১৯৭৩ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুর শহরের ঐতিহ্যবাহী মাদাম ব্রিজের পূর্ব পাশে মাটি দিয়ে কিল্লা সমতুল্য একটি মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। এ মঞ্চের সৌন্দর্যবর্ধন এবং শক্তি বাড়াতে চট্টগ্রাম থেকে ঘাস ও গাছের গুঁড়ি আনা হয়েছিল। সকাল থেকে হাজারো মানুষ অপেক্ষা করছে, একজনের জন্য। যাকে একনজর দেখা এবং তাঁর মুগ্ধ করা ভাষণ শোনার আগ্রহ সবার। তিনি আর কেউ নন, তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে ঘটনাটি বর্ণনা করছিলেন সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম শাহজাহান কামাল। প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে সংসদ সদস্য ছিলেন।
তিনি বলেন, “১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে লক্ষ্মীপুরে সফর করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে আমি লোকজন নিয়ে মাটির একটি মঞ্চ নির্মাণ করি। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর সার্কিট হাউজ ভবনের স্থানটিতেই ওই মঞ্চ করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম থেকে ঘাস ও গাছের গুঁড়ি এনে মঞ্চটির সৌন্দর্য এবং শক্তি বাড়ানো হয়।এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মাইন উদ্দিন পাঠান এবং চন্দ্রগঞ্জের কফিল উদ্দিন কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক কার্তিক রঞ্জন সেনগুপ্ত একান্ত সাক্ষাৎকারে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তখন তারা ১৪/১৫ বছর বয়সী স্কুলপড়–য়া ছাত্র ছিলেন।
তারা জানান, “সেদিন হেলিকপ্টারে করে বীরের বেশে লক্ষ্মীপুর এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা। মঞ্চের কাছাকাছি এসে উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে হাত নেড়ে উপস্থিত জনতাকে আগমন বার্তা দেন বঙ্গবন্ধু। এরপর হেলিকপ্টার থেকে নামতে-নামতে এবং মাটির কিল্লা সমতুল্য সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে জনতাকে সাড়া দেন তিনি।
এমপি শাহজাহান কামাল বলেন, “আমি ৭৩ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলাম। এরআগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা হিসেবে সাবেক ভিপি ও আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের হাত ধরে আমি বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য লাভ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছি।তিনি আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন হাজার-হাজার মানুষের সামনে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার জন্য আমাকে ভোট দিবে কিনা, বঙ্গবন্ধুর মুখে এমন প্রশ্ন শুনে উপস্থিত জনতা সুউচ্চ কণ্ঠে হাত উঁচিয়ে একযোগে সম্মতি জানায়। ওইদিন আওয়ামী লীগ মনোনীত আরেক এমপি প্রার্থী মাহমুদুর রহমান বেলায়েতকেও পরিচয় করিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ফেনী এবং রাঙামাটিতে সফর করেন তিনি। রাঙামাটি সফর শেষে ঢাকায় ফেরার পথে ঝড়ের কবলে পড়ে আবারও লক্ষ্মীপুরের চররুহিতা গ্রামে অবতরণ করে বঙ্গবন্ধুর হেলিকপ্টার। পরে ঝড় থামলে তারা ঢাকায় ফিরে যান।বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির তোফায়েল ও লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম আলাউদ্দিনও ওই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন বলে স্মৃতিচারণ করেন।
এম আলাউদ্দিন বলেন, “এরআগে ১৯৭০ সালের ২১ নভেম্বর লক্ষ্মীপুর সফরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন ৭০ এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ উল্লাহকে পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি এ সফর করেন। ওই সময় রায়পুর ও রামগঞ্জ ছাড়াও চন্দ্রগঞ্জের প্রতাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জনসভা করেন গণমানুষের প্রিয়নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রফেসর মো. মাইন উদ্দিন পাঠান বলেন, “স্বাধীনতার পরের একটি ঘটনা, আমি তখন রায়পুর মার্চ্চেন্টস একাডেমির ৭ম শ্রেণির ছাত্র। ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। নোয়াখালী জেলার শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু আগমন, খবর পেয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একটি ছোট ট্রাকে চড়ে রওনা দিলাম। পথে বৃষ্টির কবলে পড়ে আমরা ভিজে যাই। এরপর যখন নোয়াখালীর শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে পৌঁছাই, তখন দেখি স্টেডিয়ামে প্রবেশের পথ কর্দমাক্ত এবং সংকীর্ণ। স্টেডিয়ামে তখন কোনো গ্যালারি ছিল না। চারপাশে ফসলি ক্ষেত ছিল। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য আমরা হাঁটু পানি ও কর্দমাক্ত মাঠ পাড়ি দিয়ে স্টেডিয়ামে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নির্মিত মঞ্চের কাছে গিয়ে পৌঁছাই, যাতে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পারি।”
“আমার মনে পড়ে, সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন করার কথা বলছিলেন। তিনি জনগণকে অনুপ্রাণিত করছিলেন। বলছিলেন- সমবায় ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- মনে করেন, আগামী তিন বছর আপনাদের কিছুই দিতে পারবো না, আপনারা কি আমার সাথে আছেন? তখন উপস্থিত জনতা সমস্বরে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করেছিলেন।এছাড়াও লক্ষ্মীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আরবী শিক্ষক (মক্তবের) মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহর জন্মস্থান। সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের আলীপুর জিতু ব্যাপারি বাড়ির বাসিন্দা মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং লক্ষ্মীপুরে এসে তাঁর খোঁজখবর নিয়েছেন। লক্ষ্মীপুরের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম শাহজাহান বলেন, “আমার বিয়ের অনুমতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে নিয়েছিলাম। পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে তিনি আমাকে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে নিষেধ করেছিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তিনি আমার পিতার মতো ছিলেন। তিনি দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালোবাসতেন।এমপি শাহজাহান কামাল বলেন, “গণভবনে থাকলে আইসোলেটেড হয়ে যাবেন, নেতাকর্মীরা দেখা করতে পারবে না; তাই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতেই থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর এই উদার মনমানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে স্বপরিবারে হত্যা করে গাদ্দার ও ঘাতকের দল। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।প্রসঙ্গত, লক্ষ্মীপুরের মাটিতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের ১৩ ও ২১ নভেম্বর, ৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এবং ৭৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে এসেছেন। তিনি অবহেলিত এ জনপদের মানুষকে ভালোবাসতেন।