সিলেট অফিস :: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় বহুমুখী। তিনি একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গীতিকার। বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী এই বিশ্বকবির সিলেট আগমনের শতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর। ১৯১৯ সালের এই দিনে সিলেট সফরে এসেছিলেন সাহিত্যের এই বরপুত্র। নিজের একমাত্র ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে সাথে করে সিলেটে আসা রবীন্দ্রনাথ এখানে ছিলেন তিন দিন।
গীতাঞ্জলি’র জন্য রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে। এর পর থেকে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। তখনকার প্রধানতম কবি রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে আগ্রহ তৈরি হয় সিলেটেও।
ইতিহাসের তথ্য বলছে, কবিগুরুকে একাধিকবার সিলেট সফরের আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি নানা কারণ দেখিয়ে অপরাগতা প্রকাশ করেন। শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজ, শ্রীহট্ট মহিলা সমিতি, আনজুমানে ইসলামিয়াসহ বিভিন্ন সংগঠন তাঁকে সিলেট সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে তারবার্তা পাঠায়। রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই কলকাতা থেকে গুয়াহাটি হয়ে শিলংয়ে যাতায়াত করতেন। ১৯১৯ সালে (বাংলা ১৩২৬ সন) অবকাশ যাপনে তিনি শিলংয়ে এলেন। শিলং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। সিলেট সীমান্তের ঠিক ওপারে অবস্থান মেঘালয়ের।
ওই সময় এমসি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সুরেশ চন্দ্র সেন গুপ্ত ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষে তারবার্তায় রবীন্দ্রনাথকে সিলেটে আসার আমন্ত্রণ জানান। রাজি হয়ে যান কবি। সিলেটে পড়ে যায় সাজসাজ রব। কিন্তু কবির স্বজনরা তাঁকে আসতে দিতে চান না; কারণ, শিলং থেকে সিলেটে আসার পথ ছিল দুর্গম। বর্তমানে সিলেট থেকে শিলং যাওয়ার যে সড়ক, তা ওই সময় ছিল না। রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নেন শিলং থেকে গুয়াহাটি ফিরে যাবেন। সেখান থেকে তিনি রেলযোগে লামডিং বদরপুর এবং করিমগঞ্জ হয়ে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া জংশনে এসে পৌঁছান ১৯১৯ সালের ৪ নভেম্বর রাতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিলেট আগমনকে কেন্দ্র করে গঠন করা হয় অভ্যর্থনা পরিষদ। পরিষদের সভাপতি ছিলেন শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক আব্দুল মজিদ, যিনি কাপ্তান মিয়া নামে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি আসাম প্রাদেশিক পরিষদে শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে বরণ করতে আসামের বদরপুর পর্যন্ত যায় সিলেটের একটি প্রতিনিধি দল।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, কুলাউড়ায় রাত্রিযাপন করে ১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর সকালে ট্রেনযোগে সিলেট রেলস্টেশনে পৌঁছান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওই সময় খান বাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ, রায়বাহাদুর সুখময় চৌধুরী, তৎকালীন ভাইসরয়ের কাউন্সিল অব স্টেটসের সদস্য মৌলভী আবদুল করিম, রায়বাহাদুর প্রমোদ চন্দ্র দত্ত ও শ্রীহট্ট মহিলা সমিতির নলিনবালা চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। সিলেটের প্রখ্যাত পরিবারগুলোর মধ্যে মজুমদার বাড়ি, কাজী বাড়ি, দস্তিদার বাড়ি, এহিয়া পরিবারের সদস্যরাও স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন।
ওই সময় সুরমা নদীতে ক্বিনব্রিজ ছিল না। রেলস্টেশন থেকে সুরমার ওপার এসে কবি, তাঁর ছেলে ও পুত্রবধু বজরায় (বিশেষ ধরনের নৌকা) আসেন এপারে চাঁদনী ঘাটে। ফুল আর লালসালু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল চাঁদনী ঘাট। কবির থাকার আয়োজন ছিল নয়াসড়কস্থ পাদ্রী বাংলোয়। চাঁদনী ঘাট থেকে সেখানে যান কবি। ওইদিন (৫ নভেম্বর) সন্ধ্যায় বন্দরবাজারস্থ ব্রাহ্মমন্দিরে উপাসনায় যোগ দেন তিনি। পরে রাত্রিযাপন করেন পাদ্রী বাংলোয়।
৬ নভেম্বর ১৯১৯। এ দিন সকাল ৮টায় রতনমনি লোকনাথ টাউন হলে (বর্তমানে সারদা হল, পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার যেখানে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে উকিল অম্বিকা চরন দে রচিত উদ্বোধনী সংগীত গান যতীন্দ্র মোহন দেব চৌধুরী। সংগীতটি ছিল এ রকম-‘মাতৃভাষার দৈন্য নেহারি কাঁদিল তোমার প্রাণ/ হৃদয় কমলে শ্রেষ্ঠ আসন বাণীরে করিলে দান। পুরিল বঙ্গ নবীন আনন্দে/ উঠিল বঙ্গ পুলকে শিহরি শুনিয়া নবীন তান। এ নহে দামামা, নহে রনেভেরী, এ যে বাঁশরীর গান। সে সুধা লহরী মরমে পশিয়া আকুল করিল প্রাণ। সপ্ত সাগর সে সুরে ছাইল, চমকি জগৎ সে গান শুনিল।/ বিশ্ব কবির উচ্চ আসন তোমারে করিলে দান। হেথায় ফুটেনা শ্বেত শতদল, ফুটেনা হেথায় রক্ত কমল, বনফুল দুটি করিয়া চয়ন এনেছি দিতে উপহার। এ দীন ভূমির ভক্তি অর্ঘ্য চরণে লভুক স্থান।’
খান বাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদের সভাপতিত্বে সে সংবর্ধনায় বক্তব্য রাখেন কাপ্তান মিয়া, অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন নগেন্দ্র চন্দ্র দত্ত। বেহালা বাজিয়েছিলেন যামিনীকান্ত রায় দস্তিদার। পরে বক্তব্য রাখেন কবি। তাঁর সে ‘বাঙালির সাধনা’ শীর্ষক বক্তব্য ছিল দেড় ঘন্টার, যেটি শুনে শুনে লিখে রাখেন উপেন্দ্রনারায়ণ সিংহ মজুমদার ও মনোরঞ্জন চৌধুরী। এ বক্তব্যটি পরে প্রবন্ধ আকারে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৩২৬ বাংলা সনের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমসি কলেজের বাংলা ও সংস্কৃতির অধ্যাপক নলিনী মোহন শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। পরে বেলা ২টার দিকে ব্রাহ্মমন্দিরে শ্রীহট্ট মহিলা সমিতির সংবর্ধনায় যোগ দেন। অনুষ্ঠানে মানপত্র পাঠ কনের নলিনীবালা চৌধুরী। সেখান থেকে মাছিমপুরে মণিপুরী পল্লীতে যান রবীবন্দ্রনাথ। মণিপুরী হস্তশিল্প প্রদর্শনী ছাড়াও মণিপুরী নৃত্য এবং গান দিয়ে বরণ করা হয়েছিল কবিকে। মণিপুরী নৃত্য কবিকে মুগ্ধ করে। তিনি শান্তিনিকেতনের পাঠ্যতালিকায় মণিপুরী নৃত্যের প্রবর্তন ঘটান। এছাড়া সন্ধ্যায় রতনমনি লোকনাথ টাউন হলে দেশের দুর্দশা ও এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বিষয়ে ভাষণ দেন কবি।
১৯১৯ সালের ৭ নভেম্বর। সিলেট সফরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ দিন। এ দিন তাঁকে এমসি কলেজে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এখানে ‘আকাক্সক্ষা’ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন কবি। ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্যোগে তাঁর হাতে একটি মানপত্র তুলে দেওয়া হয়। এ বক্তৃতাটি পরবর্তীতে ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল চৌহাট্টাস্থ এমসি কলেজের হোস্টেলে। ওই সময় এমসি কলেজ ছিল বন্দরবাজারে (বর্তমানে যেখানে হাসান মার্কেট) এবং কলেজের হোস্টেল ছিল চৌহাট্টায় (শহীদ মিনারের বিপরীতে, বর্তমানে একটি ব্যাংকের শাখ যেখানে)। অনুষ্ঠান শেষে অধ্যক্ষ অপূর্ব চন্দ্র দত্তের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন রবীন্দ্রনাথ। ওইদিন সন্ধ্যায় রায়বাহাদুর নগেন্দ্র চৌধুরীর বাসভবনে প্রীতিসম্মেলনে যোগ দেন তিনি। ৮ নভেম্বর সকালে রেলযোগে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরায় যান কবি।