মাহবুব তালুকদারের ভিন্নমত

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরে নীতিনির্ধারণী–বিষয়ক মতভেদ বাংলাদেশ কিংবা উপমহাদেশের কোথাও বিরল নয়। যেটা বিরল হবে সেটা হলো, এ বিরোধে যদি রাজনৈতিক দলগুলো পক্ষ–বিপক্ষ নেয়। দলগুলোর উচিত হবে নির্বাচন কমিশনের বিরোধকে নিজেদের দলগত বিরোধীয় বিষয়ে কখনোই পরিণত না করা। বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভী ভুল তথ্য দিয়ে দাবি করেছেন, ‘মাস্টারপ্ল্যানের বিরোধিতা করায় সরকার মাহবুব তালুকদারের পদত্যাগ’ দাবি করেছে। অথচ সরকার তাঁর পদত্যাগের দাবি করেনি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কমিশনের মত–দ্বিমতকে ইসির ‘বিভক্তি’ হিসেবে দেখেছেন।

সুখের কথা, এ বিষয়ে ১৪–দলীয় জোটের মুখপাত্রের ভ্রান্ত অবস্থানের বিপরীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছেন। ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে গত বৃহস্পতিবার সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কার্যত স্পষ্ট করেন যে ভিন্নমতের কারণে কারও পদত্যাগ দাবি সমীচীন নয়। মাহবুব তালুকদারের পদত্যাগের দাবি আওয়ামী লীগের নয়। এখন আমরা কি আশা করব, আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অন্তত তাদের মিত্রদের কাছে রাখার কথা ভাববে? একজন নিরপেক্ষ টেকনোক্র্যাটের কাছেও এই দুটি মন্ত্রণালয়ের ভার দিতে প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার আছে।

১৫ অক্টোবর যে যুক্তি দেখিয়ে সিইসি এবং অপর তিন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে ইসির আনুষ্ঠানিক সভায় কথা বলতে দেননি, তা আইনানুগ বা যুক্তিসংগত কোনোটিই নয়। প্রায় এক মাস আগে ১৮ সেপ্টেম্বর মাহবুব তালুকদার আসন্ন সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা–বিষয়ক পাঁচ দফার বিষয়ে চিঠি দেন। ৮ অক্টোবর ইসি সচিবালয় তাঁকে চিঠি দিয়ে জানায় যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাঁকে ১৫ অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় সভায় ওই পাঁচ দফা তুলতে অনুরোধ করেছেন। এরপর ১০ ও ১১ অক্টোবর দুই দিনে তিন কমিশনার তিনটি আলাদা চিঠিতে অভিন্ন ভাষায় ‘অবিকল একই কারণ’ দেখিয়ে সিইসির সিদ্ধান্তে (সভায় পাঁচ দফা তুলতে দিতে) ভিন্নমত দেন। তিন চিঠিতে নির্দিষ্টভাবে শুধু তফসিলের পরে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে তাঁরা মত দিয়েছেন। বাকি চার দফা প্রস্তাবের বিষয়ে আপত্তির কারণ হিসেবে তাঁরা বলার চেষ্টা করেন যে কিছু বিষয় বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কিন্তু সেখানে তাঁরা কোন প্রস্তাবটি কোনো আইনের কোন ধারা কিংবা সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদকে আঘাত করে, তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলেননি। এ অস্পষ্টতা তিন কমিশনারের যুক্তির শক্তি নয়, দুর্বলতা নির্দেশক।

ভারতের পর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টও বলেছেন, ইসির সভার সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ঠিক হবে। সুপ্রিম কোর্ট এটা বলেননি, সংখ্যাগরিষ্ঠের জোর খাটিয়ে কোনো সভার আলোচ্যসূচির ভাগ্য নির্ধারণ করতে হবে।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আলোচ্যসূচি কী হবে, তা–ও আগাম ভোটাভুটির কবলে পড়েছে। এটা আবারও প্রমাণ করছে যে সংস্কৃতির অবনতি ঘটলে আইন–আদালত আমাদের বাঁচাতে পারবেন না। তিন কমিশনার বলেছেন, পাঁচ দফায় ‘রাজনৈতিক দলের’ মতের প্রতিফলন ঘটেছে। তার মানে তাঁরা কি স্বীকার করছেন যে তাঁরা তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিপরীত রাজনৈতিক মতের প্রতিনিধিত্ব করছেন?

মাহবুব তালুকদারের দাবি, তাঁর পাঁচ দফা প্রস্তাব তিনি ইসির সঙ্গে নির্বাচনী সংলাপে অংশগ্রহণকারী অংশীজনদের মতামত থেকেই আহরণ করেছেন। তার মানে তিনি এগুলো মানতে হবেই—এমন পণ করেননি। ওই সংলাপে আমন্ত্রিত হয়ে আমি আমার লিখিত বক্তৃতায় নির্বাচনকালে ইসির কাছে ওই দুটি মন্ত্রণালয় ন্যস্ত রাখতে মত দিয়েছিলাম। কারণ, আমরা মনে করি, দলীয় সরকারকে নির্দলীয় সরকারের বিকল্প করতে গেলে কিছু বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিকল্প এড়িয়ে, নিজেদের দলীয় তালিকাভুক্তদের ভেতর থেকেই সিইসিসহ সিংহভাগ কমিশনার নিয়োগ দিয়ে এবং এক শ ভাগ দলীয় নির্বাচনী সরকারের অধীনে নির্বাচন করার তোড়জোড় অবাধ নির্বাচনকামী আমজনতাকে হতাশায় রাখছে।

তাই মাহবুবের প্রস্তাবের বিষয়ে তিন কমিশনারের ওই ইঙ্গিত সত্য ধরে নিলেও আমরা মনে করি, মাহবুব তালুকদারের পাঁচ দফা সভায় তুলতে দিতে সিইসির আগের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। সিইসি যদি দাবি করেন তিনি ৩:১ ভোটে পরাস্ত হয়েছেন, তাহলে তা তাঁর নেতৃত্বের সক্ষমতা নয়, ভঙ্গুরতা স্পষ্ট করে। উপরন্তু মাহবুব তালুকদারকে আরেকটি চিঠি দিয়ে তাঁর পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত জানানো দরকার ছিল। ১৫ অক্টোবরের সভায় গিয়ে প্রস্তাব তুলতেই না দেওয়ার মৌখিক সিদ্ধান্ত গলাধঃকরণ তাঁর জন্য বিব্রতকর ছিল। কিন্তু তাই বলে আমরা তাঁর সভা বর্জনের সিদ্ধান্ত সমীচীন মনে করি না।

কারণ, এটি আমাদের বিরোধী দলের অনুসরণ করা সংসদ ও নির্বাচন বয়কট–সংস্কৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। বিদ্যমান প্রক্রিয়ার ভেতরে থেকেই লড়াইটা চালাতে হবে। বিএনপি নয়া ঐক্যফ্রন্টে অংশ নেওয়ার পরেও এই মৌলিক প্রশ্ন মীমাংসিত হয়নি যে আসন্ন নির্বাচনটি সর্বতোভাবে অংশগ্রহণমূলক হবে।

১৭ অক্টোবর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতির দপ্তরে অনুষ্ঠিত ১৪–দলীয় জোটের সভায় ওই তিন কমিশনারের প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানের সমর্থনে কার্যত সংহতি প্রকাশ করা হয়েছিল। এটা দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিজের কিংবা তিন কমিশনারের তথা নির্বাচন কমিশনের মর্যাদা বৃদ্ধি করেনি; বরং ভুল লিখতে ভুল লেখা হয়েছে। ভুলের বোঝা আরও বাড়ানো হয়েছে। এটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দলীয় হস্তক্ষেপের চেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হবে।

১৮ অক্টোবর ডেইলি স্টার–এর রিপোর্ট বলেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের সভায় মাহবুব তালুকদারের বিরুদ্ধে ‘গোপনীয়তার শপথ’ ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। মাহবুব তালুকদার তাঁর ভিন্নমত দ্রুত সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেছেন, এর পক্ষে–বিপক্ষে যুক্তিতর্ক হতে পারে। কিন্তু গোপনীয়তা শপথ ভঙ্গের অভিযোগ আনার সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। কারণ, গোপনীয়তার শপথ সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের অধীনে শুধু মন্ত্রিসভার সদস্যদেরই নিতে হয়। এটা অন্য সাংবিধানিক পদধারী কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই এ অভিযোগ তুলে মোহাম্মদ নাসিমের মুখে পদত্যাগের দাবি তোলা সমীচীন হয়নি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গোড়াতেই সতর্ক বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি সন্তোষজনকভাবে বলেছিলেন, ‘ভিন্নমত দেওয়ার অধিকার গণতান্ত্রিক। সিদ্ধান্ত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের মতো কমিশনের চলার সুযোগ নেই। ইসির কোনো সদস্যেরই ভেটো (মানি না) ক্ষমতা নেই।’

তবে সেতুমন্ত্রী এ কথা স্মরণ করাতে বিস্মৃত হননি যে মাহবুব তালুকদারকে বিএনপির দেওয়া তালিকা থেকে নেওয়া হয়েছিল। তাঁর এ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে এর অর্থ কি এই যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য তিন কমিশনার যে সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তালিকাভুক্ত থাকার কোনো প্রভাব পড়ে! ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৪–দলীয় জোটের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কঠিন সমালোচনা তাই আমাদের বিস্মিত করে। ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে একজন সাংবিধানিক পদধারীর পদত্যাগ চাইলেন আরেকজন সাংবিধানিক পদধারী। এটা কোনো রীতিনীতিতে পড়ে না।

১৯৭২ সালের সংবিধান বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো সাংবিধানিক সংস্থাগুলো সৃষ্টি করেছিল; সরকারি দলের মুখ রক্ষার জন্য নয়। বিরোধী দলকে দুর্বল করার জন্য নয়। বাক্স্বাধীনতা, বিচারপতিসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক পদের স্বাধীনতার যে ধারণা ও কার্যকারিতা, সেটার ঐতিহ্যগত
মাপকাঠি ক্ষমতাসীন সরকারের গুণকীর্তন বা বন্দনায় নয়, বরং সমালোচনায়।

সাংবাদিকদের কাছে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের পীড়াদায়ক প্রতিক্রিয়া তাঁর ব্যক্তিগত মত নয়, সিইসিসহ চার কমিশনারের মত। কবিতা খানম একটি সাংবিধানিক ব্যাখ্যা প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনকালে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখলে তা অবাধ নির্বাচনে বাধা তৈরি নাকি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করবে, সে বিষয়ে মত দেননি কবিতা খানম। এ দুটি মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনার ধারণাকে ‘অসাংবিধানিক’ দাবি করেছেন তিনি।

আমরা বিনয়ের সঙ্গে বলব, এটি একটি ভুল ব্যাখ্যা। কিন্তু ‘ভুল’ বিবেচনায় মতপ্রকাশের অধিকারের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। তিনি যা সাংবাদিকদের বলেছেন, একই কথা সভায় বলার সুযোগ প্রতিহত করাটা ভুল। প্রয়াত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত লেখককে বলেছিলেন, সংবিধানের ৫৫ (২) অনুচ্ছেদের অধীনে এটা করা সম্ভব। ওই অনুচ্ছেদ বলেছে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা ‘তাঁহার কর্তৃত্বে’ প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে। রুলস অব বিজনেস সংশোধন করেই ইসির অধীনে একাধিক মন্ত্রণালয় আনা সম্ভব। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ এ দুটিসহ পাঁচটি মন্ত্রণালয় বিএনপিকে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল বলেই জানা যায়।

বিএনপি কেন তাতে রাজি হয়নি, সে জন্য ক্ষমতাসীন দল সর্বদা বিএনপির সমালোচনায় মুখর থাকে। নির্বাচন কমিশনারদের তা অজানা থাকার কথা নয়। তবে তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে কবিতা খানম ঠিক বলেছেন, কিন্তু তাহলেও কেবল কেউ এ যুক্তিতে বিষয়টিকে আলোচ্যসূচিতেই আনতে না দেওয়ার মনোভাব গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মাহবুবকে তাঁর প্রস্তাব তুলতে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে পরে তাঁর কণ্ঠরোধ করানোয় একটি খারাপ নজির তৈরি হয়েছে। সিইসির উচিত হবে পরবর্তী সভায় মাহবুবের কথা বলার সুযোগ নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হওয়া। এটি হবে আইন ও সংবিধানসম্মত। ইসি কতটা স্বাধীন, এটি তারও একটি পরীক্ষা।

Advertisement