ইমরান আহমেদ চৌধুরী : ভাবতেও কেমন যেন আশ্চর্য লাগে বাংলাদেশের বয়স আজ প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই – চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই সেই উত্তাল দিন গুলো। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে নিজের অজান্তেই । সেই ১৯৭১ এর স্মৃতির পাতাগুলো উল্টাই আর কেন জানি চোখ ঝলসে আসে অশ্রুতে । উদ্দীপনা, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন ভরা বাংলা আমার । একাত্তরের নির্যাতন, ঘর থেকে নির্বাসন, রিফিউজি ক্যাম্পে বসতি, পরিশেষে স্বাধীনতা পাওয়া । যেন একটা স্বপ্নের মত কিছু একটা পাওয়া যায় সেই অনুভিতি থেকে । তাই তো বারবার ফিরে যাই ঐ স্মৃতির গহ্বরে অবচেতনভাবে । সেই ফেব্রুয়ারী – মার্চ ১৯৭১ সালে যখন আমি ছিলাম ১০ বছর বয়সী এক বালক মাত্র– স্ফটিক এর মত স্বচ্ছ সেই দিন গুলো মনের সেলুলয়েডে।
পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙ্গালীরাই প্রথম যারা কিনা একটি রাষ্ট্রের বৃহতম জনগোস্টি হয়েও পাকিস্তান এর ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল কারণ বৈষম্য, পুঁজির সমবণ্টন এর অভাবে, এথনিক হিংসার জন্য । সর্বপরি গণতন্ত্র এর প্রতিজ্ঞা খণ্ডন করে, যখন আমরা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিজয়ী তখনও স্বৈরাচারী পাকিস্তান আর্মির জান্তারা আমাদেরকে সরকার গঠন করতে গড়িমসি করতে থাকে । ক্ষোভের বীজ বপন হতে থাকে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে, ১৯৫২ সাল থেকে, ১৯৬৬ সাল থেকে, ১৯৬৯ সাল থেকে এবং এর যবনিকা হয় ১৯৭১ সালের সেই কাল রাতে যখন রাতের অন্ধকারে নিস্তব্দ ঘুমন্ত নগরী ঢাকায় ঐ বর্বর হিটলারের নব্য বংশধর এররূপে আবির্ভূত পাকিস্তান হানাদার বাহিনী শুরু করে এক কুরুক্ষেত্র – রাতের অন্ধকারে শুরু করে এক ধ্বংসযজ্ঞ, কামান, ট্যাঙ্ক, আরটিলারী, মেশিন গানের গুলিতে হত্যাকরে ঘুমন্ত মা, শিশু, আবাল বৃদ্ধ বনিতাদের পশুর মত । এক রাত্রে ৭০০০ মানুষকে নিধন করে এই পাকিস্তানি পাঞ্জাবি বাহিনী । জাতির জীবনে নেমে আসে এক কুৎসিত অমনিসা । কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, মহিলা হোস্টেল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় হাজার হাজার তরুণী ছাত্রীদের – অতঃপর চালায় ঐ বর্বরবাহিনী এক পৈশাচিক নারী নির্যাতন, রেপ এবং অত্যাচার এর মাতম খেলা নরপিশাচ তইমুর লং , হালাকু খান চেঙ্গিস খানের পস্যোপুত্রের মত । বাঙ্গালী জাতি পর দিনসকালে একটু থমকে দাঁড়ায় এক মিলি মাইক্রো মুহূর্তের জন্য আর সেই সকাল থেকেই শুরু হয় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ক্রমান্বয়ে যা পর্যবসিত হয় আমাদের ৩৫০০ হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অধ্যায় মহান মুক্তিযুদ্ধ ।
ঐতিহাসিকভাবে আমরা বাঙ্গালিরা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগত জনগোস্টি – চীনের হান এবং আরবদের পর আমারাই হলাম তিন নম্বর ; কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য যে গত ১০০০ বছরেরও বেশী সময় যাবত আমারা ভীনদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের করায়াত্ত ঔপনিবেশিক করতরাজত্ব ছিলাম। এক কালের পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধশালী দেশ হয়েও আমাদের স্কন্ধের উপর নেমে এসেছিল গোলামির জোয়াল। ইতিহাস রিসার্চ করতে যেয়ে বের হয়ে আসে, ২৪ খ্রিস্টাব্দে রোমের সাম্রাজ্যের মসনদের সব সম্রাট এবং সাংসদ ( সিনেটর) দের পরিদেহ খদ্দর জাতীয় সেই বিসাল গেরুয়া/সাদা রঙের ধুতিকাপড় বেঙ্গল থেকেই রফতানি করা হত, ১৭৯০ সালে ব্রিটিশ শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হবার আগে বেঙ্গল বছরে সাত শ নব্বই টন সুতি কাপড় রফতানি করত যুক্তরাজ্যে। অথচ সেই সুজলা সুফলা সমৃদ্ধশালী দেশ টাকে পশ্চিমাশাসক গোস্টী ক্রমান্নয়ে আমাদের কে অবহেলিত করতে থাকে, জোড় করে ওরা স্বাধিকার কেড়ে নিচ্ছিল নিভৃতে সঙ্গোপনে।
বাঙ্গালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ মহান নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং উনিই প্রথম দেখায় বাঙ্গালিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন – সেই এই মহানস্বাধীনতার রূপায়ক । এ বছরের স্বাধীনতা দিবস এবং ঐ বীর নেতার জন্মশত বার্ষিকী এই মহালগ্নে তাঁকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ কদমবুচি – প্রণাম ও সালাম । হিয়ালয় সমউঁচু এই ক্ষনজন্মা অকুতোভয় প্রটাগনিস্ট (নায়ক) এঁরনিকট আমারা সবাই কৃতজ্ঞ ।
আজকের সমাগত স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্বালে জানাই সেই সব শহীদদের আমার কৃতজ্ঞতা – বাঙ্গালি জাতি আজকের এই দিবসের শুভক্ষণে আবার জানাচ্ছে সেইবীর সেনানী মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির সশ্রদ্ধ সালাম ।
বিদেশে বসে বাংলায় লিখছি আর ভাবছি কিভাবে আমাদের এই ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতিকে আমাদের পরবর্তী বংশধরদের মাঝে সন্নিবেশিত করা যায় – ওদের ভাষায়? কারণ ওদেরকে আমাদের ভাষায় সম্পূর্ণ ভাবে বোধগম্য যাবে বলে মনে হয় না । ওরা যদি ওদের পূর্বপুরুষদের ঐ সব বীর গাথা না জানে তাহলে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাবে আমাদের এই অতি সমৃদ্ধশালী ইতিহাস । কিভাবে উদ্ভূত করা যায় আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এই এসব জানার জন্য? যে কোন জাতির অভিবাসী প্রজন্মের জন্য এইগুলো শুনা বা জানা বা উদযাপন করা অতীব একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। জ্ঞানীজনরা বলেছেন, ”কেই যদি তার পূর্ব পুরুষের অতীত না জানে এবং সে কোথা থেকে এসেছে তাহলে সে কি করে জানবে তাকে তার জীবনে কোথায় জেতে হইবে বা কোথায় যাওয়া উচিত ।’‘ তাই, ভাবছি কিভাবে আমাদের সম্প্রদায়ের বালক , বালিকা, যুবক ও যুবতিদেরকে সম্পৃক্ত করা যায় ওদের শিকড়ের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ত্যাগ এবং ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের সাথে ; ওদের যদি আমরা আমাদের ও ওদের পূর্ব পুরুষদের সাথে সেতু বন্ধন সৃষ্টি না করতে পারি তা হলে সেটা আমাদের স্বাধীনতা প্রজন্মের এক বিরাট অপারগতা ।
আসুন, আমরা যারা স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি সেই প্রজন্ম আমরা সবাই এই প্রজন্মের জন্য শুরু করি মৌখিক ( ওড়াল ) ইতিহাস বলার আসর কিংবা আসুন আমরা শুরু করি স্কুলে, কলেজে ও ইউনিগুলোতে গনযোগাযোগ বক্তৃতা সেশন ইংরেজিতে , যাতে এই প্রজন্ম অনুধাবন করতে পারে আমাদের গর্বিত পূর্ব পুরুষ/ নারীদের বিজয় গাথা যা শুনে এই নতুন অভিবাসী বালক, বালিকা, যুবক ও যুবতীরা শিখতে পারবে , জানতে পারবে ওরা কোথা থেকে এসেছে , ওদের পূর্ব প্রজন্ম কি জন্য করেছিল এত বড় আত্মত্যাগ । যা দিবে বর্তমান প্রজন্মকে ওদের জীবনের উত্তরণ ও প্রতিষ্ঠিত হবার এক নতুন ঠিকানা বা এক নতুন পরিপ্রেক্ষিত । বিলাতের জনপদে আগাছার মত গড়ে উঠা পরজীবী মগজ ধোলাইকারী দের হাত থেকে এই অবিভাসী তরুণ প্রজন্মকে উদ্ধার করার এটাই মোক্ষম পন্থা । নতুবা হারিয়ে যাবে এই প্রজন্ম অন্ধকার প্রান্তিকী করণ, মৌলবাদের ও চরমপন্থার বিভীষিকাময় নিকৃষ্ট নর্দমায় চিরতরে । যারা একদা করেছিল আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং আজ করে যাচ্ছে বিরোধিতা সঙ্গোপনে, বিষিয়ে দিচ্ছে ওদের মননকে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, শিখাচ্ছে ভিন দেশী সংস্কৃতি– নিস্তেজ করতে চাচ্ছে বাঙ্গালিত্ত দ্রবণ টাকে ।
ইমরান আহমেদ চৌধুরী : লেখক ও কলামিস্ট, ইউ কে।