রোহিঙ্গা হলেই কি বাংলাদেশি?

।। মিজানুর রহমান ।।

সৌদি আরবে বছরের পর বছর ধরে বসবাসরত অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফেরানোর আচমকা এক চাপে পড়েছে ঢাকা। এ নিয়ে অনেকদিন ধরেই ভ্রাতৃপ্রতিম দুই দেশের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চাপ এতোটাই প্রবল হয়েছে যে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এটি নতুন টানাপড়েন তৈরির আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। জুনিয়র লেভেলে রিয়াদ ঢাকার প্রতি যে বার্তা দিয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ সৌদি প্রবাসী রোহিঙ্গাদের গ্রহণে রাজি না হলে সাধারণ বাংলাদেশিরা বিপাকে পড়বেন। যারা নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়েছেন তাদের ফেরত পাঠানো হবে। চাপটি ক্রমেই রাজনৈতিক চাপে পরিণত হতে পারে- এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে ঢাকার পেশাদার কূটনীতিকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। মানবতার প্রতি দরদ থেকে বাংলাদেশ সরকার এটি করেছে। তাই বলে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মিয়ানমারের ঝুঁকিপূর্ণ ওই জনগোষ্ঠীর গন্তব্য বাংলাদেশ হতে পারে না! রিয়াদের প্রতি প্রশ্ন রেখে তারা বলেন, বর্মী বর্বরতা থেকে প্রাণে বাঁচতে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছে।

তাদের ফেরানোর জন্য ৩ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় ফোরামে চেষ্টা করছে। কিন্তু মুসলিম উম্মার নেতৃত্বদানকারী সৌদি আরবের এ ইস্যুতে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা নেই। আজ অবধি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে রিয়াদ একটি বাক্যও ব্যয় করেনি। উল্টো এখন ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট দিতে দেশটি অযৌক্তিকভাবে বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে। অথচ ওই রোহিঙ্গারা ৩০-৪০ বছর ধরে সৌদি আরবে অবস্থান করছে এবং সৌদি আরব নিজেই এরমধ্যে অনেককে নিয়ে গিয়েছিল। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে জানান, রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহ স্বপ্রণোদিত হয়ে ৮০ ও ৯০-এর দশকে অনেক রোহিঙ্গাকে নিয়ে গেছেন। অনেকে সরাসরি গেছে। কেউ কেউ হয়তো বাংলাদেশ হয়ে গেছে। কিন্তু এতো বছর পর তাদের কেন বাংলাদেশে ফেরাতে হবে? মন্ত্রী বলেন, এখন তারা বলছে, ৫৪ হাজার রোহিঙ্গার পাসপোর্ট নেই, কাগজ নেই। তাদের তোমরা পাসপোর্ট ইস্যু করো। আমরা বলেছি, যারা আগে পাসপোর্ট পেয়েছে তাদের ডকুমেন্ট দেখাতে পারলে নতুন পাসপোর্ট ইস্যু করবো, অন্যথায় নয়। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের কেউ নয় উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, কেন রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে ফেরাবো? বাংলাদেশের নাগরিক না হওয়ার পরেও কীভাবে সৌদি আরব পাসপোর্ট ইস্যু করতে চাপ দিতে পারে? এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, এ নিয়ে আমার মন্তব্য করা মুশকিল। রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট না দিলে অন্য বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর হুমকি প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, এই কথাগুলো এসেছে কিন্তু আমার মনে হয় এটা যুক্তিতে টিকবে না। পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি বিষয়টি দেখভাল করছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সৌদি আরবের কিছুটা তাগাদা আছে। তারা বলছে, নাগরিকত্বহীন কোনো ব্যক্তি তারা রাখবে না। আমাদের বলেছে, তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করতে। আলোচনা চলছে, দেখা যাক কী হয়। স্মরণ করা যায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান মালয়েশিয়া হয়ে অনেক রোহিঙ্গা সৌদি আরবে গেছেন। অন্য দেশ তাদের পাসপোর্ট বা ট্রাভেল পাসে বার্মিজ মুসলিম স্পষ্ট করে লিখে দিয়েছিল এবং তারা তা আর নবায়ন করেনি। কিন্তু বাংলাদেশ দূতাবাস এবং পাসপোর্ট অফিসের অসাধু চক্র পরবর্তীতেও রোহিঙ্গাদের অনেক পাসপোর্ট ইস্যুতে সহায়তা করায় আজ এতো বছর পর নতুন করে জটিলতায় পড়েছে ঢাকা। তাছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই এমন দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টাও রোহিঙ্গাদের ফেরানোর চাপের অন্যতম কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের কেউ কেউ।

Advertisement