অন্ধকারে বসবাস !!

ফারজানা ইসলাম লিনু

দুঃখ,কষ্ট, গ্লানি ও বিষাদে ছেয়ে গিয়েছে পুরো বিশ্বের আকাশ। উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা পৈশাচিকতার যুগান্তকারী রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে একে একে। প্রতিটা ঘটনায় ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে স্বীকৃত ঢাল হিসেবে।

ক্রাইস্ট চার্চে রক্তক্ষয়ী হামলার দগদগে ক্ষত ভুলতে না ভুলতে শ্রীলঙ্কার তিনটি গীর্জা ও বিলাসবহুল হোটেলে আত্মঘাতী হামলায় মারা যায় সাড়ে তিন শতাধিক মানুষ। অর্ধশতকেরও বেশি মানুষ হাত পা হারিয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে অবিরাম।

যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষ ও স্বজনহারাদের হাহাকারে কেবল শ্রীলঙ্কা নয় পুরো বিশ্ব শোকাহত। লাশের পঁচা গন্ধে ভারী পৃথিবী নামক গ্রহের বাতাস।

না কোন হিংস্র দানব মাংসাশী পশু নয়, বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন রক্তমাংসের মানব সন্তানের হাতে মারা পড়েছে এতগুলো নির্দোষ মানুষ।

খবরে প্রকাশ আত্মঘাতী হামলাকারীদের সবাই উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সদস্য। দীর্ঘ পরিকল্পনা ও অত্যধুনিক প্রশিক্ষণ শেষে অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে হামলা চালিয়েছে ঘাতকেরা।

মানুষের মানবতা মনুষ্যত্ব আজ প্রশ্নবিদ্ধ। মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে মানব হওয়ার জন্য, দানব হওয়ার জন্যতো নয়।

“অমরত্বের প্রত্যাশায়” আমি কিছু লিখতে পারিনা, পূর্ণদৈর্ঘ্য জীবনের স্বল্পদৈর্ঘ্য রোজনামচায় কলম চলেনা। কষ্টের অনুভূতি গলার নীচে দলা পাকিয়ে আটকে থাকে। অব্যক্ত বেদনায় নীল আমি প্রতিবাদের ভাষা পাইনা। ইয়াজিদি মেয়ে নাদিয়া মুরাদের “দ্যা লাস্ট গার্ল” বই পড়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলি।

শ্রীলঙ্কায় হামলার তিন দিনের মাথায় হামলার দায় শিকার করে বিবৃতি দিয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। দায় স্বীকার সম্বলিত ভিডিও ক্লিপটি দেখে ক্ষোভ, ঘৃণা আটকে রাখতে পারিনা। নাদিয়া মুরাদের “দ্যা লাস্ট গার্ল” পড়তে ভালো লাগেনা। অর্ধ সমাপ্ত বইটা বন্ধ করে দূরে সরিয়ে রাখি দুইদিনের জন্য।

মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনা। নিরুপায় মানব সন্তানের নাদিয়া মুরাদদের মানবেতর কষ্টে সমব্যথী হওয়া কিছু করার থাকেনা। এক নিঃশ্বাসে “দ্যা লাস্ট গার্ল” বইয়ের বাকিটুকু পড়তে গিয়ে সামনে চলে আসে আইএসের না জানা কত কীর্তি কাহিনী।

চৌদ্দশো বছর আগে আইয়ামে জাহিলিয়ার অন্ধকার যুগে আলোর মশাল হাতে হজরত মোহাম্মদ (সঃ) এক শান্তির ধর্মের প্রদীপ জ্বালিয়ে ছিলেন। অত্যাচারীত, নিপীড়িত মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে এসে জড় হয় শান্তির আশায়। সেই শান্তির ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অধর্মের কাজ চলছে আইএস নামক নিষিদ্ধঘোষিত এক ধর্মীয় গোষ্ঠীর হাতে।

বিশ্ব রাজনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও মধ্যপ্রাচ্যের তেলের দখল নিতে একে একে গড়ে তোলা হয় আইএসের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন।
খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর পথ হারা আইএসের হাতে মারা যায় হাজার হাজার সংখ্যালঘু ইয়াজিদি পুরুষ। মেয়েশিশু ও নারীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আইএস ক্যাম্পে। প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের সাথে জোরপূর্বক যৌনদাসীত্ব গ্রহণে বাধ্য করা হয় নয় বছরের শিশুকেও।

বন্দি হওয়া ইয়াজিদি নারী ও মেয়ে শিশুদের সাথে নাদিয়া মুরাদের জায়গা হয় আইএসের ক্যাম্পে। অসম্ভব সাহসী সেই মেয়েকে যৌন দাসীত্ব মেনে নিতে হয় অনিচ্ছায়।

নিজের চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করেছে ভয়াবহ সব ঘটনা। পুরো গ্রামবাসীর সাথে নিজের ছয় ভাইয়ের নির্মম মৃত্যুতে ভেঙে না পড়ে বেঁচে থাকার প্রত্যয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ায়।

বিভীষিকাময় আইএসের কারাগার থেকে পালাতে গিয়ে দুঃসাহসী মেয়েটা আবার ধৃত হয়। শাস্তিস্বরূপ নাদিয়ার কপালে জুটে গনধর্ষনের মত অমানবিক নোংরা শাস্তি। অবধারিত ভাগ্যকে মেনে না নিয়ে আবারও পালাবার পথ খোঁজে সে।

ইরাকের মসুল অঞ্চলের অধিবাসীরা কেউ পুরষ্কারের আশায়, কেউবা আইএসের ভয়াবহ প্রতিশোধের ভয়ে ইয়াজিদিদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনা।

এই প্রতিকূল পরিবেশে আইএস নরপশুদের হাতে নিগৃহীত নাদিয়া মুরাদ এক মুসলমান পরিবারের সহায়তায় আইএস অধিকৃত মসুল অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। প্রাণে বেঁচে কুর্দিস্তান হয়ে নাদিয়াও চলে আসে জার্মানী।

আইএসের কাছে বিক্রি হওয়া হাজারো নারীর লাঞ্চনা নাদিয়াকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করলেও উঠে দাড়ানোর প্রেরণা নষ্ট করতে পারেনা।
বন্দি জীবনের বিভীষিকাময় স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে নিজের আত্মজৈবনিক বই “দ্যা লাস্ট গার্ল” লিখে নির্যাতিতা নারীদের কষ্ট জনসমক্ষে নিয়ে আসে নাদিয়া।

নাদিয়ার জবানবন্দিতে লিখা বই বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয় প্রতিবাদি কণ্ঠস্বর হিসেবে।
২০১৮ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করে নাদিয়ার প্রতি অন্যায়ের দাঁতভাঙা জবাব দেয় নোবেল কমিটি।

নাদিয়াকে সহায়তার অপরাধে মসুলের সেই মুসলিম পরিবারকে সহ্য করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট। আইএসের চিরুনী অভিযানের কারণে পরিবারের কর্তা পূরুষ ওমর আব্দুল জব্বার প্রাণে বাঁচতে তুরষ্ক হয়ে বুলগেরিয়া পালিয়ে যান। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বুলগেরিয়ার জেলে তাকে কাটাতে হয় দুর্বিষহ জীবন।

একসময় জেল থেকে মুক্তি পেলেও জার্মানীর এক নির্জন এপার্টমেন্টে কাটছে পরিবার বিচ্ছিন্ন ওমরের একাকি অনিশ্চিত দিন।
আইএস তার পিছু ছাড়েনি এখনো। সুদূর জার্মানীতেও তার ফোনে চলে যায় আইএসের পক্ষ থেকে মৃত্যু পরোয়ানা। অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে পরিবার বিচ্ছিন্ন এই লোকটি একাধিকবার আত্মহননের চেষ্টা পর্যন্ত চালায়।
মসুল আইএস মুক্ত হলেও ওমরের পরিবার পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত নয়। আইএস যোদ্ধারা পরাজিত হয়েছে কিন্তু নির্মূলতো হয়নি। যে কোন সময় যে কোন জায়গায় বিষের কামড় বসিয়ে আত্মশ্লাঘা বোধ করে তারা। বুক ফুলিয়ে রক্তক্ষয়ী হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিতে একটুও বাঁধেনা তাদের।

নাদিয়াকে সহায়তার কারণে ভাগ্যে জোটা অবর্ণনীয় কষ্টের জন্য ওমরের মনে কোন গ্লানি বা অপরাধ বোধ নেই। বরং নিগৃহীত সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের এক নারীকে বাঁচাতে পারাটাই তার জন্য বড় সান্ত্বনা।

সন্ত্রাসীর কোন ধর্ম নেই, দেশ নেই, পরিচয় নেই।

ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী লোমহর্ষক রীতিনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে ইন্টারনেটের বদৌলতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যায় আইএসের জাল। সারা বিশ্ব থেকে শিক্ষিত ও মেধাবীরা দলে দলে যোগ দেয় আইএসে।
জেহাদ নামক ধর্মযুদ্ধে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও পাড়ি জমায় সিরিয়ায়। স্বেচ্ছায় যৌন দাসীত্ব গ্রহণ করলেও সচক্ষে ধর্মের অপব্যাখ্যা ও অনাচার অবলোকন করে অনেকেই ফিরতে চায় স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু চাইলেই কি ফেরা যায়?

ফিরে আসার রুদ্ধ প্রায় সেই কপাট খুলতে না পেরে অনেকেই মারা যায় সিরিয়া ও ইরাকের আইএস নির্মুল অভিযানে। যারা বেঁচে আছে তাদের কাছে বেঁচে থাকা না থাকা দুটোই সমান।

ওমর আব্দুল জব্বাররা এখনো এই গ্রহের বুকে আছেন নাদিয়াদের সাহায্য করার জন্য। আর নাদিয়ারা অত্যাচারের তীব্রতায় মুখ বুঝে সব অন্যায় সহ্য না করে অত্যাচারিতের কথা বলেন দেখেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠে।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওমর, নাদিয়াদের জয় হউক আর পথভ্রষ্ট, পাপিদের হেদায়েত হউক। সকল ধর্ম ও ধর্মের মানুষ এই গ্রহে শান্তিতে থাকুক এই প্রত্যাশা।

(ফারজানা ইসলাম লিনু, শিক্ষক ও গল্পকার)

Advertisement