সাজন আহমদ সাজু: বিশ্বব্যাপী এক চরম ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে মানুষ,চারদিকে অন্ধকারের বিভীষিকা, হতাশায় মুহ্যমান পুরোবিশ্ব।করোনা নামক এক অদৃশ্য দানব গ্রাস করে ফেলছে মানব জাতিকে।
ক্ষমতাধর রাষ্ট্র থেকে শুরু করে মানুষরুপী হায়েনার রোষানলে নিস্পেষিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো আজ আক্রান্ত করোনার ছোবলে।
বিশ্বময় যে মহামারী দেখা দিয়েছে তা হানা দিয়েছে বাংলাদেশেও।প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
টানা প্রায় এক মাস ধরে অচল দেশ গৃহবন্দী মানুষ, অফিস, আদালত কলকারখানা, ব্যাংক বীমা সব বন্ধ,স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থনীতির চাকা।
এর প্রভাব পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়, দিনমজুর-হত দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষগুলোর চোখে মুখে অন্ধকার।
মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর চোখে হতাশা আর অনিশ্চয়তার কালো রেখা।
নিন্মবিত্তের পাশে দাড়িয়েছে সরকার আর সাধারণ স্বচ্ছল মানুষ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন।
বিপাকে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষ যারা বুকে পাথর বেধে সয়ে যায় সব বিষাদ,গিলে খায় ক্ষিধা তবুও লোক লজ্জার ভয়ে হাত পাতে না কারো কাছে।
ক্ষুধার্ত পেটে ভালো থাকার দিব্যি অভিনয় করে যাওয়া মানুষের পাশে দাড়ানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস নিয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক আহাদ চৌধুরী বাবু চাচা উনার জন্মদিনকে সামনে রেখে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন-উনার জন্মদিনে কোনো উপহার না দিয়ে করোনার মহামারীতে ঘর বন্দি মানুষের জন্য ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার তাগিদে গঠন করেন টীম প্রবাসী, নিরাশ করেননি দেশ বিদেশের প্রিয়জনেরা বাড়িয়ে দেন ভালোবাসার হাত।প্রায় দু শতাধিক পরিবারের কিছুদিনের খাবারের ব্যবস্থা হয়।
আমি সৌভাগ্যবান স্নেহ-মমতার পরশে আগলে রাখা এই মানবিক মানুষটি বরাবরের মতো আমাকে সম্পৃক্ত করলেন এমন মহতী উদ্যোগে। আমিও আন্তরিকতার সবটুকুন ঢেলে দিয়ে স্বচ্ছতা এবং নিষ্টার সাথে কাজটি সম্পন্ন করার চেষ্টা শুরু করি।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো এমন-এরা ভাঙবে তবু মচকাবে না, সেটা মাথায় রেখেই এমন কিছু মানুষের সন্ধান শুরু করি পাড়া-মহল্লায় হেঁটে হেঁটে,গভীর অনুসন্ধানে কিছু নাম পেয়েও যাই,বাবু চাচা লন্ডন থেকে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন এলাকার এর ওর খুঁজ নিতে বলেন-
৬ নং ওয়ার্ড এর মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি তালিকাও আমরা করে ফেলি প্রথমদিন।
বাবু চাচা জানতে চান অমুক ভাইর পরিবার কেমন করে চলছে?এই ভাইর পরিবারের অবস্থা কেমন?উনার অবস্থা কেমন একটু খুঁজ নিও।
দুজনের সম্বনয়ে আমরা আশপাশের স্থানীয় মানুষের যে তালিকা করি এদের মধ্যে এমনও পরিবার আছে যারা এক সময় নিজেরাই দরিদ্র মানুষের ভরসাস্থল ছিলো ভাগ্যের কঠোরাঘাতে আজ হয়তো এরা অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাটা ধরে রাখতে পারেনি নয়তো বা স্রষ্টার ইচ্ছেতে আজ তাদেরও বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে হয় সামাজিক অবস্থান বজায় রেখে ।
আমি জানি এমন অনেকেই আছেন ক্ষুধার্ত পেটে দরজা বন্ধ করে থাকবে তবুও হাত পাতবে না কারো কাছে এই মানুষগুলো দান দিলে সেটা অপমান করা হয়, তাদেরকে উপহার স্বরুপ কিছু দেওয়া যায়-
আবার অনেকে উপহার নিতেও অস্বস্তিতে ভোগেন কেবল মাত্র সামাজিকতার কারণে কেউ হয়তো ফিরিয়ে দেননা কিন্তু অনেকেরই চোখ মুখ লজ্জায় লাল হলেও একটু হাসি ফুটে এই কঠিন পরিস্থিতে পরিবার-সন্তান নিয়ে সাময়িক বিপাকে পড়া মানুষগুলোর মাঝে।
আমাদের চেষ্টা ছিলো তাদের মুখে একটু খানি হাসি ফোটানো।
যেহেতু মাঠে থেকে কাজ করেছি তাই কিছু অভিজ্ঞতাও সঞ্চার হয়েছে এই দুর্যোগময় মুহুর্তে ত্রাণ পৌঁছে দিতে গিয়ে।।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছিলাম যারা এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পরিবার নিয়ে বাঁচার জন্য যুদ্ধ করছেন পরিবার নিয়ে, দ্বিধা-সংকোচ-সংশয় ভুলে আমাদেরকে জানানোর জন্য আমরা সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রেখে রাতের আঁধারে তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবো।এটা নিছক ভালোবাসা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থেকে।
কথায় আছে
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমা চাঁদ যেনো জ্বলসানো রুটি-
অনেকেই গৃহবন্দী হয়ে আর্থিক সংকটটা মানিয়ে নিতে পারছেননা, হিমশিম খাচ্ছেম সীমিত আয়ের মানুষগুলো তাই ইনবক্সে অনেকেই অপারগ হয়ে যোগাযোগ করছেন-
একেকটি ম্যাসেজ পড়েছি আর বিস্মিত হয়েছি, ব্যথিত হয়েছি।
আহারে জীবন তুমি কত বৈচিত্র্যময়। আমিও মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্তান।জানি কেমন করে টিকে থাকতে হয় একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে তবুও এই ম্যাসেজগুলো খুবই পীড়া দিয়েছে,কেনো জানি নিজেকে অসহায় মনে হয়েছে, স্বাদ আছে সাধ্য নেই এই যন্ত্রণাটা প্রতিনিয়ত তাড়না দেয়।
ইনবক্সে বাদাম বাগিচার একজন মহিলা লিখলেন ভাই সম্ভব হলে আমাকে সাহায্য করতে পারেন,খুব অসুবিধায় আছি,পরিচয় গোপন রেখে সাহায্য চাইলাম।
চৌকিদেখীর এক পরিচিত স্থানীয় লোক খুবই অসুস্থ ঔষধ কিনবেন এমন সামর্থ্য নেই বাবু চাচাকে ইনবক্স করলেন
রাগ করবো কেনো ভাই অবস্থা খুব খারাপ ঔষধ কিনে খাবো ১০ টাকাও হাতে নেই।
একজন পরিচিত বড়ো ভাই ইনবক্স করলেন সাজু পারলে আমাকে সাহায্য করিও,এমনভাবে বলা লোক তিনি নন যথেষ্ট স্বচ্ছল আর সজ্জনব্যক্তি, বুঝতে পারলাম মধ্যবিত্তের যাতনা।
চৌকিদেখীর একটু সুনামধন্য পরিবারের একজনকে উপহার দিতে গেলাম মানুষটা যে কতটা খুশি হয়েছেন না দেখলে বিশ্বাস হবেনা।
উনার চোখে মুখে অদ্ভুত এক দ্যোতি অনুভব করলাম।কি করে কৃতজ্ঞতা জানাবেন যেনো ভাষাই খুঁজে পাচ্ছেননা,বারবার বলছেন তোমাদের জন্য দোয়া করবো নামাজ পড়ে।
লিচু বাগানের একজন স্থানীয় মানুষের ঘরে উপহার নিয়ে গেলাম যা কল্পনাও করা যায়না, মানুষটি কতটা খুশি হয়েছেন কথাবার্তায় ফুটে উঠছে, কৃতজ্ঞতার ছাপ প্রতিটি শব্দে।উপহার দেওয়ার আগে শুধু বলেছিলাম বাবু চাচা উনার জন্মদিনের উপহার পাঠিয়েছেন আপনার জন্য কিছু মনে না করলে এটা গ্রহণ করবেন কি?
আমাদের এলাকার সাবেক একজন তারকা ফুটবলার সকলের প্রিয়ভাজন এই মানুষটিকে কোনোদিন কারো কাছে হাত বাড়ানোতো দুরে থাক কেউ সাহায্য নিয়ে গেলেও রাখবেন না।
আমরাও উনাকে উপহার পৌঁছে দিতে সাহস করিনি,এতে উনি বিব্রতবোধ করবেন জানি,আমরা দুর থেকে অপরিচিত লোক দিয়ে উনার উপহার পাটিয়ে দিলাম।
বাদাম বাগিচার একস্থানীয় মহিলা যাকে ছোটোবেলা থেকে চাচী ডাকি খবর পেয়ে আমার বাসায় উপস্থিত নিজের অবস্থা তোলে ধরে কান্না করছেন, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সম্ভব হলে উনাকে সাহায্য করতে বললেন।
এমন আরও কিছু মানুষ ফোনে যোগাযোগ করলেন যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম আমরা।
বাদাম বাগিচা-ইলাশকান্দি- সৈয়দমুগ্নী-পীর মহল্লা আর চৌকিদেখীর অনেক স্থানীয় মানুষের কাছে আমরা উপহার নিয়ে গেছি যা অন্য কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না।
এমন অনেক পরিবার আছেন যাদের আমরা হয়তো উপহার পাঠাতে পারিনি কিংবা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি কিন্তু এই কিছু পরিবার দেখেই আমার উপলব্ধি জ্ঞান বিস্তৃত হয়েছে, অনুভূত হয়েছে জীবন প্রবাহমান নদীর মতোই ভাঙা গড়ার সুর ছন্দনে বয়ে চলে।
জোয়ার ভাটার অসম সমীকরণ,জীবনের কঠিন বা্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পৃথিবী ঠুনকো পান্থশালা।দুনিয়া আসলেই কিছুনা।
সময়ের সাথে সাথে প্রকৃতি তার রুপ পাল্টায়,জীবন বড়োই রহস্যময় বুঝা ওঠা দুস্কর।
সময়ের বিবর্তনে সব কিছু মলিন হয়ে যায়, দুনিয়ার কোনো কিছুই স্থায়ী নয়।সবই আকাশের মতো রুপ পাল্টায়,নদীর এককূল ভাঙে অন্যকুল গড়ে এটাই নদীর খেলা।
পৃথিবীর কোনো কিছুই আমাদের নয় সব কিছু স্রষ্টার দয়া আর অনুগ্রহ।এই জীবন থেকেই শিক্ষা নিতে হবে।
কোটি টাকা দিয়েও কাউকে খুশি করা যায়না আমার ভালোবাসার ছোট্ট হাত বাড়িয়ে দিয়ে মানুষের মনে দাগ কাটা যায়।
সব মানুষ ক্ষুধার কাঙাল নয় কিছু মানুষ ভালোবাসার কাঙাল।
মানুষ মানুষের কাছে ভালোবাসা আর দোয়া চায়
এতো কিছু লেখার কারণ নিশ্চয় কারো অজানা থাকার কথা নয়,দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি চোখ রাখুন আপনার আশেপাশে মধ্যবিত্ত পরিবারের দিকেও যারা দরজা বন্ধ করে ক্ষুধার্ত পেটে নীরবেই সয়ে যাচ্ছে সব,অপেক্ষা করছে করোনা নামক অভিশাপের এই বন্দি জীবনের অবসান হলে জীবন-জীবিকার তাগিদে নিরন্তর ছুটে চলার।
ধন্যবাদ বাবু চাচা এমন কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগে আমাকে সামিল করা।আপনার জন্য অফুরন্ত দোয়া আর নিখাদ ভালোবাসা।
ধন্যবাদ প্রিয়জন মারুফ ,মাহফুজ, রুবেল ,আফজাল সহ মানবিক কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে এগিয়ে আসা বন্ধুদের
আসুন নিন্মবিত্তদের পাশাপাশি এই বিপদকালীন সময়ে মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর দিকেও একটু নজর রাখি সামর্থ্য অনুযায়ী –
ভালোবাসা বেঁচে থাকুক ভালোবাসায়।
সাজন আহমদ সাজু (কবি লেখক ও সমাজ কর্মী)