দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভাগ সিলেটে মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় এ সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে ৯ জন মারা গেছেন, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ মৃত্যু। আর একই সময়ে নতুন করে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৩৬২ জনের দেহে।করোনার সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মুমূর্ষু রোগীর সংখ্যাও। এ কারণে সাধারণ শয্যার পাশাপাশি আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) শয্যার চাহিদা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। তবে চাহিদার তুলনায় কম আইসিইউ বেড থাকায় এখানকার বিদ্যমান হাসপাতালগুলোতে রোগীদের আইসিইউ সেবা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিভাগে নির্ধারিত আইসিইউ শয্যা আছে মোট ৭৪টি। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে কোভিড ডেডিকেটেড শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ১৬টি, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮টি এবং মৌলভীবাজার আধুনিক হাসপাতালে ৫টি শয্যা রয়েছে। এর বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে আছে আরও ৪৫টি শয্যা থাকলেও বিভাগের বাকি দুই জেলা সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয় সিলেট সূত্রে জানা যায়, বুধবার (৭ জুলাই) সকাল ৮টা পর্যন্ত সিলেট বিভাগের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলে মোট ৪৯২ জন করোনা রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে সিলেট জেলার হাসপাতালে ৪৪৪ জন, সুনামগঞ্জে ২৩ জন, হবিগঞ্জে ০৭ জন এবং মৌলভীবাজারের হাসপাতালে ১৮ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন।গত কিছু দিন থেকে সিলেট বিভাগে করোনা শানাক্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি-বেসরকারি সকল হাসপাতালের আইসিইউ বেড ভরে গেছে রোগীতে। এ কারণে নতুন করে আইসিইউতে কোনো রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতেও কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। এ কারণে সেখানে গিয়েও রোগীদের ভর্তি করতে পারছেন না স্বজনরা।বুধবার দুপুরে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে ষাটোর্ধ্ব রোকেয়া বেগমকে শামসুদ্দিন হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার স্বজনরা। তার ছেলে জানান, অক্সিজেন লেভেন কমে যাওয়াতে আইসিইউর প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু সকাল থেকে নগরের সবকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেছেন; কোথাও আইসিইউ বেড পাননি। তাই বাধ্য হয়ে শামসুদ্দিন হাসপাতালের সাধারণ বেডে ভর্তি করেছেন। সেখানে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে তাকে।
একই কথা জানালেন সুনামগঞ্জের যুবক লোকমান। তিনি করোনা পজিটিভ মাকে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। মায়ের অক্সিজেন মাত্রা কমে যাওয়ায় দ্রুত তাকে আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু তিনি সিলেট নগরের কোনো হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি পাননি। মায়ের শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। আইসিইউতে নিতে পারলে সুস্থ হয়ে উঠতেন। কিন্ত কোনো হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানালেন তিনি।সিলেটের সিনিয়র সাংবাদিক শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী বলেন, বুধবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত চিকিৎসক, হাসপাতালের মালিক ও পরিচিতজন মিলে ৩০ জনকে ফোন দিয়েছিলাম একটি আইসিইউ বেডের জন্য। সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি নেই। কেউ কোনো আশ্বাসও দিতে পারছেন না। এই হচ্ছে সিলেটের বর্তমান কোভিডের চিকিৎসা পরিস্থিতি। শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. সুশান্ত মহাপাত্র জানান, হাসপাতালে ১৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৪টিতে রোগী ভর্তি করা হয়, আর বাকি দুই শয্যা ডায়ালাইসিসের জন্য ফাঁকা রাখা হয়। কয়েকদিন ধরে কোনো আইসিইউ শয্যাই ফাঁকা নেই। হাসপাতালের সাধারণ শয্যাও রোগীতে পূর্ণ বলে জানান তিনি।
স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেটের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. নুরে আলম শামীম জানান, প্রতিদিন যেভাবে শনাক্ত বাড়ছে তাতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। যে হারে রোগী বাড়ছে, তাতে আইসিইউ বৃদ্ধি করাও সম্ভব নয়; আর তা সময় সাপেক্ষও। এ সংকট থেকে উত্তোরণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাই সবাইকে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ করেন তিনি।স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার সকাল ৮টার পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় বিভাগের চার ল্যাবে ১০৪৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩৬২ জনের পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। আর সুস্থ হয়েছেন ১২৫ জন। গত বছরের ১০ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত সবমিলিয়ে সিলেট বিভাগের চার জেলায় করোনা ভাইরাসে মোট শনাক্তের সংখ্যা ২৭ হাজার ৭১৬ জনে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ২৪ হাজার ৩৪২ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ৫০২ জনের।