মারুফ মল্লিক :: শনিবার সন্ধ্যায় নড়েচড়ে বসার মতো একটি সংবাদ পাওয়া গেল। ১৭ বছরের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ সমাপ্তির লক্ষ্যে মার্কিন ও আফগান তালেবানদের আলোচনায় আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়েছে। স্বয়ং মার্কিন শান্তি প্রতিনিধি জালমেয় খলিলজাদ দোহায় আলোচনা শেষে ধারাবাহিকভাবে টুইট করে বৈঠকের অগ্রগতি জানিয়েছেন। নড়েচড়ে বসার কারণ হচ্ছে, এবারই প্রথম মার্কিন তরফে আলোচনার বিষয়টি স্বীকার করা হলো। তালেবানদের সঙ্গে মার্কিনদের আলোচনার বিষয়টি নতুন না হলেও কখনোই মার্কিন পক্ষ তা স্বীকার করেনি।
আফগানিস্তানে শান্তির লক্ষ্যে আলোচনা হচ্ছে। খুবই আশার খবর। কিন্তু কাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে? সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধটা যাদের বিরুদ্ধে চালানো হয়েছিল, তাদের পুরোধা তালেবানদের সঙ্গে। আলোচনা যদি করতে হলোই, তবে ১৭ বছর আগে কেন করা হয়নি? এসব কারণে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে আসে, ১৭ বছরের এই যুদ্ধের অর্জন কী? এত ধ্বংসযজ্ঞ, প্রাণহানির পরও তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা কেন? তাহলে কি কার্যত তালেবানদের নীতিকেই কি স্বীকার করে নেওয়া হলো। এসব প্রশ্নের পক্ষে–বিপক্ষে হয়তো নানাবিধ উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু এই যুদ্ধের ক্ষত, রক্তের দাগ কি মুছে যাবে?
প্রশ্ন উঠবে, আসলেই কি সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ভুল ছিল? আধিপত্য বিস্তারের উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল নিরীহ আফগানদের ওপর। ইদানীং মার্কিন নীতির দিনকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সিরিয়াতেও তারা ভালো অবস্থানে নেই। ওদিকে গত বছরের নভেম্বরে মার্কিন প্রতিনিধি ছাড়াই মস্কোতে চীন, ইরান, পাকিস্তান, ভারত ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসে তালেবানরা। মার্কিনদের ছাড়াই সিরিয়ার বিষয়েও রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স একাধিকবার বৈঠক করেছে।
এসব ঘটনা হয়তো মার্কিন নীতির ওপর পরোক্ষ চাপ তৈরি করেছে। উভয় পক্ষই শনিবারের আলোচনাকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছে। তালেবানদের সঙ্গে মার্কিনদের আলোচনা হচ্ছে বা হবে, যোগাযোগ হচ্ছে—এ রকম একটি আলোচনা কয়েক বছর ধরেই চলছে। গত বছরের জুলাই মাসেই দোহায় মার্কিন প্রতিনিধিরা তালেবানদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন বলে তালেবানরা দাবি করেছিল। অক্টোবরেও ছয় সদস্যের এক মার্কিন প্রতিনিধিদল জালমেয় খালিলজাদের নেতৃত্বে তালেবানদের সঙ্গে কাতারের রাজধানী দোহায় বিভিন্ন শর্ত নিয়ে আলোচনায় বসেছিল। ১৭ বছরের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শেষ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন শর্ত নিয়ে মার্কিন প্রতিনিধিরা তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরবর্তী সময় আরও বিস্তারিত আলোচনা হবে বলে ওই সময় তালেবান নেতারা আল–জাজিরাকে জানিয়েছিলেন। মাকির্ন পক্ষ ছিল নীরব। এবারই মার্কিন প্রতিনিধির পক্ষ থেকে বৈঠকের কথা স্বীকার করা হলো।
তালেবানদের সঙ্গে শেষ বৈঠকের বিস্তারিত আমরা জানি না। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন ও তালেবানরা শান্তিচুক্তির খসড়ায় উপনীত হয়েছে। যদিও খলিলজাদ তা নাকচ করে দিয়েছেন। কিন্তু আলোচনায় বসা তালেবাদের জন্য একধরনের স্বীকৃতি, কৌশলগত বিজয়। যুদ্ধের পথ পরিহার করে মার্কিনদের আলোচনায় বসতে তালেবানরা বাধ্য করেছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, একদিকে আলোচনা চলছে, আরেক দিকে তালেবানদের হামলা অব্যাহত রয়েছে। চলতি মাসেই তালেবান হামলায় আফগানিস্তানে ১৬২ জন নিহত হয়েছে বলে আল–জাজিরা জানিয়েছে। এর মধ্যে সোমবার কাবুলের কাছে এক সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করে নিরাপত্তা বাহিনীর ১০০ জনকে হত্যা করে তালেবানরা। শুক্রবার আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি জানিয়েছেন, ২০১৪ সাল থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর ৪৫ হাজার সদস্যকে হত্যা করেছে তালেবানরা।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র নতুন আফগান নীতি ঘোষণার পরই বিভিন্ন প্রদেশে তালেবানদের হামলা বেড়ে যায় ও কয়েকটি শহর তালেবানরা দখল করে নেয়। পরে যদিও আফগানি সরকারি বাহিনী সেই শহরগুলো পুনর্দখল করে কিন্তু তালেবানদের হামলা বছরজুড়েই হয়েছে। হেলমন্দ, কুন্দুজ, গজনি, বাঘিস প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় তালেবানরা হামলা করে। গজনিতেই তালেবানরা ১০০ নিরাপত্তাকর্মী ও ১০ জনের মতো সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আফগান সরকারের একপাক্ষিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মধ্যেই তালেবানরা ধারাবাহিকভাবে হামলা করে গজনিতে। গজনিতে হামলার দুই দিন পরেই বাঘলান প্রদেশের এক সামরিক ছাউনিতে হামলা করে তারা আফগানিস্তানের ১৫ মিলিয়ন বা প্রায় অর্ধেক মানুষ তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বসবাস করে।
শান্তি আলোচনার মধ্যেই তালেবানরা হামলা করছে কেন? প্রথম তালেবানরা মার্কিন ও আফগান সরকার উভয়কেই চাপে রেখে নিজেদের স্বার্থ যতটা বেশি পারে আদায় করার চেষ্টা করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, তালেবান আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনাতেই আগ্রহী না। কাবুলের সরকারকে তারা মার্কিনদের পুতুল সরকার মনে করে। তাই সরাসরি মার্কিনদের সঙ্গেই আলোচনায় আগ্রহী। হচ্ছেও তাই। ক্রমাগত হামলা চালিয়ে কাবুল সরকারকে মার্কিনদের কাছে দুর্বল প্রমাণ করতে পারছে তালেবানরা। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যদি আদতেই মার্কিনরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায়, তবে তালেবান যেন ক্ষমতার ভাগ পায়। তালেবানরা আফগানিস্তানে কীভাবে ক্ষমতার ভাগ পাবে, তা নিয়েই এখন মার্কিনদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। বিষয়টি কখনই এমন হবে না যে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর তালেবানরাও অস্ত্র পরিত্যাগ করে আবার মাদ্রাসা–মক্তবে চলে যাবে। তালেবানরা স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই যুদ্ধ করছে। ওই সময় প্রতিপক্ষ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯৪ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় ছিল। আবারও তারা ক্ষমতায় ফিরতে চায়।
যদি তা–ই হয়, তালেবানদের হাতেই আফগানিস্তানকে সঁপে দিয়ে মার্কিনরা যদি চলে যায়, তবে এ সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই থেকে মার্কিনরা কী পেল? শান্তি প্রক্রিয়ার কথা বলে মার্কিনরা আসলে পরাজয়ের সম্মানজনক একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাইছে। কিন্তু যুদ্ধের দায়ভার কে বহন করবে? সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই কেবল আফগানিস্তানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এখন যদি সেই তালেবানদের সঙ্গেই শান্তি আলোচনা করতে হয়, তবে গত প্রায় তিন দশকে সারা বিশ্বে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার দায় কি মার্কিনরা শোধ করতে পারবে? বরং এ মতামতই প্রতিষ্ঠিত হবে, এই সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই আদতে নাটক ছিল। আড়ালে ছিল দখলদারিত্বের রাজনীতি। ভিয়েতনামে মার্কিনরা পারেনি। আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজছে।
পরাজয় গ্লানির। শান্তি আলোচনার নামে এ গ্লানি ঢেকে রাখা যায় না। তবে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আফগানিস্তানে না–হয় কথিত শান্তি আসল কিন্তু এই সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই যে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? যেন বা বলতে পারে আফগানিস্তানে তালেবানদের লাইনে এনেছি। এখন এখানে, এই দেশে শান্তি আনার পালা। তাই নতুন নতুন সন্ত্রাসী অন্য দেশে গজিয়ে উঠার শঙ্কাও কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আধিপত্য বিস্তারের যে প্রকৃতিগত বদভ্যাস রাষ্ট্রগুলোর রয়েছে; তা থেকে রাষ্ট্রগুলো কি বের হতে পারবে? সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ—দুটিই তাদের কৃতকর্মের ফল।