ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতিশীল ওষুধ রেমদেসিভির উৎপাদনে যাচ্ছে বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। এ মাসেই এই পরীক্ষামূলক অ্যান্টিভাইরাল ওষুধটি উৎপাদন করবে দেশের বৃহৎ এই ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তার বরাতে এ খবর দিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। নিউ ইয়র্ক টাইমসও খবরটি প্রকাশ করেছে।
খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের গিলিয়াড সাইয়েন্সেস এই ওষুধের মূল প্রস্তুতকারী। কভিড-১৯ রোগের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা দেখিয়েছে রেমদেসিভির। গিলিয়াডের নিজস্ব পরীক্ষায়ও দেখা গেছে যে, এই ওষুধ সেবনে রোগীদের পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এরপর গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কর্তৃপক্ষ এই ওষুধের আপৎকালীন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে রেমদিসিভির ব্যবহারের পথ খুলে যায়।
বেক্সিমকো’র চিফ অপারেটিং অফিসার রব্বুর রেজা রয়টার্সকে বলেছেন, বেক্সিমকো এই মাসেই ওষুধ উৎপাদনে যাচ্ছে। আর প্রথমেই সরবরাহ করা হবে দেশে। মানুষের শিরায় প্রবেশ করিয়ে এই ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি ডোজ ওষুধের দাম পড়বে ৫-৬ হাজার টাকা। আর গুরুতর অসুস্থ রোগীদের মোট ৫ থেকে ১১ ডোজ প্রয়োজন হতে পারে। তবে তিনি এ-ও বলেছেন, রোগীর ঠিক কতটুকু প্রয়োজন হতে পারে, তা গবেষণা সম্পন্ন হলেই বলা যাবে। আমরা আশা করছি, এই ওষুধের দামে কিছু ভর্তুকি দেওয়ার চেষ্টা করবে বাংলাদেশ সরকার।
খবরে বলা হয়, রোগের তীব্রতার উপর নির্ভর করবে রোগীর কতটুকু ওষুধ প্রয়োজন হবে। বেক্সিমকো যেই মূল্য নির্ধারন করার পরিকল্পনা করছে, সেই অনুযায়ী একটি পূর্ণ কোর্সের জন্য একজন রোগীর খরচ হতে পারে ২৫ থেকে ৬৬ হাজার টাকা। রেমদেসিভিরের দাম কেমন হতে পারে, তার প্রথম আভাস পাওয়া যায় বেক্সিমকোর এই মূল্য থেকে। মূল উৎপাদনকারী গিলিয়াড তাদের ১৫ লাখ ডোজের প্রথম ব্যাচ যুক্তরাষ্ট্রের রোগীদের জন্য দান করবে। তবে এরপর এই ওষুধের দাম কেমন পড়বে, তা এখনও জানায়নি তারা।
ইন্সটিটিউট ফর ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক রিভিউ (আইসিইআর) কোনো ওষুধের কার্যকারিতার ভিত্তিতে যৌক্তিক মূল্য নির্ধারন করে। সংস্থাটি বলছে, ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় রেমদেসিভির ভালো কার্যকারিতা দেখালে, ১০ দিনের কোর্সের দাম পড়বে সর্বোচ্চ ৪৫০০ ডলার বা ৩ লাখ ৮২ হাজার ডলার।
তবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে দাম এতটা হবে না। এক্ষেত্রে রয়টার্স জানায়, রেমদেসিভির উৎপাদনের প্যাটেন্ট রয়েছে গিলিয়াডের। ফলে নিয়মানুযায়ী, তাদেরই এই ওষুধ প্রস্তুতের একচেটিয়া সত্ত্ব রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ সহ জাতিসংঘ স্বীকৃত স্বল্পোন্নত দেশগুলো এসব প্যাটেন্ট বা সত্ত্ব অগ্রাহ্য করতে পারবে। ফলে এসব দেশ সহনীয় মূল্যে ওষুধ উৎপাদন করতে পারে।
প্রসঙ্গত, এর আগে বেক্সিমকো কভিড-১৯ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতিশীল আরেক অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ফাভিপিরাভির ও ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনও উৎপাদন করছে। রব্বুর রেজা জানান, বাংলাদেশ এই ওষুধ অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোতেও এই ওষুধ রপ্তানি করতে পারবে। এছাড়া ইউরোপের কিছু দেশ ইতিমধ্যেই এই ওষুধ আমদানি করার আগ্রহ প্রকাশ করে বেক্সিমকোকে চিঠি লিখেছে। তবে তিনি ওই ইউরোপিয় দেশগুলোর নাম জানাতে রাজি হননি। তার ভাষ্য, ‘আমরা জরুরী পরিস্থিতিতে এই ওষুধ রপ্তানির জন্য সরকারের অনুমোদন চাইতে পারি। তবে আমাদের আগে অবশ্যই আমাদের নিজ জনগণের জন্য সরবরাহ করতে হবে। এটি আমাদের জন্য এক নম্বর অগ্রাধিকার।’
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১০৯২৯ জন আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। মারা গেছেন ১৮৩ জন। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, দেশটিতে পরীক্ষা সীমিত হওয়ায় প্রকৃত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে।
রেমদেসিভির প্রথমে ইবোলা ভাইরাসের চিকিৎসায় প্রস্তুত করা হয়েছিল। তবে তখন খুব একটা কাজ করেনি এই ওষুধ। তবে এই ওষুধ নতুন এই করোনাভাইরাস সহ কিছু ভাইরাসের পুনঃউৎপাদনের প্রক্রিয়াকে অকার্যকর করে দেয়। ফলে রোগীর ইমিউন সিস্টেমকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতে ব্যর্থ হয় ভাইরাস।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটস অব হেলথ যেই পরীক্ষা চালিয়েছে, তাতে দেখা যায় সাধারণ রোগীদের তুলনায় এই ওষুধ সেবনকারী রোগীদের হাসপাতালে থাকার হার ৩১ শতাংশ কমে যায়। অর্থাৎ রোগীরা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেন। তবে এই ওষুধ সেবনে মৃত্যুর হার খুব একটা কমেনি।
রব্বুর রেজা জানান, বেক্সিমকো মে মাসের মাঝামাঝি এই ওষুধ বাজারজাতকরণের অনুমতি পাবে বলে আশা করছে। এরপর থেকে সরকারের মাধ্যমে বিতরণের জন্য এই ওষুধ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করবে প্রতিষ্ঠানটি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার যতটুকু চায় তার ওপর নির্ভর করে আমরা ওষুধ উৎপাদন করবো।’ তিনি যোগ করেন, স্থানীয় হাসপাতালগুলোর চাহিদা নিরূপনে কাজ চলছে। তিনি আরও জানান, একটি চীনা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করছে। চুক্তি অনুযায়ী যেই উপকরণ আসবে, তা দিয়ে ১ লাখ ইউনিট উৎপাদন করা সম্ভব।
ঢাকা-ভিত্তিক বেক্সিমকো ফার্মা যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত মোট ৫০টি দেশে জেনেরিক ওষুধ রপ্তানি করে। সাধারণ জেনেরিক ওষুধ থেকে শুরু করে জটিল মলিকিউলসও উৎপাদন করে বেক্সিমকো। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও বিকন ফার্মাসিউটিক্যাল সহ আরও ৭টি বাংলাদেশি ওষুধ কোম্পানি এই ওষুধ উৎপাদনের সরকারি অনুমতি পেয়েছে। বাংলাদেশ ওষুধ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আপাতত, আমরা এসব কোম্পানিকে রেমদেসিভির রপ্তানি করার অনুমতি দেব না। প্রথমত, তাদেরকে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতে হবে। এরপর রপ্তানির বিষয়টি আমরা বিবেচনা করবো।’
প্রতিবেশী ভারতে স্থানীয় ওষুধ নির্মাতা সিপলা লিমিটেড জানায়, তারাও রেমদেসিভির, ফাভিপিরাভির ও বোলাক্সাভির নামে ৩টি অ্যান্টিভাইরাল উৎপাদনে কাজ করছে। তবে কবে এই ওষুধ বাজারে আসবে, বা এর দাম কত হবে, তা জানাতে রাজি হয়নি তারা।