৪ সশস্ত্র সংগঠনের কাছে জিম্মি পাহাড়ি জনপদ

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: আজ ২ ডিসেম্বর। ২২ বছর আগে আজকের এই দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত থাকা সংগঠন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস-মূল) সঙ্গে সরকারের শান্তিচুক্তি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পাহাড়িদের সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ছেড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার কথা। অথচ চুক্তির ২২ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি ফেরেনি। উল্টো আরও তিনটি সশস্ত্র আঞ্চলিক দলের উত্থান ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে চার সংগঠনের কাছে পুরো পার্বত্য অঞ্চল জিম্মি হয়ে পড়েছে। পাহাড়ে বসবাসকারী শান্তিপ্রিয় মানুষকে জিম্মি করে চাঁদাবাজি, আধিপত্য এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সংগঠনগুলোর মধ্যে খুনোখুনি চলছেই। চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সর্বশেষ রোববার রাঙ্গামাটিতে গুলি করে হত্যা করা হয় জেএসএসের (মূল) আঞ্চলিক চিফ কালেক্টর বিক্রম চাকমাকে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন এবং পার্বত্য অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, পার্বত্য অঞ্চলে চারটি সশস্ত্র সংগঠন প্রতিবছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে। সরকারি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ঠিকাদারদের মূল বাজেটের ১০ শতাংশ হারে চাঁদা দিতে হয় তাদের। এ অর্থ দিয়েই সংগঠনগুলো সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা, লবিং এবং অস্ত্র সংগ্রহ করে থাকে।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২২ বছরপূতি উপলক্ষে রোববার রাজধানীর হোটেল সুন্দরবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে জেএসএস (মূল)। এতে সংগঠনটির প্রধান সন্তু লারমা লিখিত বক্তব্যে দাবি করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২২ বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকার চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্যান্য সংগঠন লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে। অন্যদিকে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, অস্ত্রধারী সাজিয়ে জেএসএসের (মূল) সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে একের পর এক সাজানো মামলা দেয়া হচ্ছে। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর চাঁদা আদায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (মনোনীত) কংজরী চৌধুরী বলেন, যার কাছে অবৈধ অস্ত্র থাকে তাকে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদার বিষয়ে কোনো ঠিকাদার আমাদের কাছে কখনও অভিযোগ করে না। এর মূলে রয়েছে অস্ত্র। অস্ত্রের ভয়ে কেউ অভিযোগ করে না। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।

চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার আহমার উজ্জামান বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ সব সময় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন আঞ্চলিক দলগুলো প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় করে না।

চিঠি দিয়ে চাঁদাবাজি : একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২২ বছর পূর্তি উপলক্ষে চলতি বছরের ৭ নভেম্বর জেএসএসের (মূল) প্রধান সন্তু লারমার পক্ষ থেকে সংগঠনটির প্রধান তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা দলের সব চিফ কালেক্টরকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে বিভিন্ন উৎস থেকে চাঁদা তোলার নির্দেশনা রয়েছে। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে শক্তি প্রয়োগ করতেও বলা হয়েছে। এই চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে রোববার রাঙ্গামাটিতে গুলি করে হত্যা করা হয় সংগঠনের চিফ কালেক্টর বিক্রম চাকমাকে। চিঠিটি যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে।

গোয়েন্দা সংস্থাটির এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, পার্বত্য অঞ্চলের চারটি সংগঠন জেএসএস (মূল), ইউপিডিএফ (মূল), জেএসএস (সংস্কার) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-কে চাঁদা না দিয়ে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায় না। সাধারণ নাগরিক, বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন বাগান, বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ঠিকাদারদের কাছ থেকে এই চার সংগঠন প্রায় ৪০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে। অস্ত্রের ভাণ্ডার সমৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে এসব অর্থ ব্যয় করে তারা। ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ি জেলা থেকে ১৪৫ কোটি, রাঙ্গামাটি থেকে ১৩০ কোটি এবং বান্দরবান থেকে ১২৫ কোটি টাকার চাঁদা আদায় করে সংগঠন চারটি।

চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়িত হয়েছে : গোয়েন্দা সংস্থাটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ৯টি ধারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জেএসএসের (মূল) প্রধান সন্তু লারমা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সেমিনারে পার্বত্য শান্তিচুক্তি নিয়ে সরকারবিরোধী বিভিন্ন মন্তব্য করেন। অথচ তার নেতৃত্বাধীন সংগঠন জেএসএসের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছে। তার সংগঠন অস্ত্র জমা না দিয়ে শান্তিচুক্তির প্রধান শর্ত ভঙ্গ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে যান সন্তু লারমা : হোটেল সুন্দরবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তর পর্বে সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান সন্তু লারমা। তিনি বলেন, এগুলো ব্যাখ্যা করতে সময় লাগবে। অন্য সময়ে ব্যক্তিগতভাবে আসেন, তখন বলব।

পাহাড়ে জনসংহতি সমিতি ছাড়াও যেসব আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে ওইসব সংগঠনের নেতাকর্মীদের রাজাকারদের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। তিনি বলেন, শুধু পাহাড়িদের কথা বলছেন কেন। মুক্তিযুদ্ধে যেমন বিরোধিতাকারী ছিল, পাহাড়েও এমন বিরোধিতাকারী রয়েছে। পাহাড়ে অস্ত্রবাজি, খুন ও হানাহানি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি বিশেষ মহলের ইন্ধনে অন্য পাহাড়ি সংগঠনগুলো এসব করছে। জনসংহতি সমিতি এসবের সঙ্গে জড়িত নয়।

জাতীয় পরিচয়পত্র কেন তিনি নেননি বা নিচ্ছেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে হবে, আইনে এমন বাধ্যবাধকতা আছে কি না। এমন তো বাধ্যবাধকতা নেই।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, শান্তি চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন ছাড়া পার্বত্য সমস্যা সমাধানের বিকল্প নেই। জনসংহতি সমিতির তথা জুম্ম জনগোষ্ঠীর মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাদের পেছনে যাওয়ার আর কোনো পথ নেই। জুম্ম জনগণ ২২ বছর চুক্তি বাস্তবায়নের অপেক্ষা করেছে। তারা সরকারকে অনেক সময় দিয়েছে। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ড. মেসবাহ কামাল, ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক উ উইন মং জলি প্রমুখ।

শান্তিচুক্তির বর্ষপূর্তিতে নানা কর্মসূচি : রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি জানান, পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২২ বছর পূর্তি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে রাজধানী ঢাকা ও তিন পার্বত্য জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সরকার বদ্ধপরিকর। শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, আশা করি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে এ অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা জাতির পিতার সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।

রাঙ্গামাটিতে জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে আজ সকালে শোভাযাত্রা ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এ কর্মসূচি পালন করা হবে উপজেলাগুলোয়ও। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও রাঙ্গামাটি রিজিয়নের যৌথ উদ্যোগে সন্ধ্যায় রাঙ্গামাটি চিংহ্লামং মারি স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয়েছে সম্প্রীতির কনসার্ট। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন পৃথক কর্মসূচি পালন করবে। আলোচনা সভার আয়োজন করেছে জেলা আওয়ামী লীগ।

Advertisement