ব্রিট বাংলা ডেস্ক : ‘ট্যাকটিকসবিহীন স্ট্র্যাটেজি হলো বিজয়ের মুখ দেখার সব থেকে মন্থরতম রুট। আর স্ট্র্যাটেজিবিহীন ট্যাকটিকস হলো পরাজয়ের আগে অনেক শব্দ তৈরি করা’।
সান জু, চীনা মিলিটারি জেনারেল এবং স্ট্র্যাটেজিস্ট, পঞ্চম শতাব্দী।
গত ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনা করেছেন । এটা বলা হয়েছে যে, ওই টেলিফোন আলাপের সময় কোভিড-১৯ সংকট মোকাবেলায় তিনি শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।
বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের সূত্র অনুযায়ী, উভয় নেতা ‘সকল জাতির সার্বভৌমত্ব নিশ্চয়তাদানকারী একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ভারত-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চল’ গড়ে তুলতে তাদের অভিন্ন অঙ্গীকার আলোচনা করেছেন । এই অঙ্গীকারের মধ্যে রয়েছে সাগরভিত্তিক এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং বৈশ্বিক শান্তিরক্ষা। মার্কিন দূতাবাস আরো বলেছে, ‘উভয় নেতৃবৃন্দ তাদের অভিন্ন মূল্যবোধ এবং স্বার্থের সমর্থনে অব্যাহতভাবে তাদের দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে তারা অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।’
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর তরফে শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করার সময়টা বেছে নেয়া ইন্টারেস্টিং। এই গল্পের নেপথ্যে রয়েছে মার্কিন বিদেশনীতিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কোন বিদেশনীতি বা তেমন কিছু আদৌ ছিল কিনা, সেদিকে নজর দেওয়া।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক দশকের পুরোটাই মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ সংক্রান্ত স্ট্র্যাটেজি এবং তার বৈদেশিক নীতির পুরোটাই ওই অঞ্চলে মনোনিবেশ করেছে। যার মূল লক্ষ্য থেকেছে ইসরাইলকে সুরক্ষা বেষ্টনী দিয়ে চলা। এই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ এশিয়ায় তারা যে নীতির বাস্তবায়ন করেছে, সেটা আস্থার সঙ্গে বলা যায়, তা ব্যর্থতাই বয়ে এনেছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঘোষিত ‘পিভোট টু এশিয়া’ কিংবা ‘এশিয়া-প্যাসিফিক রি- ব্যালেন্সিং’ কোনো কাজ করেনি ।
সেই নীতি চীনের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়নি কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে কোন সহায়তা দেয়নি । এবং তার বেশিরভাগটাই মূলত রাজনৈতিক বাগড়ম্বর এবং বলা চলে অতি অল্প কিংবা কোনো সারবত্তা নেই।
চতুর্ভুজ বা দি কোয়াড
এরপরে এলো, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চর্তুপক্ষীয় নিরাপত্তা সংলাপ, যা সাধারণভাবে ‘কোয়াড’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এটি চারটি দেশের একটি জোট । এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া , জাপান এবং ইন্ডিয়া । এই চতুর্মুখি জোটেরও অপরিহার্য দর্শন হচ্ছে চীনের অবিস্মরনীয় প্রবৃদ্ধি এবং তার গতিময়তার বিপরীতে একটি দৃশ্যমান প্রতিসাম্য (কাউন্টারব্যালেন্স) তৈরি করা।
খুবই বোধগম্য কারণে ট্রাম্প প্রশাসন এমন একটি এশিয়ার ধারণা পছন্দ করেনি, যেখানে একটি উচ্চাভিলাষী চীন কর্তৃত্ব করে যাবে, যেখানে তারা তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বিআরআই বাস্তবায়ন করবে এবং তাদের দক্ষিণ এশীয় দ্বীপমালাকে সুগঠিত করবে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বেশ ভালো কথা । কিন্তু চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এই অঞ্চলে তাকে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ এনে দেবে।
এভাবেই একটি সুনিশ্চিত এবং নিরাপদ এশিয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, চীনকে প্রতিহত বা কাউন্টারব্যালেন্স করার জন্যে । আর সে কারণেই কোয়াড, একটি নিরাপত্তা কৌশলের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছে, বিশেষ করে তাদের সামুদ্রিক ফ্রন্টে।
আর এসবই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই চিন্তা করতে সহায়তা যুগিয়েছে যে, বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা শিল্প শক্তি হিসেবে ভারতকে অবশ্যই বন্ধুহীন করতে হবে এবং তাকে ভীষণভাবে যোগাতে হবে মার্কিনী সমর্থন। ট্রাম্প প্রশাসনের যুক্তি হচ্ছে, ভারতকে চাঙ্গা করে তোল । আর সেটাই হবে চীনকে প্রতিহত করার একটা কৌশল। কারণ তখন ভারত তার দক্ষিণ এশীয় ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর উপরে আধিপত্য বাড়িয়ে দেবে।
বাংলাদেশের তাৎপর্য
আর এমন দৃশ্যপটেই বাংলাদেশ খেলোয়াড়ের ভূমিকায় নেমেছে। এটা অনস্বীকার্য যে, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক বন্ধন । উপরন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়েছে ভারত । সেটা ছিল এমন এক বিজয়, যা বাস্তবভিত্তিক শর্তাবলীর আলোকে বলা যায়, বহুকাল আগেই বাংলাদেশ তার প্রাপ্য পরিশোধ করেছে।
গত ১২ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের শুরু থেকে ভারত তার এই ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর কাছে একটি অন্তর্গত আধিপত্যবাদী( হেজিমনিক) এবং সুবিধাবাদী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে । এই ধারায় সে একটা ব্যাপকভিত্তিক বৈষম্যপূর্ণ বাণিজ্য ঘাটতি, পানি ভাগাভাগি, নিরীহ বাংলাদেশীদেরকে সীমান্তে হত্যা এবং সন্ত্রাস দমনের নামে ভুয়ো অপারেশন পরিচালনা করেছে।
এর সঙ্গে যুক্ত করে তাই বলা যায়, ভারতীয় আধিপত্য এবং কর্তৃত্ববাদীতা বাংলাদেশের জন্য সম্পদ হিসেবে গণ্য করা চলে না । সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশীদের কাছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে একটা ওয়ান-ওয়ে ট্রাফিক। ভারত যা দেবে তার চেয়ে বেশি নেবে । এর উপরে বাংলাদেশী শাসন ব্যবস্থার প্রতিটি এবং প্রত্যেক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে নাক গলানো এবং হস্তক্ষেপ করার অধিকার সংরক্ষণ করে চলার বাহানা তো আছেই।
চীনা ভূমিকা
বাংলাদেশের চীনা বিনিয়োগের পরিকল্পনা ২০১৬ সালের অক্টোবরে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সেটা ছিল একটি গেম চেঞ্জার। চীন এবং বাংলাদেশ সাতাশটি সমঝোতা স্মারক সই করেছিল, যার বিনিয়োগ মূল্য ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর বাইরে চীনা এবং বাংলাদেশী কোম্পানিগুলো ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তেরোটি জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠা করেছিল।
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার সরকারের মধ্যে অন্যতম বিরোধের বিষয় হচ্ছে তিস্তা নদী । বহু বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ সর্বদাই আশাবাদী থেকেছে । কিন্তু ভারত পানি ভাগাভাগি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে হয় সে অঙ্গীকারহীনতায় ভুগেছে। কিংবা তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অসৎ থেকেছে।
এর ফলে বাংলাদেশ বহু বছর ধরে পানি সংকটে ভুগছে । কারণ তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ভারত তার দিক থেকে পানি ভাগাভাগির আলোচনাকে বাস্তবায়ন করেনি । ভারতের অব্যবহিত সরকারগুলো আলোচনার অগ্রগতির প্রতি মর্যাদা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে চীন অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশে একটি রিজার্ভার বা পানি সংরক্ষণাগার প্রতিষ্ঠায় প্রায় একশ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগে সম্মত হয়েছে । শুকনা মৌসুমে বাংলাদেশ এই রিজার্ভারে পানি ধরে রাখার সুযোগ পাবে।
বহু বছরের মধ্যে এটা হল, বাংলাদেশের প্রতি দেখানো ভারতের দিক থেকে একটি আচরণগত নমুনা । এমনটাই তারা অব্যাহতভাবে দেখিয়ে চলছে । এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলাদেশের স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় অখণ্ডতাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে খাটো করে চলছে।
এভাবে চীন বাংলাদেশীদের জন্য একটি অত্যন্ত ইতিবাচক আলোকবর্তিকা হিসেবে জ্বলজ্বল করছে । কারণ তারা অন্তত দেশটির অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা দিতে গিয়ে তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে না।
ভারতের সঙ্গে সমস্যা
ভারত যখন বাংলাদেশে তার নিজস্ব স্বার্থে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে, তেমনি তার সমস্যার কিছু বিষয় রয়েছে । এই সমস্যাগুলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপির গত ছয় বছরের শাসনের মধ্যে সামনে এসেছে।
বিজেপির দিক থেকে ইসলামোফোবিক (ইসলামভীতি) একটা বিষয় ছাড়াও নয়াদিল্লির সরকারের রয়েছে অন্য আরো অনেক সমস্যা।
গত ছয় বছরে মোদি ভারতীয় অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। বেকারত্ব চূড়ায় উঠেছে । ভারত যখন অব্যাহতভাবে বাংলাদেশকে চীন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য প্রলুব্ধ করতে চাইছে। তারা বলছে, বেইজিং বাংলাদেশকে ঋণের ফাঁদে ফেলতে চাইছে । তখন তারা এমন একটি ব্যাংকের কাছ থেকে ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি সই করেছে, যে ব্যাংকের বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার হচ্ছে চীন।
উপরন্তু, মুসলিমদের প্রতি ভারতের অসহিষ্ণুতা এবং ‘ কীটপতঙ্গ’ বলে বাংলাদেশীদের বিজেপির উপহাস, বলা অনাবশ্যক যে, বাংলাদেশ সুনজরে দেখেনি।
এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
আবার শেখ হাসিনা এবং মার্ক এসপারের মধ্যকার টেলিফোন কলের প্রসঙ্গে ফিরে আসি । এতে প্রতীয়মান হয় যে,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন এটা উপলব্ধিতে নিয়েছে যে, তারা ভুল ঘোড়ার উপরে বাজি ধরেছিল এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তারা ভ্রান্ত স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছিল। চীনের কাউন্টারব্যালেন্স হিসেবে ভারতকে ব্যবহার করার সুযোগ সীমিত । এই অঞ্চলের সকল ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ-সেটা নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা কিংবা বাংলাদেশ- প্রত্যেকের সঙ্গেই চীনের রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক।
সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ভারতীয় ব্যর্থতার কারণে জেগে উঠতে পারে এবং বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করতে পারে যে তারা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে উভয় দেশ কাজ করবে। এটা একটা সহজ রাজনৈতিক কচকচানি, যেমনটা বলা হয়, ‘ লক্ষহীনভাবে যেওনা এবং চীনের খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ো না।’
আর এভাবেই, সান জুর উপরে উল্লেখিত উদ্বৃতি সর্বদাই, এমনকি ৫ হাজার বছর পরেও সত্য । দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই তার না আছে কোনো স্ট্র্যাটিজি, না আছে কোনো ট্যাকটিকস। সে ওই অঞ্চলের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে ম্যানেজ করতে সব ডিম ভারতীয় ঝুড়িতে রেখেছে এবং এভাবে খুবই ভুলভাবে এমনকি তারা বোকামি করেছে এটা ভেবে যে, চীনকে সংযত রাখতে এরকম কাউন্টারব্যালেন্সিং এর ছলাকলা তাকে সুবিধা দেবে।
স্পষ্টতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার অ্যাডভার্সারি ( শত্রু বা নেতিবাচক বিষয়) সম্পর্কে বুঝতে হবে, সেসবকে খাটো করে দেখে নয়।
(নিবন্ধটি এশিয়া টাইমসে ইংরেজিতে ২৮ সেপ্টেম্বর বেরিয়েছে। অবিকল অনূদিত।)