দুই কোরিয়ার এক অংশে গিয়ে অন্তত সেখানকার জনগণের এক হওয়া বা এক কোরিয়ার আকাঙ্ক্ষাটা ভালোভাবেই টের পেয়েছিলাম। ২০১৪ সালের সেই সময়টায় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন পার্ক গিউন-হে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির দায়ে তিনি এখন জেলে, ২৪ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে তাঁর। কিন্তু ২০১৩ সালে ক্ষমতায় এসে বিদেশনীতির ক্ষেত্রে তিনি যে ‘ট্রাস্ট পলিটিক’ নীতি নিয়েছিলেন, তাঁর ঘোষিত লক্ষ্য ছিল সন্দেহ-অবিশ্বাস ও সংঘাতের পরিবেশকে আস্থা ও সহযোগিতায় রূপান্তর ঘটানো। এর মধ্য দিয়ে একটি ‘নতুন কোরীয় উপদ্বীপের’ স্বপ্নের কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার যে তখন ‘এক কোরিয়া’ ইস্যুকে বিশ্বের সামনে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে চাইছে, তা সেই সম্মেলনে গিয়ে টের পেয়েছিলাম। গত শুক্রবার দুই কোরীয় নেতার ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ ও কোরীয় উপদ্বীপে নতুন ইতিহাস রচনার পেছনে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দাপ্রধানের ভূমিকার কথা আলোচনায় এসেছে। দুই কোরিয়ার সম্পর্কোন্নয়নে ১৮ বছর ধরে কাজ করে গেছেন তিনি। বোঝা যায়, আরও কত ধরনের অজানা উদ্যোগ, উদ্যম আর দীর্ঘ চেষ্টার ফল শুক্রবারের এই বৈঠক।
আর উত্তর কোরিয়া তো দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে সারা দুনিয়ার কাছে এক রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে। সেখানকার জনগণ কী ভাবে বা তারা আদৌ দক্ষিণের সঙ্গে এক হতে চায় কি না, তা বোঝার কোনো পথই বিশ্ববাসীর সামনে খোলা ছিল না। স্নায়ুযুদ্ধের খপ্পরে পড়ে এক দেশ দুই ভাগ হয়ে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে। এই প্রতিযোগিতা সব ক্ষেত্রে সুস্থ কিছু নয়। দুনিয়ার আলোচনার কেন্দ্রে এখন দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী যে পানমুনজুম গ্রাম, সেখানে গিয়ে সেই অসুস্থতার কিছু দিক টের পেয়েছিলাম। সেটাই একমাত্র এলাকা, যেখানে গিয়ে আপনি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উত্তর কোরিয়াকে অথবা উত্তর কোরিয়া থেকে দক্ষিণ কোরিয়াকে দেখতে পাবেন। স্নায়ুযুদ্ধের সেই দিনগুলোতে দুই কোরিয়ার মধ্যে একসময় প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল—কোন দেশের পতাকা কত উঁচুতে উড়বে। দক্ষিণের পতাকা যদি ১০০ ফুট উঁচুতে ওড়ে, তো কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেছে উত্তরের পতাকা ১২০ ফুট উঁচুতে উড়ছে। এভাবে আর কত উঁচুতে ওঠা যায়! একসময় খ্যামা দিতে হয়েছে এই প্রতিযোগিতা। দুই দেশ মুখোমুখি লাউড স্পিকারও বসিয়েছে। ‘লাউড স্পিকার প্রোপাগান্ডা’ নামে পরিচিত এই মাইকযুদ্ধে নিজ দেশের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা, এমনকি গালিগালাজও চলেছে। ষাটের দশকে শুরু হওয়া সেই মাইকযুদ্ধে বিরতি থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তা বন্ধ করা হয়নি। শুক্রবারের বৈঠক এর স্থায়ী অবসানের একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এ নিয়ে মজার প্রতিবেদনও করেছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সেই যুগ শেষ হয়েছে অনেক আগে। একই কারণে ভাগ হওয়া এক দেশ ভিয়েতনাম ও জার্মানি আবার এক হয়েছে। কিন্তু উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়া সেই পথ ধরতে পারেনি। দক্ষিণের কাছ থেকে এক হওয়ার স্বপ্নের কথা আমরা বেশ আগে থেকেই শুনছি। উত্তরের নেতা কিম জং–উন যখন এবার দক্ষিণের মাটিতে পা রেখেছেন, তখন সেই দেশটির মনোভাবেরও ইঙ্গিত মিলল। কিম স্পষ্ট করেই বলেছেন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া আবার এক দেশে ঐক্যবদ্ধ হবে। স্নায়ুযুদ্ধ বা সোভিয়েত-মার্কিন দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা—যা-ই বলা হোক না কেন, কোরিয়া সেই সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে ভাগ হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন দুই দেশের জনগণ বা দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এক হতে চাইলেই কি সহজে তা পারবে? পঞ্চাশ-ষাট বা আশি-নব্বইয়ের দশকের বিশ্ব পরিস্থিতি এখন আর নেই। কিন্তু এর অর্থ এ-ও নয় যে দক্ষিণ বা উত্তর কোরিয়ার ইচ্ছাই সব। নতুন আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি বা বাস্তবতা দুই কোরিয়ার এক হওয়ার স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো!
কোরীয় উপদ্বীপের সমস্যা জটিল। প্রায় এক যুগ ধরে কোরীয় উপদ্বীপের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে অনিয়মিতভাবে ছয় দেশের একটি উদ্যোগ নানা সময়ে কাজ করেছে। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া বাদে বাকি দেশ চারটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও জাপান। দুই কোরিয়ার এক হওয়ার ক্ষেত্রে এই চার দেশের স্বার্থ ও স্বার্থের হিসাব-নিকাশ বড় বাধা হিসেবে হাজির হতে পারে।
অর্থনৈতিক ও সামরিক—দুই শক্তির বিচারেই দক্ষিণ কোরিয়া এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। সামরিক শক্তিতে দুনিয়ার ১৩৬টি দেশের মধ্যে দেশটির অবস্থান ৭ নম্বরে। আর জিডিপি সূচকে ১৪ নম্বরে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন বিবেচনায় নিলে উত্তর কোরিয়াকে কোনোভাবেই দক্ষিণের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কিন্তু দুই কোরিয়া এক হলে নিশ্চিতভাবেই দেশটি এশিয়ার এক বড় শক্তিতে পরিণত হবে। শক্তিশালী ও এক কোরিয়াকে বাকি দেশগুলো কীভাবে নেবে?
উত্তর কোরিয়া এত দিন কার্যত চীনের মাধ্যমেই দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। চীনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক ঐতিহাসিক। গত শুক্রবার পানমুনজুমে যে ঘটনা ঘটল, তার ঠিক এক মাস আগে কিম উন বেশ ঘটা করে চীন সফর করে এসেছেন। মাস ছয়েক আগে কিমের যে রূপ ও অবস্থান বিশ্ব দেখেছে, সেখান থেকে এই নতুন কিমের জন্মের পেছনে যে চীনের বড় ভূমিকা রয়েছে, তা পরিষ্কার। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চীনের সীমান্ত রয়েছে এবং সেই হিসেবে ভবিষ্যতের অবিভক্ত কোরিয়াও হবে চীনের সঙ্গে সীমান্ত দিয়ে যুক্ত একটি দেশ। উত্তর কোরিয়ার ওপর চীনের দীর্ঘদিনের যে একক প্রভাব, ঠিক সেই মাত্রায় না হলেও এক কোরিয়ার ওপরও চীন যে তার পুরো প্রভাব বজায় রাখতে চাইবে, তাতে খুব সন্দেহ নেই। দক্ষিণ চীন সাগরে যেকোনো মূল্যে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মরিয়া চীনের জন্য অনুগত একক কোরিয়াই হবে চাওয়া।
বিশ্বরাজনীতিতে নতুন করে প্রভাব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বেশ জোরেশোরে মাঠে নেমেছে রাশিয়া, সিরিয়ায় যার আলামত আমরা এখন দেখছি। পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়ন সূত্রে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কও ঐতিহাসিক। চীনের মতো রাশিয়াও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সীমান্ত দিয়ে যুক্ত। একক কোরিয়ার ওপর রাশিয়াও প্রভাব বা কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চাইবে। ফলে দুই কোরিয়ার এক হওয়ার প্রক্রিয়ায় রাশিয়া তার স্বার্থের অনুকূলেই সব চাল দেবে এটাই স্বাভাবিক।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া—এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এ দুটি দেশের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা শক্ত ভাষায় বললে যে ‘শত্রুতা’, তার ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী যুগে জাপান কোরীয় উপদ্বীপকে তাদের উপনিবেশ বানিয়েছিল। কোরীয় জনগণের মন থেকে জাপানের দখলদারি ও অপমানের সেই ক্ষত মুছে যায়নি। দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণের মধ্যে জাপানকে পছন্দ না করার মনোভাব ২০১৪ সালে দেশটি সফরের সময় টের পেয়েছিলাম। একক ও শক্তিশালী কোরিয়া জাপানের কাছে সুখকর কিছু না-ও হতে পারে।
পানমুনজুমে গত শুক্রবারের ঐতিহাসিক ঘটনার পর বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে মে মাসের শেষে অথবা জুনের শুরুতে ট্রাম্প-উন বৈঠকের দিকে। উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি থেকে সরে আসতে রাজি করাতে পারাটা যুক্তরাষ্ট্র বা ট্রাম্পের জন্য বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ট্রাম্প আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে সীমিত করার পথ নিয়েছেন। কিন্তু তা আসলে কতটা? বিভক্ত কোরিয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র চীন ও রাশিয়ার কাছাকাছি তার সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে পারছে। কিন্তু দুই কোরিয়া এক হয়ে গেলে তা সম্ভব না-ও হতে পারে। চীন বা রাশিয়া কেউই তা মানবে বলে মনে হয় না।
এটা পরিষ্কার যে এক কোরিয়ার বিষয়টি শুধু উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা দুই অংশের জনগণের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করছে না; আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের হিসাব-নিকাশগুলোও সম্ভবত মিলতে হবে। তবে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ছয় মাসের মধ্যে পরিস্থিতি কতটা বদলে যেতে পারে, তা তো আমরা দেখলাম। মনে আছে, চার বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রতিনিধি সিমন মান্ডি সিউলে বিশ্ব সাংবাদিক সম্মেলনের এক আলোচনায় বলেছিলেন, একমাত্র উত্তর কোরিয়ার সরকার উৎখাতই দুই কোরিয়ার এক হওয়ার পথ তৈরি করতে পারে। তাঁর কথা শুনে তখন দুই কোরিয়ার এক হওয়ার স্বপ্নকে অনেক দূরের মনে হয়েছিল। সাংবাদিক বা বিশ্লেষকদের পথ ধরে সব সময় ইতিহাস এগোয় না। গত শুক্রবারের উন-মুন বৈঠক দুই কোরিয়ার এক হওয়ার সেই স্বপ্নকে অনেকটাই কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক