ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: পর ২৬ জুন গাজীপুরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। খুলনার পর গাজীপুরেও একই ধরনের ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ তথা খুলনা মডেলের ব্যাপক আকারের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর ও অর্থবহ করার স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে এ ধরনের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের অবসান হওয়া দরকার।
খুলনা মডেল বলতে আমরা কী বুঝি? এর বৈশিষ্ট্যই বা কী কী? মোটাদাগে খুলনা মডেলের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো হলো:
পুলিশ দিয়ে প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করা
খুলনার মতো গাজীপুরেও একই ঘটনা ঘটেছে। যেমন আদালত কর্তৃক নির্বাচন স্থগিত করার দিন একটি লেগুনা ভাঙচুর করার অভিযোগে পুলিশ বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের বাড়ির আশপাশে অভিযান চালিয়ে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান
আবদুল্লাহ আল নোমানসহ ১৩ জনকে আটক করে। ছয় ঘণ্টা পর নোমানকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকি ১২ জনসহ ১০৩ জনের নাম উল্লেখ করে পরদিন
বিশেষ ক্ষমতা আইনে টঙ্গী থানায় মামলা করে পুলিশ, যাঁদের মধ্যে ৪৮ জন বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য। যদিও পরে টঙ্গী থানায় লেগুনাটি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায় (প্রথম আলো, ৯ মে ২০১৮)। এ ছাড়া ২০ জুন দিবাগত রাত থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ৯ জনকে আটক করার অভিযোগ আনে দলটি (প্রথম আলো, ২২ জুন ২০১৮), আশপাশের জেলায় করা মামলায় যাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ফলে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং নির্বাচনের আগেই বিএনপির নেতা-কর্মীরা এলাকাছাড়া হন, যার নেতিবাচক প্রভাব নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় ব্যাপকভাবে পড়ে। এ ছাড়া
নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার না করার হাইকোর্টের আদেশ সত্ত্বেও বিএনপির
অনেককে গ্রেপ্তারের অভিযোগ ওঠে, এমনকি নির্বাচনের দিনেও।
পোলিং এজেন্টদের দায়িত্ব পালনে বাধার সৃষ্টি
গাজীপুরেও বিএনপির প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়েছে। অনেককে কেন্দ্রে উপস্থিত হতে বাধা বা কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কাউকে কাউকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটকে রেখে ভোটের পর মুক্তি দিয়েছে। আবার কয়েকজনকে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক অবস্থায় পাওয়া গেছে (প্রথম আলো, ২৮ জুন ২০১৮)। ভোটের দিন গাজীপুরে বিএনপির শতাধিক নির্বাচনী এজেন্টকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ অশ্রুতপূর্ব (প্রথম আলো, ১১ জুলাই ২০১৮)। কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টের অনুপস্থিতিতে অনেক অনিয়ম, এমনকি কোনো প্রার্থীর পক্ষে ভোটপ্রাপ্তির
সংখ্যাও বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। যেমনটি ঘটেছে ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী গাজীপুরের অন্তত দুটি কেন্দ্রে। পোলিং এজেন্টের অনুপস্থিতিতে ব্যালট কারচুপি সম্ভব।
নির্বাচনের দিনে জোরজবরদস্তি
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী খুলনার নির্বাচনের পর গাজীপুরেও ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে জোরজবরদস্তি করা হয়েছে। সাময়িকভাবে কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট প্রদান, ভোটকেন্দ্রে এবং এর আশপাশে ভীতিকর ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি এবং ভোট প্রদানে বাধাদান ইত্যাদি নানা অনিয়ম ঘটেছে। এর ফলে নির্বাচন কমিশনের মতে গাজীপুরে ভোট প্রদানের হার ৫৭ দশমিক ২ শতাংশ হলেও অনেকগুলো কেন্দ্রে অস্বাভাবিক হারে ভোট পড়েছে। জবরদস্তি করে সিল মারার কারচুপির নির্বাচনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ভোট প্রদানের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ীর ভোটপ্রাপ্তির পরিমাণ
আরও বেশি হারে বাড়ে এবং তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর পরিমাণ আরও বেশি হারে কমে, যা গাজীপুরে ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ ২০-৩০ শতাংশ ভোট পড়া ২টি কেন্দ্রে হাসান উদ্দিন সরকারের তুলনায় জাহাঙ্গীর আলমের ভোটের ব্যবধান ছিল ৩৩ শতাংশ; ৩০-৫০ শতাংশ ভোট পড়া ১২৪টি কেন্দ্রে ছিল ৫১ শতাংশ; ৫০-৬০ শতাংশ ভোট পড়া ১১১টি কেন্দ্রে ছিল ৮৯ শতাংশ; ৭০-৯০ শতাংশ ভোট পড়া ১৭৭টি কেন্দ্রে ছিল ১৫৮ শতাংশ এবং ৯০ শতাংশের ঊর্ধ্বের ২টি কেন্দ্রে ছিল ৩০৯ শতাংশ; অর্থাৎ সর্বনিম্ন ভোট
পড়া কেন্দ্রে হাসান উদ্দিন সরকারের ১০০ ভোটের তুলনায় জাহাঙ্গীর আলম ১৩৩ ভোট পেলেও তা ক্রমাগতভাবে বেড়ে সর্বোচ্চ ভোট পড়া আসনে এসে দাঁড়িয়েছে ১০০: ৪০৯-এ। আমরা মনে করি, উচ্চ হারের ভোট পড়া কেন্দ্রগুলো নির্বাচন কমিশনের তদন্ত করে দেখা আবশ্যক।
নির্বাচন কমিশনের নির্বিকার ভূমিকা
খুলনার মতো গাজীপুরের নির্বাচনেও বহু অনিয়ম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়রানি ও বাড়াবাড়ির অভিযোগ উঠেছে, যা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন ছিল বহুলাংশে নির্লিপ্ত। যেমন গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের হয়রানি ও গ্রেপ্তারের অভিযোগ করা হলেও নির্বাচনের এক দিন আগে কমিশন কাউকে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার না করার একটি নির্দেশনা জারি করে, যা ছিল রোগী মারা যাওয়ার পর ডাক্তার হাজির হওয়ার মতো ঘটনা। গাজীপুরের এসপির বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ করা সত্ত্বেও বর্তমান কমিশন এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি, যদিও বিগত বহু সমালোচিত রকিবউদ্দীন কমিশনও আগের একটি নির্বাচনে তাঁকে বদলি করার ব্যবস্থা করেছিল। খুলনার নির্বাচনের পর অসদাচরণের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন কারও বিরুদ্ধে দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি; যদিও সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিধিমালা-২০১০-এর ধারা ৮১ অনুযায়ী ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি অন্যূন ৬ (ছয়) মাস ও অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন, যদি তিনি কোনোভাবে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করিবার উদ্দেশ্যে তাহার সরকারি পদমর্যাদার অপব্যবহার করেন।’
উন্নয়নের প্রশ্নে ভোটারদের জিম্মি অবস্থা
উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিও গাজীপুরের নির্বাচনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। বিগত পাঁচ বছরে বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচিত গাজীপুরের মেয়র বিভিন্নভাবে মামলা, গ্রেপ্তার, বরখাস্ত ও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছিলেন এবং গাজীপুরবাসীকে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই গাজীপুরের ভোটারদের সামনে সুস্পষ্ট বার্তা ছিল: উন্নয়ন চাইলে সরকারি দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে। আর গাজীপুরের রাস্তাঘাটের দুরবস্থা, বেহাল পয়োনিষ্কাশন, চারদিকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ ইত্যাদি গাজীপুরের ভোটারদের, বিশেষ করে দলনিরপেক্ষ ভোটারদের জন্য উন্নয়নের নামে একধরনের জিম্মি অবস্থার সৃষ্টি করেছে, ক্ষমতাসীনেরা যার সুফল পেয়েছিলেন।
এটি সুস্পষ্ট যে গাজীপুরে খুলনার মডেল কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে নির্বাচন কমিশনের আপসকামিতার কারণে। আমাদের সব নির্বাচনী আইনের অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা হলো কমিশনের, বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারিত্ব। এ লক্ষ্যে উদাহরণস্বরূপ সিটি করপোরেশন নির্বাচনী বিধিমালায় ৮৪ ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য হলো নির্বাচনের সময়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত সব ব্যক্তির কমিশনের নিয়ন্ত্রণে কাজ করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি। দুর্ভাগ্যবশত বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন, যার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হলো খুলনা ও গাজীপুরে কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগে অপারগতা। যদি কমিশন নির্বাচনী অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে খুলনায় দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারত, তাহলে গাজীপুরে তার পুনরাবৃত্তি ঘটত না এবং সেখানে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হতো।
পরিশেষে এটি সুস্পষ্ট যে বিগত মেয়রের সময়ে উন্নয়ন না হওয়া এবং সরকারদলীয় প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের অর্থবিত্ত, মহানগরব্যাপী তাঁর ব্যাপক
প্রচার-প্রচারণা ও বিভিন্ন ধরনের সমাজ উন্নয়ন কার্যক্রম গাজীপুরে ক্ষমতাসীন দলের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থা সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে গাজীপুরে হয়তো তাঁরা এমনিতেই বিজয়ী হতেন। তবে এ বিজয় ভীষণভাবে ম্লান হয়েছে তাঁদের কর্মীদের বাড়াবাড়ি এবং নির্বাচন কমিশনের নতজানু ও একচোখা আচরণে।
আশা করি, নির্বাচন কমিশন আসন্ন সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে খুলনার মডেলের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঠেকাবে এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করবে, যদিও এরই মধ্যে সিলেট ও রাজশাহীতে নির্বাচনকেন্দ্রিক ধরপাকড়ের এবং বরিশালে কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে জোর করে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের অভিযোগ উঠেছে। আশা করি, কমিশন বিষয়গুলো দ্রুত খতিয়ে দেখবে।