সব পথ মিশে গেছে ট্রিয়ারে

:: দাউদ হায়দার ::

দুই বার্লিন ও দুই জার্মানির একত্রীকরণ (বার্লিন দেয়াল পতন ৯ নভেম্বর ১৯৮৯। একত্রীকরণ ৩ অক্টোবর ১৯৯০) একই দিনে। হেলমুট কোল মহাক্ষমতাধর চ্যান্সেলর তখন (যদিও কোল বা তার সরকারের কোনো ভূমিকাই ছিল না বার্লিন দেয়াল পতনে। ঘটনা অনেকটাই অকস্মাৎ)।

এক মাসও হয়নি, নিজেকে ভেবেছেন সর্বেসর্বা। যা বলবেন, নির্দেশ দেবেন সবই মান্য। মানতে বাধ্য জনগণও। ভুল ভেঙেছে অচিরেই। ঐতিহাসিক আলেক্সজান্ডার প্লাৎসের মাঝখানে মার্কস-এঙ্গেলসের বিশাল যুগলমূর্তি। কালো পাথরে তৈরি। দেশি-বিদেশি ভ্রামণিকের দ্রষ্টব্য। পাশে বা পদতলে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে ছবি তোলে।

অক্টোবর মাসের শেষে (১৯৯০) বিকেলের দিকে দুটি ক্রেন যুগলমূর্তির দিকে এগোচ্ছে। দুটি ট্যাঙ্কও।

দু’দিন আগেই মিডিয়ায় খবর প্রচারিত হয়, মার্কস-এঙ্গেলসের যুগলমূর্তি গুঁড়িয়ে দেবে সিটি করপোরেশন। বার্লিনের মেয়র এবারহার্ড ডিপগেন, তিনি সিডিইউর (হেলমুট কোলের পার্টি)। সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ আসনই সিডিইউর দখলে।

কবে, কোন তারিখে যুগলমূর্তি ধূলিসাৎ করা হবে মিডিয়ার খবরে উল্লেখ নেই। যে কোনো দিন হতে পারে। জনগণও তক্কে তক্কে। মুহূর্তে খবর রটে যায়- ট্যাঙ্ক, ক্রেন আসছে মার্কস-এঙ্গেলসকে চুরমার করতে। কোত্থেকে যে হাজার হাজার নারী-পুরুষ হাজির, অজানা। তাকিয়ে দেখি, মূর্তির সামনে-পেছনে, বামে-ডাইনে অক্টোবরের ওই শীতে শুয়ে পড়েছে। বাতাসে চিৎকার ধ্বনিত, ‘আমাদের শরীরের ওপর দিয়ে ট্যাঙ্ক চালাও।’ কয়েকশ’ পুলিশও জমায়েত। ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা। জলকামান থেকে গরম জল ছুটে আসছে। জনগণের ভ্রূক্ষেপ নেই। আরও জনসমাবেশ। হুলস্থূল কাণ্ড। সারারাত। সকালেও। পরদিন একই কাণ্ড। মিডিয়া গর্জে উঠেছে। সমালোচনা। তীব্র আক্রমণ। যত দোষ যেন মার্কস-এঙ্গেলসের। গোটা আলেক্সজান্ডার প্লাৎসজুড়ে লোকে লোকারণ্য। সে এক তামাশা। মেলাও বসে গেছে। ফাস্টফুড বিক্রি। উপায় না দেখে সরকার পিছপা। রক্ষা পায় যুগলমূর্তি (দশ বছর পরে মূর্তির স্থান বদল, আলেক্সজান্ডার প্লাৎসের অন্যত্র। এখন বরং আরও নজরকাড়া জায়গায়)।

কার্ল মার্কসের (জন্ম ৫ মে ১৮১৮। প্রুশিয়ার রাইন প্রদেশ ট্রিয়ারে। এখন জার্মানিভুক্ত। মার্কসের পুরো নাম কার্ল হাইনরিশ মার্কস) নাম এবং মার্কসইজমের নাম শুনলে হেলমুট কোল, তার দল সিডিইউ (ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন) যতই জ্বলুক-পুড়ূক, তৎকালীন পশ্চিম বার্লিনের একটি বড়, প্রশস্ত সড়কের নাম কার্ল মার্কস স্ট্রাসে।

দুই বার্লিন বিভক্ত হওয়ার পরে পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিনে কার্ল মার্কসের নামে একটি সড়কের নামকরণ, একটি রেলওয়ে স্টেশনের নামও। দুটিই বরবাদ। যেমন বাতিল কার্ল মার্কস স্টাডট (সিটি)। পুরনো নামে আবার বহাল (কেমনিৎস)।

জার্মানির প্রায় প্রতিটি শহরেই কার্ল মার্কস স্ট্রাসে (সড়ক) আছে, দুই জার্মানির একত্রীকরণের পরও।

মার্কসকে বাদ দেওয়া, মুছে ফেলা সহজ নয়। পারবেও না। অসম্ভব। লাখ লাখ মানুষের গুরু, গুরুদেব। মার্কসবাদে বিশ্বাসী।

দুই জার্মানির একত্রীকরণের পরে, একত্র জার্মানির প্রথম নির্বাচনে কমিউনিস্টরা (তখন পিডিএস [পার্টাই ফর সোস্‌সিয়াল ডেমোক্র্যাটস] এখন লিনকে পার্টাই) বিপুল ভোটে জয়ী। সংসদে তৃতীয় দল। গত সাতাশ বছরে যে কয়টি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, কমিউনিস্টরা সংসদে শক্তপোক্ত, আসীন। জোরালো। জার্মানির একটি রাজ্য (পূর্বাঞ্চলে) এখন দখলে। মহাধুমধামে রাজত্ব করছে। তাহলে মার্কসইজম, কমিউনিস্টদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা যায়নি। বরং বিপুল উদ্যমে কার্ল মার্কসের দ্বিশতবর্ষ জন্মোৎসব শুরু, ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে। যেখানে ছিলেন মহাসমারোহে। বিশেষত ট্রিয়ারে (জন্মস্থান), কোলন বার্লিনে, প্যারিসে, ব্রাসেলসে, আলজিয়ার্সে, লন্ডনে (মারা যান লন্ডনে, মার্চ ১৪, ১৮৮৩)। ছয় মাসব্যাপী অনুষ্ঠানাদি। সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান ট্রিয়ারে, জন্মস্থানে। অতঃপর বার্লিনে। কারণও ঐতিহাসিক।

মার্কসের দ্বিশতবর্ষ জন্ম উপলক্ষে ডাকসাইটে সাপ্তাহিক ‘ডি ৎসাইট’, সাপ্তাহিক ‘ড্যের স্পিগেল’সহ সব সাপ্তাহিক-পাক্ষিক-মাসিকের ডাউস, মোটা, সাদা-কালো ও কালারফুল সংখ্যা প্রকাশিত। শতাধিক বইও। সরকারের ডাকটিকিট। বিস্তর পোস্টকার্ড। এও বাহ্য। চকলেট। টুপি। টি-শার্ট। বিক্রিও হচ্ছে দেদারসে।

ট্রিয়ারে এসে দেখছি, গোটা শহর মার্কসময়। পথেঘাটে মার্কস। বিশাল বিশাল ছবি সর্বত্র। রেস্তোরাঁ, বার, এমনকি ডিস্কো ক্লাবেও। ট্রিয়ারে কার্ল মার্কস উৎসব ৫ মে থেকে ২১ অক্টোবর। সরকারি উদ্যোগে ‘গ্র্যান্ড এক্সজিবিশন’ (ঊীযরনরঃরড়হ)। রাইনিশে লান্ডেস মিউজিয়াম এবং সিটি মিউজিয়াম জিমনেস্টিক্টে। শহরের নানা সংস্থায়, প্রতিষ্ঠানে মার্কসের জীবন, কাজ, সময়, চিন্তা, সমাজ, রাষ্ট্র, দর্শন নিয়ে হরেক আলোচনা, অনুষ্ঠানমালা। বিশেষত ১৮১৮-১৮৮৩ সময়কালীন এবং পরবর্তী বিশ্বের দিনকাল, আজকের পরিস্থিতি। বিশ্ব রাজনীতির, মার্কসবাদ-চিন্তার-কর্মের-প্রতিফলনের বিকাশ-পরম্পরা নিয়ে নানা দেশের মার্কসীয় দার্শনিক, বক্তা হাজির।

কোনটা রেখে কোনটা শুনবেন। বক্তারা প্রত্যেকে মার্কসবিজ্ঞ।

১৯৮৮ সালের ৯ আগস্ট প্রথম গিয়েছিলাম ট্রিয়ারে, গুরুর জন্মভিটে, বাড়ি দেখতে। দ্বিতীয়বার ২০০৩ সালের ৬ জুন। বাড়ির সামনে ও ভেতরে মেরামতি চলছে।

প্রবেশ নিষেধ। বিদেশি বহু দর্শনার্থীর বিষণ্ণমনে প্রস্থান।

দ্বিশতবর্ষ জন্মের উৎসবে এসে আরেক অভিজ্ঞতা। চেনা শহর অচেনা। অজস্র মানুষ। নানা দেশের। ভিড়। হোটেলে ঘর পাওয়া দুস্কর। পেলেও ডাবল ভাড়া। খাবারের দাম চড়া। এও এক ব্যবসা। দর্শনার্থীর কাছে ‘গুরুদেবে’র জন্মঘর (২০০ বছর আগে কী রকম ছিল অজানা। এখন ঝকঝকে ঘর। পরিপাটি) দেখা পরমাত্মিক।

ট্রিয়ার ‘কার্ল মার্কস মিউজিয়াম’ এবং ‘ট্রিয়ার সিটি ট্যুরিজম’ চমৎকার ব্যবসা ফেঁদেছে। গাইড ট্যুর থেকে শুরু করে ‘মার্কস প্রদর্শনী’র (বিভিন্ন স্থানে) স্কুল, কোনো গির্জায় প্রথম গিয়েছিলেন (মার্কসের পিতা হাইনরিশ ইহুদি। ধর্ম বদল করে খ্রিষ্টান। মা হানরিয়েটা প্রেসবুর্গ ইহুদি। হল্যান্ডের। খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা), গিয়ে ত্যাঁদড়ামি করেন, গির্জার ভণ্ডামি নিয়ে শৈশব বয়সেই প্রশ্ন তোলেন, জ্যাঠামির প্রথম প্রকাশ, দেখিয়ে, ট্যুরিস্ট গাইডের কথা, ‘মানবজীবনের সমতার কথা এখানেই প্রথম ঘোষিত।’- গুরুর অলৌকিকত্ব সবাই মেনে নেন বোধ হয়, কেউ প্রশ্ন করে না। যেমন রাম ও কৃষ্ণের অলৌকিকত্বে নিষ্ঠাবান হিন্দু। আমরা প্রশ্ন করি না। দেখি, ছয় বছরের

কার্ল মার্কস আঙুল উঁচিয়ে কী যেন বলছেন একদল মানুষের উদ্দেশে।- এই ছবি যার আঁকা, নাম নেই।

-না থাক। মার্কসের দুইশ’ জন্মবর্ষে মানুষের ঢল ট্রিয়ারে। দেখে, মনে পড়ল, বাংলাদেশের এক কমিউনিস্ট কবির কবিতা :’বলেছি আমার প্রিয়ারে / সব পথ আজ মিশেছে ট্রিয়ারে।’

বার্লিন প্রবাসী কবি

Advertisement