ফারজানা ইসলাম লিনু
রহিমার মা, কাদের, ছোট মামা, লজিং মাষ্টার ও কাজলের দাদার মতো এক হালির উপরে পাগলদের নিয়ে একটা নাটক দেখেছিলাম ছোট বেলার কোন এক ঈদে। নাটকটির নাম ছিলো “একদিন হঠাৎ “। কুশিলবদের বাইরে নাটকের কারিগর নিয়ে সে বয়সে আমাদের কোন আগ্রহ ছিলো না। তাই নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদ পর্দার আড়ালে থেকে গেলেন।
কিন্তু মেগা ধারাবাহিক “এইসব দিনরাত্রির” কল্যাণে হুমায়ুন আহমেদ বেশিদিন আর আড়ালে থাকতে পারলেন না। মধ্যবিত্তের সাতকাহন দেখতে সপ্তাহান্তে সব বয়সী দর্শকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে টেলিভিশনের উপরে।
টুনির মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নাটকের যবনিকাপাত হলেও আমাদের অপেক্ষা চলে হুমায়ুন আহমেদের পরবর্তী ধারাবাহিকের।
একে একে বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, উড়ে যায় বকপক্ষী, নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার নাটকগুলো বিপুল উদ্দীপনায় দেখা হয়। বেশিরভাগ নাটকেই হাস্যরসের যোগান দিয়ে রসিকতার ছলে মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা কি সুন্দর হাতে তুলে আনেন এই শব্দ কারিগর।
বইয়ের বেলায়ও একই কথা। আশাবরী বইটা সম্ভবত প্রথম পড়েছিলাম। তারপর কত শত হুমায়ুন রচনাবলী পড়লাম, তৃষিত পাঠকের তৃষ্ণাতো মেটেনা।
দুষ্প্রাপ্যতার কারণে নন্দিত নরকে ও শংখনীল কারাগার পড়েছিলাম অনেক পরে। কি অসাধারণ লিখা একজন নবীন লেখকের।
প্রতিটা লিখা পড়ে হাসতে হাসতে পেটে খিল, নয়তো চোখের জলে স্রোতস্বিনী নদী।
শব্দ কারিগরের শব্দের বুননের মুগ্ধতায় বই শেষ না করে উঠা যায় না। এক বসায় এক বই শেষ করতে গিয়ে মায়ের তিরস্কার ও চুলের ঝুটির টান নিত্য পাওনা ছিলো।
ভিক্টর হুগো, টলস্টয়, গোর্কি, সুনীল, সমরেশের পাশে হুমায়ুন রচনা প্রীতি দেখে একবার এক সাহিত্যরসিক অগ্রজ আমাকে বলেছিলেন, হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ে কি আনন্দ পাও? সস্তা, চটুল রসিকতায় ভর্তি বইগুলো যারা পড়বে তাদের সাহিত্য প্রতিভা অকালেই কেবল বিনষ্ট হবেনা সাহিত্যের প্রতি অনাসক্তিও আসবে। এতো কঠোর হুশিয়ারি আমাকে হুমায়ুন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি, সাহিত্য চর্চা থেকেও সরাতে পারেনি এক চুলও।
বই পড়া জীবনের প্রারম্ভে বড় কন্যার হাতে জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস ও শিশুতোষ নানা বইয়ের সাথে হুমায়ুন আহমেদের ক’খানাবই তুলে দেই। সমান আগ্রহে সেও আমার বইয়ের তাক ঝেড়ে ফেলে দিনে দিনে। মাঝে মাঝে মা মেয়ে নিলে আবার রিভিশন করি। চরিত্রের চুলচেরা আলোচনায় উঠে আসে আমাদের আশপাশের মানুষের মুখগুলো।
কি নিশ্চিদ্র চোখে পরখ করার বিশাল ক্ষমতা ছিলো এই শব্দ কারিগরের। গল্পের চরিত্রগুলো আমাদের অতি পরিচিত রাম,শাম,যদু, মধু,কদু। কিন্তু চাইলেই তাদের নিয়ে দুই ছত্র লিখতে পারি না আমরা। আবার কখনো লিখলেও হুমায়ুন আহমেদের মতো হয় না। এই না হওয়ার ব্যর্থতায় খানিক গ্লানি আসলেও অপূর্ণতা আসেনা। বুকশেল্ফ ভর্তি হুমায়ুন রচনাবলীর দিকে তাকালেই মনে হয় একজন হুমায়ুন আহমেদকে দিয়ে যা হয়েছে, আর কাউকে দিয়ে তা হবে না।
নাটক সিনেমার চরিত্র চয়নেও ছিলো মুন্সিয়ানার ছাপ। ষোল আনা মানানসই চরিত্রগুলোকে মনে হতো নির্জলা বাস্তব।
বোহেমিয়ান হিমু, বাউন্ডুলে বাকের ভাই, মিসির আলি,আনিস, শুভ্র, রূপা, মোনা, নবনি, ছোট মির্জা সবাই শেল্ফে রাখা বইয়ের মতো আমাদের অতি আপনজন।
টুনির মৃত্যু ও বাকের ভাইয়ের ফাঁসি আমাদের যারপরনাই ব্যথিত করেছে। রাগে দুঃখে আবেগপ্রবণ দর্শককুল আন্দোলন করতেও পিছ পা হয়নি।
শব্দ কারিগর আরো কয়টা বছর বেঁচে থাকলে হয়তো তৈরি করা চরিত্রগুলোর কারণে আমাদের আপনজনের সংখ্যা আরো বাড়তো।
বৃষ্টি, বর্ষা, জোছনা, জলের সৌন্দর্যে আকন্ঠ মুগ্ধ এই শব্দ কারিগর দুরারোগ্য কর্কট ব্যাধির কাছে হার মানলেন বড় অসময়ে। এক শ্রাবণ রোদের উষ্ণ দিনে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। উষ্ণতা ছাপিয়ে সেদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিলো। বর্ষায় জোছনার মেঘ গায়ে মেখে লিলুয়া বাতাসে একাকী অন্ধকারে শুয়ে রইলেন নুহাশ পল্লীর লিচু তলায়।
তন্দ্রাবিলাসি লোকটার চিরস্থায়ী ঘুমের আজ সপ্তম বছর পুর্ণ হলো। বর্ষার ঝুম ঝুম বৃষ্টি নয়, আজ সারাদিন শ্রাবণের রোদ ছিলো আকাশে। পূর্ণ চাঁদের আলোয় মাখামাখি স্নিগ্ধ রাত্রিতে যথারীতি মনে পড়ে হুমায়ুন আহমেদ নামের এক শব্দ কারিগর দীর্ঘ চল্লিশ বছর আমাদের দিয়েছেন কলম উজাড় করে।
“মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে যাদুধন”…… এমন নিষেধাজ্ঞায়ও কেউ কান দেয় না। বিমুগ্ধ পাঠককুল ঠিকই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করে বাংলা কথাসাহিত্যের এই বরপুত্রকে।
শব্দের জাদুকর যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন এই চান্নি-পসর রাইতে।