে, লক্ষণহীন ব্যক্তিরাই স্পষ্টতই সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন। তাই মাস্ক পরতে বলাটা যে খারাপ কিছু নয়, তা বোঝাই যাচ্ছে।” শুক্রবার সার্জন জেনারেল অ্যাডামসও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, কেউ হয়তো এই অবস্থান পরিবর্তন নিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারেন। তবে এর কারণ হলো, নতুন তথ্য পাওয়া গেছে লক্ষণহীন মানুষজনও সংক্রমণ ছড়াতে পারেন।