ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: কৈশোরে পড়েছিলাম রবার্ট লুই স্টিভেনসন রচিত ‘ড. জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’ রহস্য উপন্যাসটি। উপন্যাসের কাহিনিটি এমন ছিল: ডাক্তার জেকিল নামের লন্ডনের একজন চিকিৎসক এমন একটি ওষুধ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, যেটি ব্যবহার করে তিনি বিপরীত চরিত্রের একজন মানুষে পরিণত হতেন। অর্থাৎ, তাঁর মনের যেসব কুপ্রবৃত্তি রয়েছে, সেগুলো মুখ্য হয়ে উঠত এবং তিনি সেভাবেই কাজ করতেন। আবার অন্য একটি ওষুধ প্রয়োগ করে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে পারতেন। এভাবেই ড. জেকিল তাঁর মধ্যকার ভালো ও মন্দ এই দুটো স্বভাবকে নিয়ে একই দেহের ভেতর দুটি সত্তাকে লালন-পালন করতে শুরু করলেন। তিনি খারাপ সত্তাটির নাম দিলেন মিস্টার হাইড। এভাবে তিনি দিনের বেলায় ডক্টর জেকিল এবং রাতে মিস্টার হাইড হয়ে জীবন যাপন করতে থাকেন। একসময় এমন পরিস্থিতি হলো যে তিনি না চাইলেও মিস্টার হাইডে রূপান্তরিত হতে লাগলেন। একসময় দেখা গেল, যে ওষুধটি খেয়ে তিনি মিস্টার হাইড থেকে ডক্টর জেকিল হতেন, তা আর কাজ করছে না। ফলে তাঁর মনে মনুষ্যত্বের বদলে পশুত্ব স্থায়ী হতে লাগল। এরই মধ্যে মিস্টার হাইড খুন করে বসলেন এক ব্যক্তিকে। আর এই অপরাধবোধ থেকে রক্ষা পেতে আত্মহত্যা করলেন তিনি।
গত মঙ্গলবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত চট্টগ্রামে তুচ্ছ কারণে ঝগড়ার জেরে চালকের সহকারীর বাস থেকে এক যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করার খবরটি পড়ে ‘ড. জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল। মনে হচ্ছে, প্রত্যেক পরিবহনকর্মীর মধ্যে একজন করে মিস্টার হাইড বাস করেন। এঁদের প্রত্যেকের মধ্যে রয়েছে খুনি সত্তা। যার কারণে সামান্য ঝগড়ার জেরে তাঁদের পক্ষে খুব সহজেই যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে ফেলে দেওয়া সম্ভব। ঝামেলা এড়ানোর জন্য তাঁরা বাসের ধাক্কায় আহত যাত্রীকে সেতু থেকে পানিতে ফেলে দিতে পারেন। জেনে-বুঝে সজ্ঞানে মানুষকে চাপা দিতে পারেন। খুনি সত্তার কারণেই খালি বাসে রূপার ওপর তাঁরা শুধু হামলেই পড়েননি, হত্যাও করেছেন তাঁকে। এই পরিবহনশ্রমিকেরাই হয়তো তাঁদের মায়ের কাছে আদরের ধন, স্ত্রীর কাছে প্রেমিক স্বামী, সন্তানের কাছে স্নেহময় বাবা। তাঁদের এই খুনি সত্তার কথা হয়তো আগে পরিবারের লোকজন টের পাননি।
শুধু পরিবহনশ্রমিকদের কথা বলছি কেন, সমাজে এ রকম আরও অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা নিপাট ভালো মানুষ বলে পরিচিত বা সর্বজনশ্রদ্ধেয়। কিন্তু সময়ে সময়ে তাঁদের কুৎসিত, কদর্য রূপটি বেরিয়ে পড়ে। এমনই একজন হচ্ছেন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের জগন্নাথপুর মাথালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জালাল হোসেন। ৪০ বছর বয়সী এই ব্যক্তি ধর্ষণ করেছেন তাঁর শ্যালকের ১৩ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী মেয়েকে। অথচ তিনি নিজে তিন সন্তানের বাবা। তাঁরও কন্যাসন্তান রয়েছে। নিশ্চয়ই সন্তানদের কাছে তিনি একজন ভালো মানুষ। এ রকম আরেকজন সজ্জন ব্যক্তি হচ্ছেন মাকামে মাহমুদ। গত ১৫ জুলাই রাতে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের ইন্টার্ন চিকিৎসক মাকামে মাহমুদ এক রোগীর স্বজন নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করেন। হলফ করে বলতে পারি, মাহমুদ সাহেব তাঁর পরিবারের কাছে অতি আদরের ছিলেন। পরিবারের লোকজন নিশ্চয়ই কল্পনা করতে পারেননি, তাঁদের আদরের ধন, বুকের মানিকটি এমন অকাজ করেছেন। অফিসে সবার কাছে নিতান্ত নিরীহ বলে পরিচিত ছিলেন জামান সাহেব। কিন্তু বাড়িতে তিনি স্ত্রীর কাছে ছিলেন মূর্তিমান এক ত্রাস। কারণে-অকারণে তিনি প্রায়ই স্ত্রীকে মারধর করতেন। স্ত্রী মুখ বুজে ছিলেন, তাই কেউ টের পাননি। কিন্তু একদিন দিলেন স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে। কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ যখন তাঁকে ধরে নিয়ে গেল, তখন সমাজের কাছে আর আসল রূপটি প্রকাশ পেল। এ রকম আরও হাজারো উদাহরণ দেওয়া যাবে।
ধিক্কার এসব মানুষকে, যাঁরা সমাজে ভালো মানুষের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ান, কিন্তু অন্তরে বয়ে বেড়ান পশুত্ব। এঁরা একেকজন মিস্টার হাইড। কোনো ওষুধ খাওয়া ছাড়াই তাঁরা মিস্টার হাইডে পরিণত হচ্ছেন। উপন্যাসের মিস্টার হাইড তো তাঁর কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় আত্মহত্যা করেছেন, কিন্তু আমাদের দেশের মিস্টার হাইডরা তাঁদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হন না। এসব মিস্টার হাইডের জন্য এখন ওষুধ চাই ড. জেকিলে রূপান্তর করার জন্য। এখন আমাদের সবাই মিলে সেই ওষুধ আবিষ্কার করতে হবে। তা না হলে মিস্টার হাইডদের কোনোভাবে দমানো যাবে না। তাঁরা তাঁদের কুকর্ম করেই যাবেন।