রমজানকে ঘিরে বরিশালে চলছে আমন ধানের মুড়ি ভাজার উৎসব

রমজানকে ঘিরে দিন থেকে রাত অবধি বরিশালে চলছে আমন ধানের মোটা মুড়ি ভাজার উৎসব। দিনব্যাপী সিয়াম সাধনার পরে ইফতারে অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মুড়ি একটি অন্যতম খাদ্যপণ্য।সরোজমিনে দেখাগেছে, কোন ধরনের ইউরিয়া, হাইড্রোজ বা রাসয়নিক ছাড়াই চলছে এ মুড়ি ভাজা উৎসব। বরিশাল-ঝালকাঠি সীমান্ত এলাকা বুড়িরহাট ও আশপাশের ২০ গ্রামে মোটা মুড়ি বানানো হচ্ছে ১’শ বছরেরও বেশি সময় ধরে। স্বাদে অতুলনীয় বলে জেলার বুড়িরহাটের মোটা মুড়ির খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশের বাইরেও। এ রমজানকে ঘিরে দপদপিয়া ইউনিয়নের ২০টি গ্রামে এখন দিনরাত চলছে মুড়ি ভাজার উৎসব। এ গ্রামগুলো থেকে জেলার চাহিদা পূরণ করে শতাধিক মণ মুড়ি দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। এখানে বছরে প্রস্তুত করা হয় প্রায় কোটি টাকার মুড়ি।অপরদিকে, জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের বাখরকাঠিসহ কয়েকটি গ্রাম জুড়েই যুগের পর যুগ ধরে মুড়ি ভাজার ব্যবসা চলে আসছে। মোটা ধান সংগ্রহ করে বিশেষ ব্যবস্থায় সিদ্ধ-শুকনা আর ছাটাই শেষে উপযোগী করে তোলা থেকে শুরু করে মুড়ি ভাজা পর্যন্ত রয়েছে বিশেষ দক্ষতা। রমজানের চাহিদা মেটাতে নারীদের পাশাপাশি পুরুষরা সমানতালে মুড়ি প্রস্তত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মুড়ি পল্লী নামে পরিচিত নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের তিমিরকাঠি, জুড়কাঠি, ভরতকাঠি, দপদপিয়া এবং রাজাখালি গ্রামের ২’শ ৫০টি পরিবার যুগ যুগ ধরে মুড়ি ভেজে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

এবিষয়ে নগরীর বড় বাজারের মুড়ি ব্যবসায়ী রিপন দাস, তপু হাওলাদার জানান, নাখোচি বা আমন জাতের ধান প্রক্রিয়াজাত করে এ মুড়ির চাল তৈরি করা হয়। এখানকার মুড়িতে কোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় না। যে কারণে এ মুড়ি স্বাস্থ্য সম্মত ও খেতে সুস্বাদু। বর্তমানে ১’শ ২০ টাকা দরে প্রতি কেজি মুড়ি খুচরা বিক্রি হয়। রমজানের বাড়তি চাহিদা এবং কিছু বেশি আয়ের জন্য রাত ৪টা থেকেই শুরু হয় মুড়ি ভাজা, চলে পরদিন দুপুর পর্যন্ত। তীব্র গরমে কাঠ ফাটা অসহ্য গরম উপেক্ষা করে চাহিদার যোগান দিতে মুড়ি ভাজেন কারিগররা।
এবিষয়ে আলাপকালে মুড়ি প্রস্তুতকারী শ্রমিক মানিক লাল, সুরেশ ধর ও সুজন বলেন, মুড়ি ভাজার জ্বালানি কাঠ ও আনুষঙ্গিক কিছু খরচ বাদে প্রতি ৫০ কেজি চালের মুড়ি তৈরি করে মজুরি পান মাত্র ৫’শ টাকা। এ অর্থেই চলে তাদের জীবন-জীবিকা, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনাসহ যাবতীয় খরচ। এখানকার মুড়ি সুস্বাদু হওয়ায় সারা দেশেই-এর সমাদর রয়েছে। ঢাকা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা এখান থেকে মুড়ি নেন। বাজারে খুচরা দরে প্রতি কেজি ১’শ ২০ টাকা বিক্রি হলেও পাইকারি দর প্রতি কেজি ৯০ টাকা। বছরের পর বছর মুড়ি ভেজেও কেবল পুঁজির অভাবে ভাগ্য ফেরাতে পারেনি এ পরিবারগুলো। জেলার বিভিন্ন স্থানে এ মৌসুমে মুড়ি ভাজার কারিগরেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রত্যেকটি মুড়ি ভাজার ঘরেই এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।এবিষয়ে জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের বাখরকাঠি গ্রামের মুড়ি প্রস্তুতকারী নারী আয়েশা বেগম বলেন, এ কাজে চুলার আগুনের প্রচন্ড গরম সহ্য করতে হয়। তাই যাদের বয়স বেড়েছে, তাদের এ কাজে কষ্ট হয়। তবে এটি নারীদের জন্য আলাদা কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। মুড়ি ভাজাকে কুটির শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করা হবে, এমনটাই এ শিল্পে জড়িতদের প্রত্যাশা।

এ ব্যপারে দপদপিয়া মের্সাস বিস্মিল্লাহ স্টোর এন্ড মুড়ির মিলস্-এর মুড়ি ব্যবসায়ী মো. ইউসুফ আলী হাওলাদার জানান, এ অঞ্চলের হাতে ভাজা মোটা মুড়ির জনপ্রিয়তা ও কদর অনেক বেশি। কিন্তু মেশিনে ভাজা চিকন মুড়ির কারণে হাতে ভাজা মুড়ির বেচাকেনায় কিছুটা বিরূপ প্রভাব পড়েছে। মেশিনের মুড়ির কারণে হাতে ভাজা মুড়ি কম দামে বিক্রি করতে হয়। এ কারণে শ্রমিকেরা কম টাকা পাচ্ছেন।এবিষয়ে দপদপিয়া ইউপি চেয়ারম্যান বাবুল মৃধা বলেন, এ অঞ্চলের বেশ কিছু পরিবার মুড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। শুধু মৌসুমের ৩ মাস তাদের মুড়ি ভাজার কাজ থাকলেও বাকি সময় তাদের বেকার বসে থাকতে হয়। আমন ধানের ভাজা মুড়ির জন্য নলছিটি বিখ্যাত। দেশের চাহিদা পূরণ করে দেশের বাইরেও এ অঞ্চলের মুড়ি রপ্তানি হয়।এ প্রসঙ্গে বরিশাল বিসিক শিল্প নগরী কর্মকর্তা মো. গোলাম রসূল (রাসেল) বলেন, এ এলাকায় রাসায়নিক মুক্ত হাতে ভাজা মোটা মুড়ি খুব সুস্বাদু। হাতে ভাজা মুড়ি পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত। চেহারা কিছুটা লালচে। এ মুড়ি তৈরিতে খরচও বেশি। মেশিনের মুড়ি যেখানে পাইকারি ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি হয়, সেখানে হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা কেজি।তিনি বলেন, এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা সমিতি গঠন করে ঋণ নিতে চাইলে, ঋণ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Advertisement