যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে: তবে কিন্তু যদি

ফারুক ওয়াসিফ :: মঞ্চ প্রস্তুত। নায়কের সঙ্গে মন্ত্রীপুত্র, কোটালপুত্র, সৈন্যসামন্ত, সব প্রস্তুত। নায়িকা ও তার সখীরাও রেডি। যদিও তাদের বলা হয়নি এই নাটকে তাদের পাট আনন্দের, নাকি বিয়োগান্ত। তারপরও নাচ-গান অথবা দলবদ্ধ কান্না, যা-ই করতে বলা হোক, তারা রেডি। কাহিনির শেষটা কী, তা এখনো বলছেন না যাত্রাপালার অধিকারী। ভগবান কৃষ্ণ যেমন বলেছিলেন অর্জুনকে, ফল আশা না করে তুমি লড়ে যাও। বিএনপিও তার কর্মীদের বলেছে, ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ তারা নির্বাচনে যাচ্ছে। ফল লাভের আশা না করেই? নির্বাচনে ঠিকঠাক লড়তে এখনো অনেক কাজ বাকি তাদের।

একটি গল্প: একটা বড় কাজ দুজনে মিলে করার কথা। কিন্তু একজন তুমুল চালাক। সে অন্যজনকে বলছে, ‘তুমি কোনো চিন্তা কোরো না, সব চিন্তা আমার। তুমি কেবল কাজ করে যাও।’ সরকারও যেন বিএনপিসহ সন্দিহান জনগণকে বলছে, সব টেনশন আমার। তোমরা কেবল দেখে যাও। এ ছাড়া উপায় কী বিরোধী জোটের? ভগবান কৃষ্ণ তো এ-ও বলেছিলেন, যা হয়েছে তা ভালো হয়েছে, যা হচ্ছে তাও ভালো হচ্ছে এবং যা হবে তাও ভালোই হবে।

যা হয়েছে, যেমন গত দুটি নির্বাচন, ২০০৮ সালে গৃহীত এবং ২০১৪ সালেরটা তর্কিত হলেও আওয়ামী লীগের জন্য ফল দুবারই ভালো হয়েছিল। একবার নিরঙ্কুশভাবে জিতে, আরেকবার প্রতিপক্ষের নিরঙ্কুশ বর্জনের মধ্য দিয়ে জয় হয়েছিল তাদের। ফলস্বরূপ, তারাই একটানা ১০ বছর ক্ষমতায় আছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলও দুই পক্ষের একটির জন্য তো অবশ্যই ভালো হবে। যাঁদের জন্য তা হবে, তাঁরা বলবেন, যা হচ্ছে তা ভালোই হচ্ছে। বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা এবং মাতা-পুত্র জেলে ও নির্বাসনে থেকে মাঠের বাইরে। দুজনই দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত, অতএব প্রার্থী হতে অযোগ্য–ঘোষিত। প্রায় চার হাজার গায়েবি মামলায় দলটির নেতা-কর্মীরা আটক বা দৌড়ের ওপর পলাতক। তারপরও ঐক্যফ্রন্ট-বিএনপি খেলায় ফিরে এসেছে। কর্মীদের মধ্যে ভোটের লড়াইয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার জেদ দেখা যাচ্ছে।

বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের মালগাড়িসমেত নির্বাচনের স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। নির্বাচন কমিশন মোটামুটি সবাইকে লাইনে রেখেছে। ‘পাওয়ার ইজ অলওয়েজ রাইট’ নীতিতে চলেছে এই কমিশন গত ১০ বছর। এবারেও বিরোধী ব্যক্তিদের মনোনয়ন বাতিল, মাঠ প্রশাসনে পক্ষপাত, বিতর্কিত ইভিএম প্রচলনে তাই অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু একটি মাত্র কাজ দিয়ে নির্বাচনী আমেজ আপাতত বাঁচাল তারা। বিএনপির কমপক্ষে ৭০ জন প্রার্থীর বাতিল হওয়া মনোনয়ন ফেরানো গিয়েছে কমিশনেরই হস্তক্ষেপে।

তারপরও পরীবাগের চায়ের দোকানে আলাপ হওয়া খুদে ব্যবসায়ী জাকির হোসেন ভরসা পান না। ঢাকায় নাকি শীত ও ভোটের হাওয়া এখনো বইতে শুরু করেনি। তাঁর খটকা এরশাদকে নিয়ে। এরশাদ কেবল বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুবিধাবাদ ও স্বৈরাচারের টিকে থাকারই প্রতীক নন, তিনি হলেন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তারও ব্যারোমিটার। নির্বাচনের ভরা মৌসুমে তাঁর হাসপাতালবাসী হওয়া ভালো ইঙ্গিত দেয় না। ২০১৪ সালেও দেয়নি। জাকির হোসেনও ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘এরশাদ হইল ল্যাজ। ল্যাজ যদি গুটাইয়া থাকে, তাহলে মাথা ঠিক আছে কমু ক্যামনে?’

এরশাদের ব্যাপারটা একদিক থেকে ঠিকই আছে। তিনি হলেন সময়ের মতো, কোথাও থামেন না, আবার চলেও যান না। আওয়ামী লীগের মহাজোটে তিনি থেকেই নেই আবার না থেকেও আছেন। বিরোধী দলে থেকেও যেমন আছেন সরকারে, আবার সরকারে থেকেও আছেন বিরোধী দলে। প্রার্থী দেওয়ার বেলাতেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় তিনি পেয়েছেন ২৯টি আসন, আবার সমঝোতার বাইরে দাঁড় করিয়েছেন আরও ১৩২টি আসনে। তাই প্রথম আলোর গতকাল সোমবারের শিরোনাম: ‘সমঝোতা হয়েও হয়নি জাপা-আওয়ামী লীগের’। শেষ দিন পর্যন্ত লাঙ্গল খাড়া থাকলে তো ভালোই। দ্বিদলীয় দোনলা বন্দুকের বাইরে আরও ‘চয়েস’ থাকল ভোটারের। দুই জোটের ভেতরে ও বাইরে ছোট দলগুলোর যার যার প্রতীক নিয়ে ভোটে থাকাও প্রতিযোগিতার জন্য ভালো। বহু বছর পর সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবিদার থেকে শুরু করে অন্তত একটি আসনের দাবিদার দল—সবাই নির্বাচনে এসেছে। যা হচ্ছে তা ভালোই হচ্ছে।

অতএব মঞ্চ প্রস্তুত, যার যার সামর্থ্য নিয়ে প্রধান চরিত্ররা প্রস্তুত। পাত্র–পাত্রীরা যার যার সংলাপ মুখস্থ করে রেখেছে। এখন বাজনা বাজা আর পর্দা ওঠার অপেক্ষা। যদি আবারও এমন হয়, ২০১৪ সালের মতো, পর্দা ওঠানোর পর দেখা গেল দর্শকেরাই নেই!

গতকাল থেকে প্রচারাভিযান শুরু হয়েছে। ভোটের আগের এই ১৮ থেকে ১৯ দিন যদি সব দলের লোক সমানভাবে আপন পক্ষের গুণগান গাইতে না পারে, গান যদি ২০১৪ সালের মতো একটা মাইক থেকেই বাজে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হতে পারবে না। যদি ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশি টাইপ স্বাভাবিক উত্তেজনার চেয়ে অস্বাভাবিক জ্বালাও-পোড়াও-হটাও চলে, যদি বিরোধী পক্ষের জন্য মাটি এতই তাপানো থাকে যে তারা পা-ই রাখতে পারছে না, তাহলে দোষ নির্বাচন কমিশনের ওপরই বর্তাবে। কমিশনের ব্যর্থতার জন্য তখন লোকে দায়ী করবে সরকারকে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ওপর আস্থা রাখার কথা বলেছিলেন—লোকের সেই প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়বে। মনে প্রশ্ন জারি থাকবে, যা হবে, তাও কি ভালোই হবে? এমন ভালো, যাকে অন্যায় বলে মনে হবে না!

কেননা, দেশে এরশাদ আমলের পর এই প্রথম জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে মেয়াদ-ফুরানো সরকারের কর্তৃত্বে, তাদেরই ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায়, সংসদ বহাল রেখে। এরশাদ আমলের পর এই প্রথম প্রধান বিরোধী দলের নেতা প্রার্থিতার অযোগ্য ও আদালতের রায়ে কারাবাসী। যা হবে, তা ভালো হবে কি না, এ নিয়ে সংশয়ও তাই অমূলক নয়।

২০১৪ সালের বিতর্কিত ও পেট্রলে জ্বলন্ত নির্বাচনের পর উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। দিনাজপুরের পাঁচবিবির এক গ্রামবাজারে কথা হয় এক লোকের সঙ্গে। স্বভাবতই জিজ্ঞেস করি, ভোটের দিন কী হয়েছিল?
: ভোট হয় নাই, বাহে।
ভোট তো হয়নি, কিন্তু হয়েছিল কী?
: ভোটের ডিউটি দিবার নাগছিল ইসকুলের দফাদার। তারপর এমন মারামারি নাগিল, ব্যাটাটা হুতাশে মরি গেইল।
হুতাশে মরি গেল মানে?
: মানে বুজলেন না? মারামারি দেখি অয় দৌড় নিবার নাগছিল। দৌড়াই ওই পুকুরত পড়িল আর মরি গেইল।

হুতাশের মানে এতক্ষণে বুঝলাম। হতাশা কী, তা সবাই জানি। হতাশা খুব বেড়ে গেলে যে অন্তর্জ্বলুনি হয়, তাকে বলে হুতাশন। আর ভয়ের চোটে হার্টফেল করে মারা যাওয়াকে ওখানে বলে ‘হুতাশে মরি গেইসে’।

হা-হুতাশ আর কত? এবার আমরা হতাশ হতে চাই না, হুতাশনে জ্বলতে চাই না, হুতাশে কেউ মারা যাক, তা চাই না।

Advertisement