‘হারিয়ে যাওয়া গরিব’দের গল্প

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: মনোরঞ্জন ব্যাপারী একজন বাঙালি নমশূদ্র। বরিশালের দলিত পরিবারে জন্ম। এখন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। ভারতের নাগরিক। দক্ষিণ কলকাতার মুকুন্দপুরে হেলেন কেলার বধির স্কুলে রান্নার কাজ করেন। একসময় রিকশা চালাতেন। এসব ছাপিয়ে মুহূর্তে বাংলার দলিত জীবনের অন্যতম ধারাভাষ্যকার তিনি। ক্রমাগত লিখছেন অস্পৃশ্যদের নিয়ে। লিখিয়ে হিসেবে তাঁর উত্থান নাটকীয়তায় ভরা। ক্রমে তা ভারতে বড় সংবাদ হয়ে উঠছে।

বয়স ৬৮ বছর হলেও প্রতিদিনই প্রচুর খাটতে হয় ব্যাপারীকে। প্রায় ১৫০ জনের রান্নার কাজ করেন। এই করতে করতে ১৫টা উপন্যাস এবং প্রায় দেড় শ গল্প লিখেছেন। একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। এ বছর জয়পুর সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়ে বাংলার এলিট সাহিত্যিকদের মনঃপীড়ার কারণ ঘটিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে মুভি তৈরির কথা হচ্ছে। সর্বশেষ আমাজনের সাবসিডিয়ারি ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ তাঁর বই অনুবাদ করে প্রকাশের স্বত্ব কিনে নিল। এতসব হচ্ছে একটি কারণে। মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ভাষায়, ‘আমি নিপীড়িত এই জীবন মেনে নিইনি।’ আরও বলেন, ‘সাহস করে এগোতে হয়।’

মনোরঞ্জনের জীবন সাহসেরই গল্প। লড়াইয়ের আখ্যান। তাঁর লেখনী শুনিয়ে চলেছে দেশভাগ, উদ্বাস্তু জীবন, রিফিউজি ক্যাম্প, উঁচু-নিচুর ভেদ, নকশাল আন্দোলনের কথা। খাদ্যের অভাবে মানুষের মৃত্যুর কথা। এসবের ভেতর দিয়ে ৬৮ বছর পেরিয়ে এসেছেন তিনি। লিখছেন এসব নিয়ে তীক্ষ্ণ আর রাগী ঝাঁজালো ভাষায়। লেখনীই তাঁর ক্ষমতায়ন। কারাগারে সহবন্দীরা তাঁকে লিখতে শিখিয়েছিল।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী সুশীল নন; দলিত জীবন বয়ান করছেন নির্ভেজাল দলিত কণ্ঠে। কলকাতার শিল্প-সাহিত্যের বনেদি জগতে তাঁর তেমন কদর হয়নি। বাকি ভারতে তিনি পরিচিতি পাচ্ছেন দ্রুত। বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে অনর্গল ‘ইতিবৃত্তে চন্ডাল জীবন’ শোনান শ্রোতাকে, যা মূলত তাঁর জীবনী। কিন্তু একই সঙ্গে তা বাংলার কোটি কোটি নমশূদ্র দলিতের আত্মকথাও। মনোরঞ্জন ব্যাপারী দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ এক শ্রেণিযুদ্ধের ক্ষুদ্র খণ্ডাংশ মাত্র।

দুই.

মনোরঞ্জন ব্যাপারী যাঁদের কথা লেখেন, বাংলাদেশে কি তাঁদের অস্তিত্ব আছে? কিংবা বাংলাদেশের মনোরঞ্জনরা কেমন আছেন? ১৯৪৭, ’৫০ কিংবা আগে-পরে তাঁরা সবাই কি চলে গেছেন?

এ প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর কঠিন। সরকারি আপত্তি আছে। দলিত পরিচয় নিয়ে অস্বীকৃতি আছে। এদের ‘দলিত’ না ‘অনগ্রসর গোষ্ঠী’ বলা হবে, এ নিয়ে প্রশাসনিক দ্বিধা আছে, যদিও এ দেশের ৬৪ জেলাতেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছেন; বাঁশফোর, তেলেগু, কানপুরীরা আছে। কয়েক লাখ চা-শ্রমিক আছেন। হাসপাতালগুলো ঘিরে ডোমেরা আছেন। শহরের মোড়ে মোড়ে জুতা সেলাইকারী ঋষিরা আছেন। রবিদাস আছেন। মুন্সিগঞ্জে বিশাল বেদেপল্লি আছে। যশোরে বিশাল কাওরাপাড়া আছে। কিন্তু আমাদের সংবাদপত্রে তাঁরা নেই। আমাদের সংগীতে তাঁরা নেই। পার্লামেন্টে তাঁরা নেই। প্রশাসনিক স্বীকৃতিতেও নেই। তাঁদের কোনো সাহিত্য আছে—জানেন না আমাদের সাহিত্য সম্পাদকেরা। রাগী ভাষায় এসব ‘নেই’-এর উত্তর দেওয়ার মতো কোনো মনোরঞ্জন ব্যাপারীও নেই।

ভারতীয় মনোরঞ্জন ব্যাপারীর মতো দলিত কথাশিল্পী না থাকলেও বাংলাদেশে যাঁদের আমরা দলিত বলছি না, কিন্তু ‘অনগ্রসর গোষ্ঠী’ বলতে চাইছি, তাঁদের জীবনের গল্পগুলোও অনুরূপ। চার বছর আগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এসব জনগোষ্ঠীর খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেছি করুণ চিত্র। মনে হয় না লিখলে কেউ বিশ্বাস করবে। ঢাকার নাজিরাবাজারে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কলোনিতে দেখেছিলাম ২০০ পরিবারের পানি সংগ্রহের জায়গা মাত্র এক-দুটি। ওয়ারী রবিদাস কলোনিতে ৫০০ মানুষের জন্য মাত্র ছয়টি চাপকল। এসব বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কেউ দোকান খুলে বসলে সেখানে ‘মূলধারা’র মানুষ কেনাকাটা করতে চায় না। এদের ‘অপবিত্র’ ভাবার রেওয়াজ পুরোপুরি যায়নি। এরূপ পরিবারের ৬৩ ভাগ শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। ১২ ভাগ ঝরে পড়ে স্কুলে ‘অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য’ শুনে। ডুমুরিয়ার উত্তম কুমার দাস বলছিলেন, ‘স্কুলে কেবল সহপাঠীরা নয়, শিক্ষকেরাও অবজ্ঞা করে আমাদের দাস-কোম্পানি বলত।’ জয়পুরহাটের পরিচিত আইনজীবী বাবুল রবিদাসের এই বেদনার কথা স্থানীয় অনেকেই জানেন—শহরের আইনজীবী ক্যানটিনে সবার ব্যবহারের গ্লাসে পানি খাওয়ায় তিনি ও তাঁর জাতের মানুষদের নতুন করে গ্লাস কিনে দিতে হয়েছিল।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ রকম সাক্ষাৎকার দেওয়া ৩৮ ভাগ মানুষ বলেছে, এখনো তাদের স্বপরিচয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে সমস্যা হয়। অনেক হোটেলে থাকে আলাদা কাপ-পিরিচ-থালা। ৭৯ ভাগ উত্তরদাতা বলেন, নির্বাচনের সময় ছাড়া তাঁদের কলোনিতে রাজনীতিবিদদের আগমন বিরল। নির্বাচন এলেও এই জনগোষ্ঠী কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে অংশ নিতে চায় না। কারণ, নির্বাচন শেষে কটূক্তি শুনতে হয়। বিজয়ী এবং পরাজিত ব্যক্তি—কেউই বিশ্বাস করেন না, এসব মানুষ তাঁদের ভোট দিয়েছেন। ফলে নির্বাচন মানেই অচ্ছুতদের দুর্ভাবনা।

তিন.

বাংলাদেশের সংবিধান ধর্ম, জাত ও বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে। মুন্সিগঞ্জের সৌদ খানও সেটা জানেন। তিনি লৌহজংয়ের খাড়িয়ায় বেদেপল্লিতে বসে নিজের গল্প শোনাতে গিয়ে বলেন, ‘ভালো হাডুডু খেলতাম, কিন্তু “বাইদ্যা” বলে স্থানীয় দলে আমার পজিশন হয়নি।’

হিন্দুসমাজের কাহিনি বলতে গিয়ে গোপালগঞ্জের বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিবিদ কার্তিক ঠাকুর বলছিলেন, ‘কোনো ঋষি সেনাপতি হলেও উচ্চবর্ণ তাঁকে মেয়ে বিয়ে দেবে না, তাঁকে ঋষি মেয়েই খুঁজে বের করতে হবে।’

শহর ছাড়িয়ে গ্রামের পথে ‘সমস্যা’র আঁচ মেলে বেশি। দেশে প্রায় ৮ লাখ কাওরা আছে। তারা ঐতিহ্যগতভাবে শূকর চরায়। এ কারণে কাওরাকে বর্ণহিন্দু এবং মুসলমান সবাই এড়িয়ে চলে। এই দূরত্ব তাকে হতদরিদ্রের গণ্ডি পেরোতে দিচ্ছে না। চা-শ্রমিকদের নেতা রামভজন কৈরী বরাবরই বলেন, ‘বাগিচা জনগোষ্ঠীর ১ শতাংশও কোনো সরকারি কাজের সুযোগ পায়নি।’ এই শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১০২ টাকা। লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে রাখার স্থায়ী এক ব্যবস্থা যেন।

বাংলাদেশের সংবিধান ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী’র জন্য নির্বাহী বিভাগকে অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু সরকার যাদের দলিত বলতে অস্বীকার করছে, এ রকম কোনো জনগোষ্ঠীর জাতিগত ও ভাষাগত পরিচয়ের যথাযথ স্বীকৃতি নেই। সেই স্বীকৃতির পথ ধরেই কেবল এগোতে পারত দারিদ্র্যবিরোধী উন্নয়নচেষ্টা। উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক অবস্থার বদল নয়, আত্মসম্মানের উপলব্ধিও। শেষেরটা বেশি জরুরি।

আইন কমিশন এসব জনগোষ্ঠীর বৈষম্য ও সম্মানহানি কমাতে যে খসড়া আইন করে (‘বৈষম্য বিলোপ আইন’) তাতে দেশে ‘দলিত’দের উপস্থিতির স্বীকৃতি ছিল। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলেও দেখছি, (পৃষ্ঠা ৫৮৩) ‘দলিত’দের বিস্তারিত স্বীকৃতি আছে। ‘তারা প্রবল সামাজিক বিরোধিতার করুণ শিকার’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৩০টির বেশি দলিত জনগোষ্ঠী আছেন, তাঁদের মোট সংখ্যা ৪৫ থেকে ৫৫ লাখ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান পরিকল্পনা দলিল এই ৪৫-৫৫ লাখ ‘মানুষ’কে বলছে ‘প্রায়শই হারিয়ে-যাওয়া গরিব’!

এই ‘হারিয়ে-যাওয়া গরিব’দের সামাজিক বঞ্চনা কমাতে আইন কমিশনের তৈরি খসড়া আইনটি ২০১৪ সালের এপ্রিলে আইন মন্ত্রণালয়ে পেশ হলেও তার কোনো যৌক্তিক পরিণতি হলো না। সংসদে উত্থাপিত হয়নি সেটি। ইতিমধ্যে সংসদের মেয়াদও প্রায় শেষ। যদিও মাননীয় আইনমন্ত্রী সুইজারল্যান্ডে জাতিসংঘের এক মানবাধিকার ফোরামে ২০১৭ সালের মার্চে বলে এসেছিলেন, তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে আইনটি সংসদ সদস্যদের কাছে পেশ হবে।

দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আগেই ওটা একটা ভালো যাত্রাবিন্দু হতে পারত। মনে হয় মনোরঞ্জন ব্যাপারীর মতো রাগী একদল বেপরোয়াকে না পেলে বাংলাদেশের ‘অচ্ছুত’দের অবস্থা পাল্টাবে না। কিন্তু ধলপুরের তেলেগুপাড়া কিংবা শ্রীমঙ্গলের বাগিচাগুলোতে তেমন মনোরঞ্জন ব্যাপারীদের জন্ম হবে কবে, যাঁরা বলবেন, ‘সাহস করে এগোতে হয়?’

Advertisement