লিনু ফারজানা
বহু বছর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকা লাতুর ট্রেন লাইনের পুনঃসংস্কার শুরু হওয়ায় জুড়ি, বড়লেখা,কুলাউড়া, লাতুর হাজারো মানুষের মত আমিও পুলকিত।
রেলগাড়ি ঝমাঝম,
পা পিছলে আলুর দম।
ইষ্টিশনের মিষ্টি কুল,
শখের বাগান গোলাপ ফুল।
শেষবার ট্রেনে চড়ার স্মৃতিটা স্মৃতির ফাইল থেকে পুরোপুরি গায়েব হয়নি এখনো।
পঁচিশ বছর আগের ধুলিধুসর এক অমলিন স্মৃতি উঁকি দেয় মনের গহিনে। বড়লেখার পড়াশোনার পাঠ শেষ করে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে বাক্স পেটরা নিয়ে এই লাতুর ট্রেনেই এসেছিলাম সিলেটে।
দুই সিনিয়র আপা শুভা দিদি ও শাহানা আপা ছিলেন সেদিনের যাত্রাসঙ্গী। সকাল আটটায় ট্রেনে চড়ে বসলেও বছরের প্রথম গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে সিলেটে এসে পৌছলাম শেষ বিকেলে, একেবারে সন্ধ্যা হয় হয় তখন।
সাথে নিয়েছিলাম একটা বই, কুলাউড়া আসতে না আসতেই পড়া শেষ হয়ে যায় বইটা।
ইঞ্জিন বদলানো ও আনুষঙ্গিক কাজের বিরতির পর কুলাউড়া থেকেই শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের সিলেট অভিমুখী যাত্রা। ধীর গতিতে এগিয়ে চলা ইঞ্জিনের ঠেলা গাড়ির এই যাত্রা মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তিকর ছিল।
পথ না যতটুকু দীর্ঘ যাত্রা ক্ষণ ছিল তার চেয়ে অনেক দীর্ঘ। সেদিন ভেবেছিলাম এই জীবনে লাতুর ট্রেনে চড়বনা। মনে মনে বলা সেই কথাটা মনে হয় সত্যি হয়ে গেল। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেল। আর চড়া হলনা ট্রেনটা।
শেষ ট্রেন যাত্রার ক’বছর পর হঠাৎ শুনি এই লাইনে ট্রেন আর চলেনা। কবে চলবে কেউ জানেনা। শেষ ট্রেনের স্মৃতিটা সেদিন মুহুর্তেই বিরক্তিকর থেকে সুখকর হয়ে গেল।
এই ট্রেনের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের ভাইবোনদের ছেলেবেলার সবচেয়ে মধুরতম স্মৃতি।
মাত্র দুই স্টেশন পেরিয়ে তিন নম্বর স্টেশন জুড়িতে ছিল আমাদের নানাবাড়ি। আব্বা চাকুরী সুত্রে ঢাকায় থাকতেন। তাই নানাবাড়িতে আমাদের যাওয়া হত বেশি।
আমার আম্মার কাছে বাপের বাড়ি ভ্রমনের চেয়ে সুখকর এই দুনিয়ায় মনে হয় কিছু ছিলনা। স্কুল বন্ধ হউক না হউক কোন ছুতোয় বাপের বাড়ি যেতে পারলেই সেরেছে। দুই দিনের কথা বলে এক সপ্তাহ থাকা কোন ব্যাপারই না।
নিজের পরিকল্পনা তো নিজে জানতেন, তাই প্রতিবার আমাদের বই খাতা ব্যাগে ভরতে ভুলতেন না। আম্মার বাপের বাড়িতে অধিক অবস্থানের কারণে পরিক্ষায় ক্রমাবনতি আব্বা কোন ভাবেই মেনে নিবেন না। যাই হউক, ঘন ঘন নানা বাড়ি ভ্রমণের আনন্দটাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে দিত ট্রেনের জার্নি।
সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে আম্মা সবকিছু গুছিয়ে রেডি। নতুন জামা জুতা পরে সবাই মিলে পায়ে হেঁটে রেল স্টেশনে রওনা হতাম। মাইল দেড়েক দুরের স্টেশনে যেতে কম করে হলেও এক ঘন্টা লাগতো।
শীতের সময় ধানের খালি জমি দিয়ে শুকনো ন্যারা মাড়িয়ে বন কোনাকোনি একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া যেত। বেশ দুর থেকে চোখে পড়তো লাল রঙের আউট সিগনাল।
সিগনাল নামানো দেখলেই বুক ধুকপুক করতো, হায় আল্লাহ এই বুঝি ট্রেন এসে পড়লো। আম্মা তাড়া দিতেন, জোরে পা চালাও, ট্রেন এসে যাবে।
অনেক সময় স্টেশনে পৌছতে না পৌছতেই ট্রেন ছেড়ে যায় যায় অবস্থা। লটকা লটকি করে ট্রেনে উঠার পর কি অপার শান্তি! নানা বাড়ি যাওয়া আর সময়ের ব্যাপার মাত্র।
উল্টো ঘটনাও ঘটতো। হয়তো সকাল থেকে বসে আছি, ট্রেন তো আসেনা।
একটু পরপর স্টেশন মাস্টারের রুমে উঁকি দেই আর খবর নেই ট্রেনের। এই আসলো, এই আসবে বলে স্টেশনমাস্টার ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখেন।
অনেক্ষন পর খাকি কাপড় পরা একটা লোক ঘন্টা বাজায়। আমরা সবকিছু নিয়ে একেবারে রেললাইনের পাশে গিয়ে দাড়াই। লম্বা হুইসেল দিয়ে ট্রেন আসলে সে কি তাড়া! কে কার আগে উঠবে। কেউ ট্রেনের জানালা দিয়ে কেউ ট্রেনের দরজা দিয়ে যেমনে পারে উঠে। ঠেলাঠেলিতে দুর্ঘটনাও কম ঘটতো না।
বেরসিক ট্রেনের অনাকাংখিত বিলম্বে যারপরনাই ব্যাথিত হতাম। খালি মনে হত ট্রেনটা যদি আজ না আসে তাহলে ফিরে যেতে হবে বাড়িতে। পরের দিন যদিও আবার যাওয়া হবে নানাবাড়িতে, একদিন কম থাকা হবে। ইশ! কি কষ্টের। যদিও শেষমেশ ট্রেনটা আসতো। আমাদের জমে যাওয়া নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হত। অনেক দেরীতে গিয়ে নানাবাড়িতে পৌছালেও একটুও খারাপ লাগতোনা। ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট ছিলনা। সেকেন্ড ক্লাস,থার্ডক্লাস ও মালবাহী কতগুলো বগি থাকতো। লোকে লোকারন্য ট্রেনে মানুষের উত্তেজিত বাক্য বিনিময়, ঝগড়াঝাঁটি ছিল নিত্যকার ঘটনা। ঐ ট্রেনে এক শ্রেণীর ফেরিওয়ালা ছিল। এদের বলা হত ক্যানভাসার। বিচিত্র গলায় ছন্দ মিলিয়ে ইদুরের ঔষধ, কৃমির ঔষধ আরো কত কি বিক্রি করতো। দুই ইঞ্চি মাপের শক্ত কাগজে বড়লেখা টু জুড়ি লিখা টিকেট চেক করতে টিটি মশাই আসতে না আসতেই আমাদের জুড়ি চলে আসতো। বিশেষ পোশাক পরা টিটি কে দেখলেই কেমন ভয়ভয় করতো। টিটিদের সাইজটাও মাশাল্লাহ ছিল সেই রকম দশাসই।
কাঠালতলীর পর দক্ষিণ ভাগ পেরিয়ে সবুজ টিলা আর চা বাগানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেত আমাদের স্বপ্ন যাত্রা। চালবন, বাছির পুর, হরিরামপুর স্কুল দেখা যাচ্ছে। আম্মার চেহারা ছবির পরিবর্তন হচ্ছে অতি দ্রুত। জুড়ি স্টেশন আসার আগেই আমরা ব্যাগ নিয়ে রেডি। ট্রেনের দরজায় দাড়িয়েই চোখে পড়তো নানাজিদের পরিচিত রিক্সা ড্রাইভার ঢুফি মামা। ঢুফি মামা দূর থেকে আমাদের দেখে হাত উঠাতেন। মনে হত ঢুফি মামা জানতেন আমরা আসবো। আসলে সে রকম কিছু ছিল না। ঢুফি মামা তার নিয়মেই স্টেশনে যাত্রী নিতে দিতে আসতেন। দুই মিনিটে তুফান বেগে আমাদের ঢুফি মামার রিক্সা গিয়ে পৌছতো নানাজির বাসার উঠানে। রিক্সার কানফাটানো বেল সেই সাথে ঢুফি মামার মুখ দিয়ে বাজানো নানা ভঙ্গিমায় পিপপিপ শব্দে নানিজি বেরিয়ে আসতেন। হাফ ডজন মেয়ের মধ্যে আর কেউ না হউক বিনা নোটিশে আমার আম্মা যে যখন তখন হাজির হবেন সেটা মোটামুটি নিশ্চিত থাকতেন নানিজি।
যাওয়াটা হতো যত আনন্দের ফিরে আসাটা হতো তার চেয়ে অনেক গুণ বিষাদের। একই ট্রেন চড়ে ফিরে আসা কিন্তু সবকিছু কেমন অচেনা লাগতো। বড়লেখা রেল স্টেশনের সেই শাখা ছড়ানো কৃষ্ণচুড়া, শিরিষ গাছগুলোর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করতো না। অথচ সপ্তাহ খানেক আগে জুড়িতে যাওয়ার দিন এই গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রামের মুহুর্তটা কতই না আনন্দের ছিল। নানা বাড়ি থেকে ফিরে আসার কষ্টে গাছ গুলোকে বড়ই শ্রীহীন লাগে। বড়লেখা নেমে এইবার পায়ে হেঁটে নয় রিক্সা করে বাড়ি যাওয়া। তারপরও আমাদের ক্লান্তি ছুটেনা। মন ভালো হতে আম্মার আরো দিন দুয়েক লাগে।
বাড়ির সামনের ও পিছনের পুকুরপাড় থেকে মাঝেমাঝে দুরের ট্রেনের হুইসেল শুনা যেত। হুরুদাদি বলতেন, আজকে নিশ্চয় কেউ আসবে ঢাকা থেকে, এইজন্য ট্রেনের এত লম্বা ডাক। কর্মসুত্রে একা বা পরিবার নিয়ে বাড়ির বেশিরভাগ সদস্য ঢাকা থাকেন। দ্রুতগতির ইন্টারনেট বা মুঠোফোন না থাকায় তৎক্ষনাৎ খবর দিয়ে আসা অনেক সময় সম্ভব হতনা। ট্রেনের লম্বা স্বরের হুইসেল তাই আমাদের আশা জাগাতো। কাকতালীয় ভাবে কখনোবা হরু দাদির কথা মিলে যেত।
পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে যখন বড় স্কুলে গেলাম তখন তো রেল লাইনের সাথে নিত্য যোগাযোগ। প্রতিদিন রেলের স্লিপারে লম্বা পা ফেলে অর্ধেক পথ যাই। রেলের দুটো ছোট ছোট ব্রিজ। এগুলো পেরুতে অনেক ভয় লাগতো এই বুঝি ট্রেন চলে আসবে। ট্রেন আসতে থাকলে লাইনে কান পাতলে ট্রেনের ঝকঝক শব্দ শুনা যেত। কখনো সিগনাল দেখেও বুঝতাম ট্রেন আসবে। গেইট বিহীন রেলক্রসিং গুলো অনেক অরক্ষিত ও বিপদসংকুল ছিল।
আমরা খুব বিশ্বাস করতাম রেলের পুলের নিচে খুব শয়তান এক ভুত আছে। আসলে এইটা ভুত না একটা পেত্নী।
সহপাঠীদের অনেকেই বলতো তাদের বাবা চাচারা ভর দুপুরে বা রাত দুপুরে পেত্নীটাকে দেখেছেন। আমার মনে হত ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে পেত্নীটা মরে না কেন? শয়তান পেত্নীটা দুপুর বেলা কাউকে একা পেলে পানিতে ফেলে দেয়। তাই কখনো একা এই পুলে উঠতাম না।
না জানি কখন পেত্নীর খপ্পরে পড়তে হয়!
স্কুল থেকে ফিরে আসার সময় রেল লাইন থেকে সুন্দর সাইজের পাঁচটা পাথর কুড়িয়ে আনতাম প্রায়ই। এই পাথর দিয়ে খেলা হত ফুলগুটি। ফুল ফুল ফুলটি, একসাথে দুলটি- কি ছন্দময় খেলা আমাদের। চুলের ঝুঁটিতে টান পড়লে খেলায় ছন্দপতন ঘটতো। অতিরিক্ত খেলার কারনে এই শাস্তি অবধারিত হত মাঝেমধ্যে।
মাসে একবার ভারতীয় মালবাহী একটা লম্বা ট্রেন চলতো এই লাইনে। কালো ধোয়া উড়িয়ে যাওয়া এই ট্রেন কে আমরা বলতাম কয়লার ইঞ্জিন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুনতাম কয়লার ইঞ্জিনের বগিগুলো। উত্তম-সুচিত্রার সিনেমার ট্রেনের মত দেখতে এই ট্রেন দর্শনে আমরা কম রোমাঞ্চিত হতাম না।
হাইস্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হলে রেললাইন ধরে যাত্রাপথ আরো কিছুটা বাড়লো। আমাদের সহপাঠী যারা শাহবাজপুর বা মুড়াউল থেকে ট্রেনে করে আসতো তাদেরকে ট্রেন মাঝপথে কলেজের সামনে নামিয়ে দিত।
ছাত্রছাত্রীদের জন্য রেল কতৃপক্ষের এই বদান্যতা আসলেই অনেক বড় প্রাপ্তি।
অনেক অবাঞ্চিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সাক্ষীও আমাদের এই ট্রেন। দুঃখি মানুষের ইচ্ছাকৃত আত্মহনন বা অসাবধানি মানুষের মৃত্যুও কম হয়নি এই রেলের চাকায়।
ট্রেনের ছাদে আয়েশি ভ্রমন, দমকা বাতাসের মধ্যে এক কম্পার্টমেন্ট থেকে আরেক কম্পার্টমেন্টে যাওয়ার সময় মাঝখানের জোড়ায় পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু ও অঙ্গহানির ঘটনাও অনেক ছিল।
হাজারো অম্লমধুর স্মৃতির এই লক্কড় ঝক্কড় ট্রেন আবার চলবে এই খুশিতে ফিরে গেলাম হারিয়ে যাওয়া দিনে। স্মৃতি হাতড়ে পেলাম কিছু মুল্যবান স্মৃতি।
যেদিন প্রথম ট্রেনটা চলবে আমিও আম্মার মত আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে খুব ভোরে ট্রেনে পাড়ি জমাবো বড়লেখায়। হয়তো পুরনো দিনের অনেক কিছু থাকবেনা, রিক্সা নিয়ে ঢুফি মামা ও থাকবেনা।
আমার নানাবাড়ির উঠান নয় ছেলেমেয়েদের নানা বাড়ির উঠানে গিয়ে নামবো ময়না চাচার রিক্সায়।
আম্মার মত বিরস মুখে নয় ট্রেন চড়ার খুশিতে আটখানা হয়ে পরের দিন ফিরে আসবো সিলেটে। অপেক্ষায় দিন কাটুক তারপরও আসুক লাতুর ট্রেন চড়ার সেই সুখকর দিন।