ব্রিট বাংলা ডেস্ক : ২০০৮ সালে জনসংখ্যারভিত্তিতে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ যে ভুল ছিল তা প্রমাণিত হয়েছে। সেই ভুল সংশোধনে কাজ করছে বর্তমান কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। বর্তমান কমিশন ভৌগলিক অখন্ডতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করছে।
এটিএম শামসুল হুদার কমিশন সীমানা পুনর্নির্ধারণে জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দিয়েছিল। এতে গ্রামাঞ্চলে আসন কমে যায়। এর বিপরীতে আসন বেড়ে যায় শহরাঞ্চলে। ওই কমিশন আঞ্চলিক অখণ্ডতাভিত্তিক প্রশাসনিক সুধিবা বিবেচনায় না এনে শুধু জনসংখ্যাকেই গুরুত্ব দিয়েছিল। প্রায় চার হাজার আপত্তি পড়লেও তা আমলে নেয়া হয়নি।
আসন ব্যাপক ওলটপালট করার ফলে সারাদেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। খাতাকলমে ৮৪টি আসন বিন্যাসের কথা বলা হলেও সেনা সমর্থিত কমিশন বাস্তবে ১৩০টি আসনের পরিবর্তন এনেছিল। তবে সেসব আসনের সীমানায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে। ২০১৩ সালে কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন ৫৩টি আসনে পরিবর্তনের পর বর্তমান কমিশন আরো ৩৮টি আসনে পরিবর্তন এনেছে। যদিও ২০০৮ সালে গ্রামাঞ্চল থেকে সাড়ে ১০টি আসন কর্তন করা হলেও সেগুলি এখনো ফেরত দেয়া সম্ভব হয়নি।
ইসির সংশ্লিষ্টদের মতে, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে সবচেয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয় ২০০৮ সালে। ১৯৭৬ সালের সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশের ৮ ধারা লংঘন করে বিগত তিন সদস্যের কমিশন। তবে বর্তমান কমিশন জনসংখ্যার চেয়ে ভৌগলিক অখণ্ডতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এতে করে প্রশাসনিক সুবিধা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে আসন পুনর্বিন্যাস করে ঢাকা মহানগীর আসন সংখ্যা ৮ থেকে বাড়িয়ে ১৫টি করতে হয় এটিএম হুদা কমিশনের। পরে অবশ্য বিগত কমিশন জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বিন্যাসকে ‘বড়’ ভুল হয়েছে বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিল। এজন্য বিদায়ের আগ মুহূর্তে এটিএম শামসুল হুদা কমিশন ঢাকার আসন ১০টি করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সেই প্রস্তাব পরে বর্তমান কমিশনের কাছে ফেরত পাঠানো হয়।
১৭টি জেলার আসন রদবদল ঃ ১৭টি জেলার আসন হ্রাস-বৃদ্ধি করেছিল বিগত হুদা কমিশন। এর মধ্যে ১২টি জেলা থেকে ১০.৫টি আসন কর্তন করা হয়। তার মধ্যে ৯টি জেলা থেকে একটি করে আসন কর্তন করা হয়েছিল। জেলাগুলো হলো-সিরাজগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, বরগুনা, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, কুমিল্লা। আর পিরোজপুর, বরিশাল ও ময়মনসিংহ থেকে .৫ শতাংশ আসন কাটা হয়। আসন বৃদ্ধি করা হয়, ঢাকায় ৭টি, চট্টগ্রামে ১, গাজীপুরে ১টি, রাজশাহীতে ১টি ও নেত্রকোনায় .৫ আসন।
শহরে আসন বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ইত্তেফাককে বলেছিলেন, ঢাকায় আসন বৃদ্ধি কোনভাবেই ঠিক হয়নি। আমাদের সব উন্নয়ন শহরকেন্দ্রীক। শাসন ব্যবস্থাও কেন্দ্রীভূত। ক্ষমতার বলয়ের বাইরে গ্রামের মানুষের প্রতিনিধিত্ব দিন দিন কমে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সারাদেশের সংসদীয় আসনগুলো একইরূপে থাকলেও ২০০৮ সালে এসে হঠাত্ করে ব্যাপক রদবদল আনে বিগত কমিশন। ঐতিহ্যবাহী আসনগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা হয়। যে ১৩০টি আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল সেসব এলাকা থেকে ২০০৮ সালের জুনের দিকে ৩ হাজার ৬৯০টি আপত্তি জমা পড়ে কমিশনে। সীমানা পুনঃনির্ধারণের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত ১৩টি মামলা হয়। পরে আদালত মামলায় কমিশনের অনুকূলে রায় প্রদান করে।
ভৌগোলিক অখণ্ডতার পক্ষে বর্তমান ইসি ঃ গত ১৪ মার্চ ৩৮টি আসনের সীমানায় পরিবর্তন এনে তিনশ’ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়া প্রকাশ করে বর্তমান ইসি। প্রস্তাবিত ৩৮টি আসনে ভৌগোলিক অখণ্ডতা, প্রশাসনিক এলাকা যোগ ও বিলুপ্ত ছিটমহল যোগ করা হয়েছে। কমিশন বলেছে, খসড়া তালিকা নিয়ে কারো কোনো দাবি-আপত্তি থাকলে ১ এপ্রিল বিকাল ৫টা পর্যন্ত আবেদন করা যাবে। কমিশন দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে ৩০ এপ্রিল সংসদীয় আসনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে।
সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে ছয়টি বিষয়কে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে প্রতি জেলার বিদ্যমান মোট আসন সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখা। প্রশাসনিক ইউনিট বিশেষ করে উপজেলা এবং সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড যথাসম্ভব অখণ্ড রাখা। ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌর এলাকার ওয়ার্ড একাধিক আসনে বিভাজন না করা। নতুন প্রশাসনিক এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করা। বিদ্যমান সীমানায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের কারণে নতুন সীমানা নির্ধারণ করা এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা যথাথথ বিবেচনা করা। তবে ইসির প্রকাশিত খসড়া সীমানার তালিকায় এখনো কিছু উপজেলা খণ্ডিত অবস্থায় রয়েছে। এ বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাস্তবতা বিবেচনায় এগুলো একত্রিত করা সম্ভব হয়নি। এরপর খসড়ার পক্ষে-বিপক্ষে মত জানিয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এমনকি বেশ কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্য সিইসির সঙ্গে সাক্ষাত্ করে দাবির পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
সীমানা পুনর্নির্ধারণে সংশ্লিষ্টদের মতে, জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দিলে ঢাকায় সংসদীয় আসন করতে হবে ৩০টি। এর ফলে গ্রামের আসন আরো কর্তন করতে হবে। এজন্য ঢাকার আসন নির্দিষ্ট করে দেয়া জরুরি। জনসংখ্যাকে কোনোভাবে গুরুত্ব দেয়ার সুযোগ নেই। সীমানা পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশটি সংশোধনের কাজ চলছে। এই আইনটি বাংলায় রূপান্তর করে বেশকিছু প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানো হবে।