যে ৩২ শতাংশকে নিয়ে বিজেপির শঙ্কা

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ভারতে আর সাত-আট মাস পরই জাতীয় নির্বাচন। আগামী বছর এপ্রিল-মে মাসে নির্বাচন হতে পারে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই গঠিত হবে দেশটির জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ—‘১৭তম লোকসভা’। জাতীয় নির্বাচনের সময়েই অন্তত পাঁচ-ছয়টি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনও হবে। বলা যায়, ভারতে ২০১৯ শুরু হবে নির্বাচনী আমেজ ও উত্তেজনার মধ্য দিয়ে; ইতিমধ্যে সে উত্তাপ লেগেছে দলীয় দপ্তরগুলোয় এবং বিশেষভাবে প্রচারমাধ্যমে।

ভারতে আগের জাতীয় নির্বাচন হয়েছে ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১২ মে—পাঁচ দফায়। প্রায় ৮২ কোটি ভোটারের ৬৬ শতাংশ ওই নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল। আর মোট প্রদত্ত ভোটের ৩১ শতাংশ পেয়ে সরকার গঠন করে বিজেপি। এমনকি বিজেপি যে জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদের সম্মিলিত ভোটের হিস্যা ছিল ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে ৬০ শতাংশের অধিক ভোট পড়লেও ক্ষমতায় বসতে বিজেপি জোটের সমস্যা হয়নি। ‘নির্বাচনী গণতন্ত্রের’ এই সংকট নিয়ে ভারতে এখনো সামান্যই আলোচনা হয়। কিন্তু এর মাঝেই দেশটিতে আরেক দফা নির্বাচন চলে এসেছে এবং যথারীতি কাঠামোগত সংস্কারের চেয়ে রাজনীতিবিদদের কাছে ক্ষমতার প্রশ্নই মুখ্য হয়ে উঠেছে। নির্বাচনী অঙ্কেও ভোটের হিসাবই প্রাধান্য পাচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে বিজেপিবিরোধী শিবির ভরসা করছে দলিত-মুসলমান ভোটব্যাংকের ওপর।

বিশেষ দুশ্চিন্তা ৩২ শতাংশ ভোটারকে নিয়ে
গত পাঁচ বছরে বিজেপির সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উগ্রতায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি গিয়েছে দলিত ও মুসলমানদের। দলিতরা ভারতে জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ এবং মুসলমানরা ১৫ শতাংশ হিস্যাধারী। বিজেপির জন্য দুশ্চিন্তা হলো এই ৩২ শতাংশের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে। ভারতের নির্বাচনী রাজনীতির ভরকেন্দ্র উত্তর প্রদেশে দলিত রয়েছে ২১ শতাংশ, মুসলমান ১৯ শতাংশ। এরা জোটবদ্ধ হলে সেখানে অনেক কিছু সম্ভব। কিন্তু বিজেপির জন্য স্বস্তির বিষয় এই—সব রাজ্যেই দলিত ও মুসলমান ভোটব্যাংক বহু দল-উপদলে বিভক্ত। ফল হয়েছে এ রকম, সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ হলেও লোকসভায় মুসলমান এমপিদের হিস্যা মাত্র ৪ শতাংশ। আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকায় দলিতদের অবস্থা অবশ্য মুসলমানদের মতো খারাপ নয়। কিন্তু মুসলমানদের মতোই তাদের প্রতিও আর্থসামাজিক-প্রশাসনিক বঞ্চনা পাহাড়সম। মুসলমানদের সঙ্গে তাদের মৈত্রীর বাস্তবতাটা এভাবেই তৈরি হয়ে আছে।

মোদির শাসনামলে প্রায় সমগ্র ভারতে দলিত ও মুসলমানরা বিজেপি নেতা-কর্মীদের দ্বারা মানসিক ও শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়ে চলেছে। এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের ক্ষোভ দাবানল তৈরি না করলেও দলিত তরুণেরা ব্যাপকভাবে সোচ্চার। জন্ম হয়েছে ‘ভীমসেনা’র মতো সংগঠনের। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার ঘটনা শিক্ষিত দলিত তরুণ-তরুণীদের ব্যাপক হারে রাজনীতির দিকে টানে। একই বছরের জুলাইয়ে মোদির নিজ রাজ্যের উনায় মৃত গরুর চামড়া সংগ্রহের অভিযোগে চার দলিত ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ভিডিও দলিতদের উত্তাল করে তোলে। উনার ঘটনাই গুজরাটে জিগনেশ মেবানির মতো নবীন দলিত রাজনীতিবিদদের জন্ম দেয় এবং এর ধারাবাহিকতায় অসংখ্য জিগনেশ ও চন্দ্রশেখর আজাদের (ভীমসেনার প্রতিষ্ঠাতা) জন্ম হয়েছে গত চার বছরে।

তবে মোদি এই বেদনা ভোলাতেও সচেষ্ট। যদিও কাজটি সহজ নয়। দলিত-জীবনের মূল সংকট বর্ণাশ্রম প্রথাকে ঘিরে এবং বিজেপির রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুত্ববাদের ওপর, যার মূলেই আছে এই বর্ণাশ্রম। তাই বিজেপির সঙ্গে দলিতদের দূরত্ব ঘোচানো কার্যত কঠিন। এটা একটা আদর্শিক সংগ্রাম, যে সংগ্রামের প্রতিক্রিয়ায় নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক জন্ম ও উত্থান। উপরন্তু, ধর্মীয় উগ্রবাদ তার দূষণ এড়াতে পারে না। অচ্ছুত করি সম্প্রদায়ের সদস্য রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে বিজেপি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) দলিতদের শান্ত রাখতে চেষ্টা করছে। কিন্তু দলিতরা নিজ সম্প্রদায়ের একজনকে রাষ্ট্রপতি ভবনে দেখেই প্রতিদিনকার বঞ্চনা ভুলে যাবে—এরূপ অবস্থা এখন আর নেই। দলিতদের মতোই মুসলমানদের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্কও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে তিক্ত।

মুসলমানদের ক্ষতে লাগাতার বিষাক্ত পেরেক
বিজেপি ও আরএসএস পরিবার বহুকাল যাবৎ তাদের তিন শত্রু (মুসলমান, খ্রিষ্টান ও কমিউনিস্ট) তত্ত্বে মুসলমানদের নাম সবার আগে রেখেছে। মুসলমান সমাজ এ বিষয়ে অবহিত। মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে গুজরাটে কী ঘটেছিল, সেটাও ভুলে যাওয়ার নয়। তবে এই দল কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে নির্যাতন ও বর্বরতা কত অসহনীয় স্তরে যাবে, সে বিষয়ে মুসলমান ভোটারদের অনুমান ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে ‘গো-রাজনীতি’। একদিকে গরুর মাংস খাওয়ার ‘অভিযোগে’ সরাসরি পিটিয়ে হত্যার ব্যাপকতা, বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলমান শিক্ষার্থীদেরও গীতা পড়া বাধ্যতামূলক করা মুসলমানদের মাঝে স্মরণকালের ভয়াবহ সামাজিক বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছে। বিজেপি প্রভাবিত প্রচারমাধ্যম গত চার বছরে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে মুসলমান মাত্রই ‘পাকিস্তানের এজেন্ট’, মুসলমান মাত্রই ‘সন্ত্রাসী’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। উত্তর প্রদেশে মুসলমানবিরোধী দাঙ্গার প্রকাশ্য সমর্থক যোগী আদিত্যনাথকে ২০১৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী করে বিজেপি কার্যত মুসলমানদের ক্ষতে বিষাক্ত এক পেরেক স্থাপন করেছে মাত্র। কাশ্মীরিদের ওপর দমন-পীড়নের তীব্রতাও সমগ্র ভারতের মুসলমান মনোজগতে বিজেপিবিরোধী নেতিবাচক ছাপ ফেলেছে।

বিজেপি মুসলমানদের ভোট পেতে আদৌ আগ্রহী নয় বলেও মনে হয়। চলতি লোকসভায় বিজেপি-দলীয় কোনো মুসলমান সদস্য নেই। এই প্রথম ভারতে কেন্দ্রে এমন একটি দল সরকার গঠন করেছে, যাদের কোনো মুসলমান সংসদ সদস্য ছিল না। তবে সম্প্রতি মুসলমান নারীদের স্বার্থে ‘তিন তালাক প্রথা’কে ‘অপরাধ’ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে মোদি সরকার। এই উদ্যোগ থেকে বিজেপি শিক্ষিত মুসলমান নারীদের ভোট আশা করছে এখন। এ থেকে এমন কৌতুকেরও জন্ম হয়েছে—বিজেপি ও মোদি মুসলমান পুরুষদের নয়, মুসলমান নারীদের পছন্দ করে। বিজেপির এই ‘নারীবাদী’ ভাবমূর্তি আবার অসার হয়ে পড়ে, যখন দেখা যায়, কোনো মুসলমান যুবক ও হিন্দু তরুণী বিয়ে করা মাত্রই রাজনৈতিক মদদে দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। গত ডিসেম্বরে রাজস্থানে এক মুসলমান যুবককে এমন ‘অপরাধে’ (যাকে বিজেপি মিডিয়া বলছে ‘লাভ জিহাদ’) আগুনে পুড়িয়ে খুন করার দৃশ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে উল্লাস করতেও দেখা গেছে আরএসএস কর্মীদের।

প্রশ্ন উঠছে কংগ্রেসের অতীত ভূমিকা নিয়েও
বলা বাহুল্য, কংগ্রেসসহ বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষরা দলিত ও মুসলিমদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল এখন। অতীতে ৪৯ বছর কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করেছে কংগ্রেস। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৫টি জাতীয় নির্বাচনে ছয়বার তারা একা এবং আরও চারবার জোটগতভাবে বিজয়ী হয়েছে। এও স্বীকৃত তথ্য যে মুসলমান ও দলিতরা কংগ্রেসের নির্ভরযোগ্য ভোটব্যাংক ছিল অতীতে। কিন্তু নেহরু গান্ধী ‘ডাইনেস্টি’ ভারতের ওই দুই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক বঞ্চনার অবসানে সামান্যই কাজ করেছে। উপরন্তু, ১৩৩ বছরের পুরোনো এই দলের নীতিনির্ধারকদের প্রভাবশালী একাংশ মনে করে, মুসলমানদের সঙ্গে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠতাই গত নির্বাচনে দলটির শোচনীয় পরাজয়ের কারণ হয়েছে। এরূপ মনোভাব অনেক কংগ্রেস নেতাই এখন আর গোপন করছেন না। ফলে, এক দশক ধরেই কংগ্রেসের প্রতি মুসলিম ও দলিত সংগঠকদের মোহভঙ্গ ঘটেছে। যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই দুই সম্প্রদায়ের ভোট আঞ্চলিক নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। তারই সুযোগ নিয়েছে আরএসএস-বিজেপি-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ জোট। কিন্তু এদের চার বছরের শাসনে দলিত ও মুসলমানরা এত বিপন্ন যে আবার তারা কংগ্রেস কিংবা আঞ্চলিক সেক্যুলার দলগুলোর প্রতি মুখ ফেরাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল, মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি, অখিলেশ যাদবদের সমাজবাদী পার্টি, দেবগৌড়ার জনতা দল এবং বামপন্থী সিপিএম ২০১৯-এর নির্বাচনকে সামনে রেখে জোটবদ্ধ হলে তারাই হবে দলিত-মুসলমান ভোটের দাবিদার। এদের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের কেমন বোঝাপড়া হবে, সেটাই আগামী নির্বাচনে বিজেপি ও ভারতের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করবে।

অনেকে বলছেন, মোদিবিরোধীদের সেই বোঝাপড়া হবে নির্বাচনের পরে। প্রত্যেকে নিজ নিজ সামর্থ্যে নির্বাচন করবে এবং নির্বাচনের ফল ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু ইতিমধ্যে মমতা, মায়াবতী, অখিলেশ যাদবদের আঞ্চলিক দলগুলো মুসলিম-দলিত ভোটব্যাংক কবজা করার লক্ষ্যে ঐক্য গড়ে তুলছে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশে মোদিবিরোধীরা ভালো ফল পেয়েছে। এই নতুন রোডম্যাপ আগ্রাসী বিজেপির বিপরীতে আঞ্চলিক দলগুলোর অস্তিত্ব বাঁচানোর শেষ চেষ্টাও বটে। দেশটির ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ২০টিতে ইতিমধ্যে বিজেপি-নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দলিত ও মুসলমানদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যেসব সংগঠন কাজ করছে, তারাও মনে করে, ধর্মীয় উগ্রপন্থা থেকে ভারতীয় নিম্নবর্গকে রক্ষা করতে হলে সর্বত্র বিজেপিবিরোধী সম্ভাব্য বিজয়ীকে সম্মিলিতভাবে সমর্থন করা উচিত।

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায়ই বলা হয়, নির্বাচনী আয়োজনের বড়ত্বের দিক থেকে ভারত এখন বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে একে ‘বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ’ও বলে ফেলেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় চার বছর যাবৎ কোনো আনুষ্ঠানিক বিরোধী দল নেই। প্রায় ২০ শতাংশ ভোট পেয়েও সর্বশেষ নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস মাত্র ৪৪টি আসন পেয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দল হতে সেখানে ন্যূনতম ৫৪টি আসন পেতে হয়। ফলে বিশ্বের ‘বৃহৎ গণতন্ত্রে’ লোকসভা চলছে আনুষ্ঠানিক কোনো ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ ছাড়াই। অথচ নির্বাচনে ভোটারদের ৬০ শতাংশের অধিক বিজেপিবিরোধীদেরই ভোট দেয়। এই পরিস্থিতির কারণ খুব স্পষ্ট। দেশটিতে বিজেপিবিরোধীরা বহুধাবিভক্ত। কিন্তু এই পরিস্থিতির ফলে নরেন্দ্র মোদি সরকারের মধ্যে জবাবদিহিহীনতার দম্ভ দেখা যাচ্ছে।

প্রশ্ন উঠেছে, আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রতিপক্ষরা উপরিউক্ত পরিস্থিতি বদলাতে পারবে কি না। দলিত-মুসলমান ভোট-সংহতি এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য একমাত্র আশার সলতে। এখন ভারতের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও অনেকখানি নির্ভর করছে ওই ৩২ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারের সংহতির ওপর।

Advertisement