আবু সাঈদ খান ::
প্রায়ই শুনি- তরুণরা এখন রাজনীতিবিমুখ। কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। আসল সত্য হলো, প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে তাদের আগ্রহ নেই। তবে অন্যায়ের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে তারা নির্ভীক। তার প্রমাণ গণজাগরণ মঞ্চ (২০১৩), বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন (২০১৫), কোটা সংস্কার আন্দোলন (২০১৮) এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (২০১৮)। পার্থক্য এই যে, ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৬২-৬৪-এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান কিংবা ‘৯০-এর গণআন্দোলনে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা ছিল, রাজনৈতিক দলগুলোরও ভূমিকা ছিল। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চসহ সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোতে ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা অংশ নিলেও তা তাদের পরিকল্পিত আন্দোলন ছিল না। চূড়ান্ত বিচারে এসব সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ম্ফূর্ত আন্দোলন।
এসব ঘটনাপ্রবাহ থেকে প্রতীয়মান, প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে তরুণদের বেশ দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এসব ছাত্র সংগঠনের নিজস্ব কোনো কর্মসূচি নেই। বাম ছাত্র সংগঠনগুলো সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে সাধারণ ছাত্রদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। ছাত্রনেতারা এখন অভিভাবক রাজনৈতিক দলগুলোর গুণকীর্তনে মশগুল। অন্ধের মতো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করছে। এমনকি ‘লাঠি’ হিসেবেও ব্যবহূত হচ্ছে।
দীর্ঘদিন (প্রায় তিন দশক) ডাকসুসহ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। ফলে সংগঠনগুলোর মধ্যে আদর্শিক রাজনীতি নেই। সাধারণ ছাত্রদের মন জয়ের কোনো চেষ্টাও নেই। যেটি আছে- জোর করে মিছিলে যেতে বাধ্য করা। না গেলে হলে থাকতে পারবে না। এমনকি শারীরিকভাবেও নাজেহাল হতে হবে। বলা বাহুল্য, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই দলের হাতেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিগ্রহের শিকার হতে হয়। এর ফলে ছাত্র রাজনীতি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।
ছাত্রনেতাদের অনেকে এখন বিত্ত-বৈভবে টইটম্বুর। তারা সাধারণ ছাত্রদের ভালোবাসার পাত্র হতে পারছেন না। তারকা খ্যাতিও পাচ্ছেন না। যেমনটি পেয়েছিলেন ষাট-সত্তর-আশির দশকের ছাত্রনেতারা। এ ক্ষেত্রে রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মুশতাক হোসেন, আমানউল্লাহ আমান, খায়রুল কবীর খোকন প্রমুখের কথা বলা যায়। ছাত্রনেতা থাকাকালে তাদের পরিচিতি শিক্ষাঙ্গনে সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা ‘ন্যাশনাল ফিগার’ হয়ে উঠেছিলেন। রাজনৈতিক দলও তাদের মূল্যায়ন করত। তাদের প্রায় সবাই রাজনৈতিক দলে যোগদানের অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পান। অনেকে এমপি-মন্ত্রীও হন। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদ ‘৭০-এ এমএনএ হলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্ব পেলেন। ছাত্রনেতাদের অনেকেই ছিলেন ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা রাজনীতিক।
পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর ও আশির দশকে রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল তারুণ্যের প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং আশি-নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তারুণ্যই ছিল প্রাণশক্তি। তবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনও কখনও তরুণদের বিপজ্জনকও মনে করে। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের ওপর স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী নাখোশ ছিলেন। তার চোখে তরুণ বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড ছিল হঠকারী। যে কারণে ক্ষুব্ধ গান্ধী জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপনে বিরত ছিলেন। ভারতকে এ গ্লানি থেকে বাঁচিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি এই নির্মমতার প্রতিবাদে ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেন। ১৯৪৭-উত্তরকালেও মুসলিম লীগ নেতৃত্ব পূর্ব বাংলার তরুণ তুর্কিদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। তখন শামসুল হক, শেখ মুজিব, কমরুদ্দিন আহমদ, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহাসহ তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। মুসলিম লীগের সঙ্গে এদের বিরোধ চরমে ওঠে। এরই পরিণতিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়) গঠন করা হয়। স্বাধীনতা-উত্তরেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ যুব-ছাত্রনেতারা জাসদ গঠন করেন। এমন দৃষ্টান্ত আরও আছে। প্রবীণের সঙ্গে তরুণের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। তারপরও রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত করতে হবে। এ ভিন্ন রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের সুযোগ নেই।
এখন রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য তরুণদের উপস্থিতি আছে। তবে তারুণ্যের স্পর্ধিত দাপট নেই; ছাত্রনেতাদের মধ্যে নেই তারকা খ্যাতি। এ কারণেই রাজনীতি প্রাণপ্রাচুর্য ও জৌলুস দুই-ই হারাতে বসেছে। এমনই পটভূমিতে রাজনীতিতে সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ীরা জেঁকে বসেছেন। এখন আসছেন তারকারা।
ক্রিকেট, নাটক, সিনেমা কিংবা সঙ্গীত ভুবন থেকে তারকারা রাজনীতিতে ভিড় করছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারকা খুঁজছে রাজনৈতিক দলগুলোও। তারকাদের বরণ করে নিচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি জাতীয় পার্টিও। এ রাজনীতির পথিকৃৎ প্রতিবেশী ভারত। বিগত নির্বাচনে বিজেপি চমক দেখিয়েছিল, তারকাদের দলে ভিড়িয়েছিল। তাদের মধ্য থেকে কণ্ঠশিল্পী বাবুল সুপ্রিয় ও অভিনেত্রী স্মৃতি ইরানী মন্ত্রী হয়েছেন। তবে তামিলনাড়ূর রাজনীতি বরাবরই তারকা-শোভিত। সেখানে এমজি রামচন্দ্রন, জয়ললিতা, করুণানিধির পথ ধরে নতুন করে সক্রিয় হয়েছেন রজনীকান্ত, কমল হাসান প্রমুখ। সম্প্রতি তারকাদের টেনে এনেছে তৃণমূল কংগ্রেসও। কবীর সুমন, দেব প্রমুখ তারকা তৃণমূল কংগ্রেসে নাম লিখিয়ে সাংসদ হয়েছেন। পিছিয়ে নেই পশ্চিমা দুনিয়াও। রিয়েলিটি শোর ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
এবার জাতীয় নির্বাচনে ফারুক, কবরী, মমতাজ, রিয়াজ, ফেরদৌস, শমী কায়সার, রোকেয়া প্রাচী, জ্যোতিকা জ্যোতি, ক্রিকেটার মাশরাফি, সাকিব আল হাসানসহ এক ঝাঁক তারকা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মমতাজ বিগত সংসদেও এমপি ছিলেন। এবারও এমপি হয়েছেন। ফারুক ও মাশরাফি এবার এমপি হয়েছেন। সঙ্গীতশিল্পী বেবী নাজনীন, কনকচাঁপা বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে ভোটযুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। মনির খান মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপি ছেড়েছেন। জাপা থেকে অভিনেতা সোহেল রানা প্রার্থী হয়েছিলেন। সংরক্ষিত নারী আসনের মহাজন এখন আওয়ামী লীগ। তাই আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছেন কবরী, মৌসুমী, অপু বিশ্বাস, রোকেয়া প্রাচী, জ্যোতিকা জ্যোতি ও শমী কায়সার। এদের সবাই আওয়ামী লীগ রাজনীতির অনুসারী কি-না, তা নিয়ে সংশয়ও আছে। সে বিতর্কে যেতে চাই না। রাজনীতি করার অধিকার সবারই আছে। তবে তাদেরকে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফারুক ছাত্র রাজনীতিতে ছিলেন। কবরীও অভিনয় জীবন ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে এমপি হয়েছিলেন। তাদের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলছি না। কিন্তু যারা ক্যারিয়ারের শুরুতে বা মাঝপথে রাজনীতিক হতে চাইছেন, তাদের আগমন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। তারা রাজনীতিতে কী ভূমিকা রাখবেন, জানি না। তবে রাজনীতিতে নাম লেখানোর এ প্রবণতা সাংস্কৃৃতিক অঙ্গনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে ক্রিকেট তারকা মাশরাফি বিন মুর্তজার কথা বলা যায়। খেলার মাঠ থেকে রাজনীতির মাঠে চলে গেলেন। সাকিব আল হাসানও আওয়ামী লীগের মনোয়ন চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কারণ, ক্রিকেটে তার আরও বহু দূর যাওয়ার আছে। আমার মনে হয়, এমন উপদেশ মাশরাফির জন্যও প্রযোজ্য ছিল। ক্রিকেটকে তার আরও অনেক কিছু দেওয়ার ছিল। অবসর নেওয়ার পরও ক্রিকেট ব্যবস্থ্থাপনায় ভূমিকা রাখতে পারতেন। তা হলো না। কেউ কেউ বলছেন, ক্রিকেট ও রাজনীতি দুই ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখবেন। বাস্তবে তা কতটুকু সম্ভব?
শুধু মাশরাফি নয়, মনোনয়নের জন্য ভিড় করা উদীয়মান শিল্পীদের স্ব-স্ব অঙ্গনে ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। তা উপেক্ষা করে তারা কেন এমপি হতে চাইছেন? এর কারণ কি এই যে, এমপি-মন্ত্রী হলে দ্রুত বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়া যায়? এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও ব্যবসায়ী, এমনকি পেশাদার রাজনীতিকদের একাংশ শামিল হয়েছেন। এ প্রতিযোগিতায় খেলোয়াড়-শিল্পীদের দেখতে চাই না। চাই তারা স্ব-স্ব অঙ্গনকে আলোকিত করুন। আর রাজনীতি করতে হলে পছন্দের দলে নাম লিখিয়ে আগে তালিম নিন, তারপর মনোনয়ন চান; তখন কারও কিছু বলার থাকবে না। সবারই মনে রাখা দরকার- রাজনীতিক হওয়ার পথপরিক্রমা আছে; শর্টকাট রাস্তা নেই। এটি মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বুঝলেই হবে না শুধু। তা সর্বাগ্রে বুঝতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই।
নীতিনির্ধারকদের আরও বুঝতে হবে- রাজনীতিতে তারকাদের চেয়ে তারুণ্যই বেশি জরুরি।
সাংবাদিক ও লেখক
ask_bangla71@yahoo.com