মেগানের বর্ণ-বোমে পিয়ার্সের বিদায় : গোপনে পারিবারিকভাবে সামলাবেন রাণি

কামাল মেহেদী : ব্রিটিশ রাজপূত্র এবং রাজবধু প্রিন্স হ্যারি এবং মার্কিন নাগরিক মেগান ঝড়ে কাঁপছে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম। প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার পর থেকেই নানা ইস্যুতে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হয়ে আসছিলেন সাবেক মার্কিন অভিনেত্রী মেগান। সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারীতে রাজকীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রিন্স হ্যারিকে নিয়ে ব্রিটেন ছাড়ার সংবাদটি করোনা মহামারীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিরোনামে ছিল। এবার মার্কিন ব্রডকাস্টার অপরা উইনফ্রিকে স্বাক্ষাতকার দিয়ে বোমা ফাটিয়েছেন প্রিন্স হ্যারি এবং মেগান মার্কল। গত ৭ মার্চ মার্কিন টিভি চ্যানেল সিবিএসে এবং ৮ মার্চ ব্রিটেনে আইটিভিতে সম্প্রচারিত হয় এই স্বাক্ষাতকার।
আইটিভির স্বাক্ষাতকার দেখেছেন ১১ মিলিয়নের বেশি দর্শক। স্বাক্ষাতকারে রাজপরিবারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ উত্থাপন করেছেন মেগান। এরমধ্যে তাদের সন্তান আর্চির জন্মের আগে তার শরীরে রং কি হবে, এ নিয়েও রাজপরিবারে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে বলে স্বাক্ষাতকারে অভিযোগ করেছেন মেগান। এই অভিযোগটি সবচাইতে বেশি আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এ ছাড়া প্যালেসের ভেতরে একবার নিজে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছেন এবং বিষয়টি নিয়ে রাজপরিবারের এক সিনিয়র সদস্যের সঙ্গে কথা বলেও সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন মেগান মার্কল।
মার্কিন সাবেক ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিটন, ব্রিটিশ লেবার দলীয় রাজনীতিক ডায়ান এবোট স্বাক্ষাতকার দেখে এই ইস্যুতে সমালোচনা করেছেন। লেবার লিডার স্যার কিয়ার স্টারমার বলেছেন, রাজ পরিবারের চাইতেও বর্ণবাদের অভিযোগ অনেক বড়। স্বাক্ষাতকারটি দেখেছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও। সংবাদ মাধ্যমের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ডাউনিং স্ট্রীট অন্তত ৫ বার সংবাদ মাধ্যমের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে বলে জানিয়েছে গার্ডিয়ান।
সোমবার রাতে স্বাক্ষাতকার প্রচারের প্রায় ৫৬ ঘন্টা পর মঙ্গলবার বিকেলে বাকিংহ্যাম পেলেস থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। তিন প্যারাগ্রাফের ৬১ শব্দের বিবৃতিতে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ বলেছেন, কয়েক বছর ধরে প্রিন্স হ্যারি এবং মেগান যে দু:সহ এবং চ্যালেঞ্জিং সময় পার করেছেন এটা জানতে পেরে রাজপরিবারের সবাই মর্মাহত। বিশেষ করে বর্ণের বিষয়টি বেশ গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন রাণী। বিষয়টি পারিবারিকভাবে গোপনে খতিয়ে দেখবেন বলে বিবৃতিতে জানিয়েছেন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এর আগে স্বাক্ষাতকার প্রচারের সাথে সাথেই রাজপরিবার থেকে গতানুগতিক একটি বিবৃতি তৈরী করা হলেও রাণী তাতে স্বাক্ষর দেননি। বিষয়টি নিয়ে কিছু সময় ভাবতে চান বলে পেলেসের মিডিয়া থেকে জানানো হয়েছিল।
এই বিবৃতি প্রকাশের আগে মঙ্গলবার বিকেলে প্রিন্স চার্লস একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, সেখানে এক সাংবাদিক সরাসরি প্রিন্স চার্লসকে এ বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। স্বাক্ষাতকারে প্রিন্স হ্যারি তার বাবা চার্লসকে দোষারূপ করেছেন। প্রিন্স হ্যারি বলেছেন, রাজকীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তিনি তার বাবা প্রিন্স চার্লসকে টেলিফোন করেছেন কিন্তু প্রিন্সল চার্লস টেলিফোন তুলেননি। এর আগেই তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেন প্রিন্স হ্যারি।
কেন এই স্বাক্ষাতকার এবং তাও আবার অপরার সঙ্গে কেন :
এবার দেখা যাক হঠাৎ করেই কেন এই স্বাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন মার্কিন টেলিভিশনের প্রেজেন্টার অপরা উইনফ্রি? মূলত অপরার সঙ্গে পূর্ব থেকেই বন্ধুত্ব ছিল প্রিন্স হ্যারির। এর আগে আপেল টিভিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি ডকুমেন্টারীতে তারা এক সাথে কাজ করেছেন। ২০১৮ সালের মে মাসে প্রিন্স হ্যারি এবং মেগানের বিয়েতেও অতিথি ছিলেন তিনি। ২০২০ সালের জানুয়ারীতে রাজকীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন প্রিন্স হ্যারি এবং মেগান। তবে এ বিষয়ে পুনরায় ভাবার জন্যে তারা এক বছর সময় নিয়েছিলেন। এক বছর পর গত ১৯ শে ফেব্রুয়ারী বাকিংহ্যাম পেলেস থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রিন্স হ্যারি এবং মেগান রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে একমত হয়েছেন যে, তারা আর কোনো দিন রাজকীয় দায়িত্বে ফিরবেন না। এই ঘোষণার পরপরই আর্চির রাজকীয় উপাধিও প্রত্যাহার করেন রাণী। অবশ্য এর আগেই ১৫ই ফেব্রুয়ারী তাদের স্বাক্ষাতকার গ্রহণ করেন অপরা উইনফ্রি। অপরা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের এপ্রিলে হ্যারি-মেগানের বিয়ের আগেই একটি এক্সক্লুসিভ স্বাক্ষাতকারের বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলেন তিনি।

আইটিভিতে গন্ডগোল : অফকমে ৪১ হাজার অভিযোগ এবং পিয়ার্স মর্গানের বিদায়
এদিকে সোমবার রাতে আইটিভিতে হ্যারি-মেগানের স্বাক্ষাতকারটি দেখেছেন প্রায় ১১ মিলিয়নের বেশি দর্শক। আর মঙ্গলবার সকালে গুড মর্নিং ব্রিটেইন অনুষ্ঠানে উপস্থাপক পিয়ার্স মর্গান এবং আইটিভির আবহাওয়া সংবাদ পাঠক আলেক্স বার্সফোর্ডের তর্কবিতর্ক দিনভর বেশ আলোচিত ছিল। মেগানের কট্টর সমালোচক হলেন পিয়ার্স মর্গান। স্বাক্ষাতকার প্রচারের পর এক মন্তব্যে পিয়ার্স বলেছেন, অপরার সঙ্গে স্বাক্ষাতকারে মেগান যা বলেছেন, তার একটি বাক্যও তিনি বিশ্বাস করেন না। মূলত প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে বিয়ের আগে পিয়ার্সের সঙ্গে মেগানের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু বিয়ের পর টুইটার থেকে পিয়ার্সকে বাদ দেন মেগান। এ নিয়ে বেশ গোস্বা ছিলেন পিয়ার্স। তিনি কখনোই মেগানকে মেনে নিতে পারেননি। মঙ্গলবার সকালে জিএমবি অনুষ্ঠানে আবহাওয়া সংবাদ পাঠক এলেক্স এই বিষয়টি নিয়ে মেগানের পক্ষে কথা বলেন। তাই সইতে না পেরে লাইভ অনুষ্ঠান থেকে উঠে চলে যান পিয়ার্স। এরপর সহযোগি উপস্থাপক বিরতীতে যেতে বাধ্য হন। প্রায় ১০ মিনিট পর অনুষ্ঠানে ফিরেন পিয়ার্স। অথচ অনুষ্ঠানের একজন সহযোগি উপস্থাপক ছিলেন পিয়ার্স। আর আবহাওয়ার সংবাদ পাঠক এলেক্সকে প্যানেল সদস্য হিসেবে অনুষ্ঠানে কথা বলার জন্যে নেওয়া হয়েছিল। অতিথির কথা সহ্য করতে না পেরে, অতিথিকে অসম্মান জানিয়ে উপস্থাপকের জায়গা থেকে উঠে চলে যান পিয়ার্স মর্গান। এরপর দুপুর ২টার ভেতরে আইটিভির বিরুদ্ধে অফকমে অন্তত ৪১ হাজার অভিযোগ পড়ে। এর আগে ২০০৭ সালে সেলিব্রেটি বিগব্রাদার অনুষ্ঠানে জেইড গোডি এবং শিল্পশেটির মধ্যে বর্ণবাদী বিতর্ক নিয়ে ৪৪ হাজার ৫শ অভিযোগ করা হয়েছিল অফকমে।
মেগান ইস্যুতে পিয়ার্স মর্গানের মন্তব্যের বিরুদ্ধে অফকমে ৪১ হাজার ১৫টি অভিযোগ পড়ার পর মঙ্গলবার বিকেলেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আইটিভি ছাড়েন পিয়ার্স মর্গান। আইটিভি কর্তৃপক্ষ পিয়ার্সে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। ২০১৫ সালে গুড মর্নিং ব্রিটেইনের উপস্থাপক হিসেবে আইটিভিতে যোগ দিয়েছিলেন সাংবাদিক পিয়ার্স মর্গান। তবে গার্ডিয়ান এবং দ্যা টেলিগ্রাফের সুত্র মতে, মেগানের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে পিয়ার্স মর্গানের মন্তব্যের পর মেগান আনুষ্ঠানিকভাবে আইটিভি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। এরপর আইটিভি কর্তৃপক্ষ পিয়ার্সকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলে কিন্তু পিয়ার্স নিজের বক্তব্যের পক্ষে শক্ত অবস্থানে থেকে গুড মর্নিং ব্রিটেইন ত্যাগের সিদ্ধান্তে স্থীর থাকেন।

ইউগোভের জরিপ :
এদিকে সোমবার এই স্বাক্ষাতকারটি প্রচারের পর মঙ্গলবার এক জরিপ চালিয়েছে ইউগোভ। জরিপে ৩২ শতাংশ বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন প্রিন্স হ্যারি এবং মেগানের সঙ্গে রাজপরিবার অন্যায় আচরণ করেছে। যেখানে কোনো সমতা রক্ষা করা হয়নি। ৩৬ শতাংশ বলেছে তারা এ বিষয়ে কিছুই জানে না। জরিপে অংশগ্রণকারী ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ বলেছে তারা প্রিন্স হ্যারি এবং মেগান মার্কেলের পক্ষে। আর ৬৫ বছরের বেশি বয়েসীদের ৫৫ শতাংশ বলেছে তারা রাণীকে সমর্থন করেন।

Advertisement