যে চালাকি সবাই বোঝে

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: যেসব দেশে গণতন্ত্র আছে, সেখানে অবধারিতভাবে নির্বাচনও আছে। গণতন্ত্র আছে অথচ নির্বাচনের প্রয়োজন হয় না-এমন কথা শোনা যায় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শুধু যে পার্লামেন্টের সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন তা নয়, স্থানীয় পর্যায়ের আরও প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা। তারই নাম ‘স্থানীয় শাসন’।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ ‘প্রশাসনিক একাংশ’ কথাটির ব্যাখ্যাও সংবিধানেই দেওয়া আছে। সেই ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘জেলা কিংবা এই সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে আইনের দ্বারা অভিহিত অন্য কোনো এলাকা।’

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল। ইউনিয়ন পরিষদে ছিল প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন। সেকালে এলাকার সবচেয়ে ভালো সমাজসেবকেরাই ইউনিয়ন বোর্ড বা ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট সদস্য নির্বাচিত হতেন। এলাকার ভোটাররা জানতেন মানুষের সেবা করার যোগ্যতা, দক্ষতা ও আকাঙ্ক্ষা কার কতটা আছে।

রাষ্ট্রের মালিকানা যখন জনগণের, তখন জনগণের কর্তৃত্বের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্থানীয় শাসন পরিচালিত হতে হবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা, কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত কর্মকর্তাদের দ্বারা নয়। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ পরিচালনার যে রূপরেখা সংবিধানে দেওয়া আছে, সেটাই স্থানীয় শাসনের ভিত্তিস্তর। বাংলাদেশে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন। সংবিধানে এ কথাও বলা আছে যে ‘সংবিধান ও অন্য কোনো আইন সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করিবেন,…প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেইরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন।’ কিছু দায়িত্বের কথা সংবিধান বলে দিয়েছিল, যেমন (ক) প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য, (খ) আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, (গ) জনসাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।’ [অনুচ্ছেদ ৫৯ (২) ]

স্থানীয় শাসনের নির্বাচিত কর্তৃপক্ষকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়ার লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের জন্য সংসদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে আমাদের সংসদ সদস্যরা নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করেননি। তার ফলে জনগণের প্রত্যক্ষ ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবর্তে এলাকার সংসদ সদস্যদের অধীনস্থ কর্মকর্তার মতো সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকেন। বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ তাদের ওপর খবরদারি করে।

প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে প্রদত্ত গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের দেওয়া হয়নি। অনেক দিন আগে আপিল বিভাগের একটি রায়ে সে কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে দেওয়া রূপরেখার বহির্ভূত স্থানীয় সরকার-সম্পর্কিত কোনো আইন প্রণয়নে সংসদ সদস্যদের এখতিয়ার নেই এবং সেটা করা হলে ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ দুটিকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ এবং ৭ অনুচ্ছেদের ১ দফার বিরোধিতা করা হবে।’ [৪৪ ঢাকা ল রিপোর্টস (এডি) ৩১৯] উল্লেখযোগ্য যে সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার’ মালিকানা জনগণকে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের অত্যন্ত বিপর্যস্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেও স্থানীয় সরকারের ইউনিটগুলোতে জনগণ যতটুকু ক্ষমতায়িত হতে পারত, তা পারছে না। নির্বাচন হয়, জনপ্রতিনিধিদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়, গাড়ি-বাড়ির সুবন্দোবস্ত করা হয়, কিন্তু ক্ষমতা দেওয়া হয় না। জনগণকে তার প্রাপ্য সাংবিধানিক ক্ষমতা দিতে আমাদের রাষ্ট্রের ভীষণ ভয়।

অন্যদিকে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেটাও ঠিকমতো ব্যবহার করার ক্ষমতা অধিকাংশের নেই। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী নন। অনেকেই উপলব্ধি করতে পারেন না যে জনপ্রতিনিধি আর কর্মচারী দুই জিনিস।

সিটি করপোরেশনগুলোতে নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের অনেকে তাঁদের স্বপ্ন, পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের মাথা খারাপ করে দেন। কিছুকাল যাবৎ দেখছি, একেকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন আসে আর তাতে আমাদের সংবাদমাধ্যম প্রার্থীদের যে প্রচার দেয়, তা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারকে হার মানায়। প্রার্থীরা বস্তির বুড়োকে বুকে জড়িয়ে ধরছেন, কোনো বৃদ্ধার হাত টেনে নিয়ে নিজের তপ্ত মাথায় রাখছেন।

শুধু তাই নয়, এমন সব প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনার কথা বলছেন, যা বাস্তবায়নের সাধ্য যেমন তাঁর নেই, তা বোঝার সাধ্যও ভোটারদের নেই। কেউ বলেন, আমি সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকার গঠন করব। যেন তিনি বাস করছেন খ্রিষ্টপূর্ব গ্রিসের কোনো নগরে। বাঙালি অন্যকে প্রতারিত করতে পছন্দ করে।

রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনার বারো আনা বাস্তবায়ন করতে পারেন স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা। দেশ, গ্রাম, নগরগুলোকে সবুজ, সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারেন তাঁরাই, যদি তাঁদের সেই সদিচ্ছা থাকে। সমাজসেবার মানসিকতাই বড় কথা। এখন সমাজসেবা নয়, প্রতাপ-প্রতিপত্তি প্রদর্শনই প্রধান লক্ষ্য। সামরিক শাসকেরা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের ভয় ও লোভ দেখিয়ে তাঁদের পক্ষে রেখেছেন। বেসামরিক সরকারগুলোও নিজেদের দলীয় স্বার্থে তাঁদের কবজায় রেখেছে। জনগণ থাকছে ক্ষমতাহীন। তাদের গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত হতে পারছে না।

আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে হাহাকার করছি। স্থানীয় পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও সব ল্যাঠা চুকে যায় না। নির্বাচন সুষ্ঠু হলো কি না, তার চেয়ে বড় কথা কে নির্বাচিত হলেন। জনগণের পছন্দের লোক হলে হবে না, সরকারের পছন্দের হতে হবে। যেসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত হন, তাঁদের লাঞ্ছনা ও বিড়ম্বনার শেষ নেই। অব্যাহত হয়রানির মধ্যে থাকেন তাঁরা। জেলের দরজা তাঁদের জন্য উন্মুক্ত। তাঁরা জানেন, যেকোনো সময় তাঁদের জেলের ফটকে ঢুকিয়ে দেওয়া হতে পারে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও বিপন্ন স্থানীয় সরকারব্যবস্থা। কারচুপির সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে আরেক উপসর্গ। স্থানবিশেষে নির্বাচনটাকেই শিকেয় তুলে রাখা। নির্বাচিত হওয়ার পর কাজ করতে না দেওয়ার চেয়ে যেখানে বিরোধী দলের বিজয়ের সম্ভাবনা এবং সরকারি দলের প্রার্থীর পরাজয় অবধারিত, সেখানে ঠুনকো অজুহাতে নির্বাচন স্থগিত রাখা অতি বুদ্ধিমানের কাজ। কাউকে দিয়ে একটা মামলা ঠুকে দিলেই হলো। নির্বাচন কমিশনে উকিল-ব্যারিস্টার রয়েছেন প্রচুর। তাঁরা বলবেন, কী আর করা!

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থীরা বিপুল ব্যয়ে প্রচারণায় নামার পর নির্বাচন স্থগিত করায় শুধু প্রার্থীদের আর্থিক ক্ষতি নয়, তাঁদের নিরাশ করাও নয়, ভোটারদের চপেটাঘাত করার শামিল। একমাত্র বিধাতার কাছে ছাড়া প্রার্থীদের ক্ষতিপূরণ চাইবার আর কেউ নেই। সব ব্যাপারে খেয়ালখুশি মানুষ সহ্য করে না। আমরা নানাভাবে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার কৌশল শিখেছি। গণতন্ত্রকে গলা টিপে মারার যত উপায় আছে, তা আমরা করায়ত্ত করেছি।

দেশের সবগুলো স্থানীয় সরকারে যদি বিরোধী দলের লোক নির্বাচিত হন, তাতেও সরকারের কিছুই আসে-যায় না। সরকারের পতন ঘটানো তো দূরের কথা, কোনো ক্ষতি করার শক্তিও তাঁদের নেই। তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে বাধ্য। তবু কেন এই নিম্নরুচির চালাকি, যা সবাই বোঝে। স্থানীয় সরকার থেকে সংসদ পর্যন্ত সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যদি দুর্বল ও কলুষিত হয়, তাহলে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে জনগণ উপকৃত হবে না। বরং বিকল ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে রাষ্ট্রযন্ত্র।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক

Advertisement