ধরিত্রী সরকার সবুজ
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের উচ্চতা যতটুকু বাড়বে বলে ধারণা করা হয়েছিল, বৃদ্ধি হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। এত দিন বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সমুদ্রস্তরের উচ্চতা সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পাবে এক মিটারের একটু কম। সর্বশেষ গরেষণাটি বলছে, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে পারে তার প্রায় দ্বিগুণ।
‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস’ জার্নালে প্রকাশিত এ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বিশ্ব কার্বন নির্গমন যেভাবে চলছে, তা কমানো না গেলে আগামী দিনের পৃথিবী এখনকার চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণতর হবে। সে ক্ষেত্রে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রস্তরের উচ্চতা ৬২ সেন্টিমিটার থেকে ২৩৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।
২০১৩ সালে প্রকাশিত ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) পঞ্চম সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমুদ্রস্তরের উচ্চতা ৫২ থেকে ৯৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ওই হিসাব ছিল অনেক বেশি রক্ষণশীল। গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকায় বরফ গলার প্রক্রিয়ার অনেক দিকই সে সময় গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকায় বরফ গলনের পরিমাণ বেশি হওয়ার ফলে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি হবে অনেক বেশি।
আশঙ্কার কথা হলো, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা এভাবে বাড়লে ১.৭৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার পরিমাণ ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাবে, যার মধ্যে একটা অংশ থাকবে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার কিছু অংশ ছাড়াও বিশ্বের যেসব অঞ্চল পানির নিচে চলে যাবে, তার অনেক অংশই গুরুত্বপূর্ণ ফসল উৎপাদন অঞ্চল, যেমন—নীল নদের বদ্বীপ অঞ্চল। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সাংহাইয়ের মতো কিছু বড় শহরও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকা মানুষের বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়বে এবং সেসব অঞ্চলের মানুষকে উদ্বাস্তু হয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে হবে। তবে গবেষকরা এটাও বলছেন যে আগামী কয়েক দশকে কার্বন নির্গমনের হার কমানো গেলে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হতে পারে।
তাহলে আমরা একটু পেছনে ফিরে দেখতে পারি কার্বন নির্গমনে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার সার্বিক অগ্রগতি কতটুকু। পোল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কাতোভিচে গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৪। ১৯৬টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন সে সম্মেলনে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবেলায় ২০১৫ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত কপ-২১-এর প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করা যায় সেটাই ছিল কপ-২৪-এর টান টান উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তার বিষয়। প্যারিস সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পযুগের আগের তুলনায় দুই ডিগ্রির মধ্যে এমনকি সম্ভব হলে দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখার বিষয়ে একমত হন। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি তত ঝুঁকির মুখে পড়ছে। জাতিসংঘ বলছে, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ বর্তমানের তুলনায় ৫৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে।
২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ৯০টি দেশের জলবায়ু বিজ্ঞানীদের দেওয়া এক বিবৃতি বলছে, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বর্তমানের চেয়ে কমপক্ষে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্য হারে কমানোর কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
পোল্যান্ডের কাতোভিচের সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের হুমকিতে থাকা দেশগুলোকে রক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করা এবং ধনী দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক জন রুম বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আর্কষণ করে বলেছিলেন, আমরা যদি কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে না আনি এবং জলবায়ু অভিযোজন ব্যবস্থা গড়ে না তুলি, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে আরো ১০ কোটি মানুষ দরিদ্র হবে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) জানিয়েছে, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পযুগের আগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতে হলে প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করা দেশগুলোকে তাদের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ আরো তিন গুণ বৃদ্ধি করতে হবে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হলে উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে পাঁচ গুণ।
সত্যিকার অর্থে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিশ্বের দেশগুলোকে প্রথমবারের মতো একতাবদ্ধ করতে পেরেছিল প্যারিস সম্মেলনের বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি। তখন গ্রিনহাউস গ্যাস কমিয়ে আনতে ২০০টির মতো দেশ যে ঐকমত্য পোষণ করেছে, তাকে অনেক পর্যবেক্ষকই ঐতিহাসিক অর্জন বলে অভিহিত করেছেন। বিজ্ঞানীরা এখনো মনে করছেন, পৃথিবীতে আসন্ন জলবায়ু পরিবর্তনের বিপজ্জনক প্রভাব প্রতিরোধে প্যারিস চুক্তি অবশ্যই কার্যকর করা প্রয়োজন।
প্যারিস চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি বা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখা এবং জলবায়ু তহবিল গঠন ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল গাছ, মাটি ও সমুদ্র প্রাকৃতিকভাবে যতটা গ্রিনহাউস গ্যাস শোষণ করতে পারে, ২০৫০ থকে ২১০০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ সে পর্যায়ে নামিয়ে আনা।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি কর্তৃক ৬ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘এমিশন গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৮’ বলছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি বন্ধের জন্য নেওয়া বৈশ্বিক চেষ্টা তেমন কোনো কাজে আসছে না। চার বছর পর্যন্ত স্থিতাবস্থায় থাকার পর কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শিল্প ও জ্বালানি খাতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ স্থিতাবস্থায় ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। কিন্তু বর্তমানে বেশি পরিমাণে কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর যে স্তিমিত উদ্যোগ বা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারার সম্ভাবনা বেশ কম।
কপ-২৪ সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই বিশেষজ্ঞরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বকে রক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়নের চেয়েও বেশি কিছু করার দরকার এখন এবং বিশ্বকে রক্ষায় আরো বেশি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ হুমকিতে থাকা দেশ ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো তাই মনেপ্রাণে চেষ্টা করেছিল কপ-২৪ এ যেন কপ-২১ এর প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর আগে আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে ২০১৮-এর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনেও বিশ্বনেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে প্যারিস চুক্তি অমান্য করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বিশ্ববাসীর সামনে আজও জ্বলন্ত প্রশ্ন—আমরা কি সত্যি সে লক্ষ্য পূরণের আশা করতে পারব?
লেখক: পরিবেশবিষয়ক লেখক।
ইংল্যান্ডের গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘এনভায়রনমেন্টাল কনজারভেশন’ বিষয়ে মাস্টার্স