ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে বাংলাদেশ ব্যাংক চার শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। গতকাল বুধবার দুর্নীতি দমন কমিশন বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে জব্দকৃত ব্যক্তিদের লেনদেনের তথ্য চেয়েছে।
দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। যাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সরকারদলীয় এমপি, রাজনীতিবিদ, আমলা, চাকরিজীবী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তি আছেন।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার ২৬ কোটি টাকা লেনদেনের কথোপকথনের রেকর্ড গোয়েন্দাদের হাতে রয়েছে। এই লেনদেনের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। কথোপকথনে তা বেরিয়ে এসেছে। বিষয়টির তদন্ত শেষে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা শীর্ষ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। স্বাচিপের একাধিক নেতার বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান চলছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ‘শুদ্ধি’ অভিযান শুরুর পর দুদক প্রথমে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর কথা জানালেও এই তালিকা দিনে দিনে বড়ো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২৩ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও আরো নিষেধাজ্ঞা আসছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া অভিযুক্তদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে দুদক। গত মাসে অভিযান শুরুর প্রথম দিনই রাজধানীর ফকিরেরপুলে ইয়ংমেনস ক্লাব থেকে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।
এরপর বিভিন্ন অভিযানে একে একে গ্রেপ্তার হন কথিত যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, বিসিবির পরিচালক ও মোহামেডান ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট, তার সহযোগী এনামুল হক ওরফে আরমান, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান ও তারেকুজ্জামান রাজীব।
জানা গেছে, চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত চার শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এসব হিসাবে এখন লেনদেন হচ্ছে না। এগমন্ট গ্রুপের মাধ্যমে তাদের সম্পদ সম্পর্কে বিভিন্ন দেশ থেকে তথ্য আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেসব দেশে টাকা পাচার হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান চলছে। এসব তথ্য সংগ্রহ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেওয়া হবে। এরপর তারা আরো বিশদ তদন্ত করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, ঘুষ-দুর্নীতির ঘটনায় সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব, ব্যাংকের লকার, শেয়ারে বিনিয়োগ, বিভিন্ন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ নামে-বেনামে থাকা সব ধরনের সম্পদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। নজরদারি করা সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এদিকে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, মানি লন্ডারিং হতে পারে এমন কোনো কর্মকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে বা সন্দেহ হলে ব্যাংকগুলো নিজ থেকে সতর্ক হতে পারে।
কারো নির্দেশ ছাড়াই তারা যে কোনো হিসাব নজরদারিতে আনতে পারে। ফলে চলমান অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম গণমাধ্যমে আসছে, তাদের ব্যাংক হিসাবের প্রতি নজর রাখছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নিজস্ব উদ্যোগে সংগ্রহ করা তথ্যগুলো বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করা হচ্ছে। এসব তথ্য ব্যাংকগুলোকেও দেওয়া হচ্ছে। ফলে সন্দেহভাজন ব্যাংক হিসাবগুলো নজরদারির আওতায় চলে আসছে।
সূত্র জানায়, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও বিশেষ নজরদারিতে রেখেছে। সম্প্রতি এক প্রভাবশালী সন্দেহভাজন ব্যক্তি তার হিসাব থেকে (বেসরকারি ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখা) টাকা তোলার জন্য অন্য ব্যক্তিকে ২৫ লাখ টাকার চেক দিলে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাকে জানানো হয়, ওপরের নির্দেশে এখন টাকা দেওয়া যাবে না। কিছুদিন পর আবার যোগাযোগ করতে বলা হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, হাসপাতাল ও স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসন স্বাচিপের দুই নেতা ও যুবলীগ-ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে জিম্মি। তারা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে আসছে। স্বাচিপের এক নেতার বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে তা ধরা পড়েছে। সম্প্রতি নার্সিং অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নার্সদের বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত সংগঠনের সঙ্গে তার একাধিক বৈঠক এবং সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার তথ্য গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
একইভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যেসব চিকিৎসক ঢাকায় আনা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশ বিএনপি-জামায়াত সমর্থক। নার্সিং অধিদপ্তরেও জামায়াত-বিএনপি সমর্থক এক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে নার্সদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। স্বাচিপের অপর নেতা চলমান দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের এক নেতার ছত্রছায়ায় থেকে স্বাস্থ্য সেক্টরে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে আসছেন। বিষয়টিও একাধিক সংস্থার তদন্তে প্রমাণ মিলেছে। স্থানীয় হাসপাতালের পরিচালকেরা প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিবিরোধী এই অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বলছেন, দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানোন্নয়নে বড়ো বাধা দুর্নীতি ও অনিয়ম।
অপরদিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দুই কর্মকর্তার একজন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃতি খুনি মেজর (বরখাস্ত) বজলুল হুদার আত্মীয়, অপরজন জামায়াত নেতার মেয়ের জামাই। ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্যাসিনোর সঙ্গে তারা জড়িত। বিদেশে টাকা পাচারের সঙ্গেও তারা জড়িত বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছে।