আইন ভাঙায় আনন্দ পাই, মানায় পাই না কেন?

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: রাত ১০টা। কলকাতার পার্ক স্ট্রিট থেকে যোধপুর পার্ক যাচ্ছি। সঙ্গে এক বন্ধু। ট্যাক্সি চলছে বেশ জোরে। রাস্তা ফাঁকা। কলকাতা ঝলমল করছে। আচমকা ট্যাক্সিওয়ালা ব্রেক কষলেন। দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। বললাম, ‘কী হলো, থামালেন কেন দাদা?’ তিনি বললেন, ‘দেখছেন না। সিগন্যাল বাতি জ্বলছে। সবুজ বাতি জ্বললে যাব।’ খটকা লাগল। রাস্তা পুরো ফাঁকা। আমাদের গাড়ি ছাড়া আশপাশে কোনো গাড়ি নেই। তবু সিগন্যাল বাতি দেখে গাড়ি থামল। এসব তো পশ্চিমা দেশের কায়দাকানুন। কলকাতায় এই জিনিস কেন? বললাম, ‘আশপাশে তো গাড়িঘোড়া কিছু নেই। কোনো ট্রাফিক পুলিশ বা সার্জেন্টও তো নেই। আমরা বসে থাকছি কেন?’

ট্যাক্সি ঠিক করার সময়ই ভদ্রলোক আমাদের কথাবার্তা শুনে বুঝেছিলেন আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। বললেন, ‘আপনাদের ঢাকায় সিগন্যাল বাতি নেই?’ বললাম, ‘আছে তো! আপনাদের এখানকার চেয়ে বেশি আছে।’ উনি বললেন, ‘আপনারা বাতি মানেন না?’ বললাম, ‘তেমন একটা মানি না।’ উনি বললেন, ‘না মানলে বাতি লাগিয়েছেন কেন আপনারা?’ বললাম, ‘ধরুন আপনি মানলেন না। আপনি চালিয়ে গেলেন। আপনার কী সাজা হবে?’ জবাবে উনি জানালেন, তিনি সিগন্যাল অমান্য করামাত্রই সিসিটিভি ক্যামেরা তাঁকে শনাক্ত করবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হবে। পরদিন আদালতে গিয়ে আইনভঙ্গের কারণ ব্যাখ্যা করে জরিমানা দিয়ে আসতে হবে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে তিন–চার ঘণ্টা চলে যাবে। হাড়ভাঙা রোজগারের টাকা থেকে জরিমানার টাকা তো দিতেই হবে, সঙ্গে পুরো এক বেলা কাজ করতে না পারার ক্ষতি। সবচেয়ে যে দামি কথা তিনি বললেন সেটি হলো, ‘ট্রাফিক পুলিশ থাকুক আর না-ই থাকুক, আমি আইন ভাঙব কেন? আমি আইন ভাঙলে আরও লোকে আইন ভাঙবে। বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। আমার শহরে আমি বিশৃঙ্খলা বাধতে দেব কেন?’

খেয়াল করলাম, ভদ্রলোক বারবার ‘আমার শহর’, ‘আমার শহর’ বলছেন। তার মানে তিনি শহরটাকে আপন মনে করেন। শহরটাকে তিনি ভালোবাসেন।

মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঢাকার রাস্তায় আমরা কীভাবে চলি আর ওরা কীভাবে চলে। ওদের হাতে কি আমাদের চেয়ে বেশি টাকাপয়সা? ওদের মতো সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো এবং একই ধরনের সফটওয়্যার বসানোর মুরোদ কি আমাদের নেই? চোখ বন্ধ করে বলতে পারি, সে ধরনের আর্থিক সামর্থ্য ওদের চেয়ে আমাদের বেশিই হবে, কম হবে না।

‘রেতে মশা দিনে মাছি, এই তাড়ায়ে কোলকাতায় আছি’—ঈশ্বর গুপ্তের এই লাইন থেকেই বোঝা যায় একসময় কলকাতা কত নোংরা শহর ছিল। এখন সেখান থেকে তারা অনেক ওপরে উঠে এসেছে। ঢাকার তুলনায় অনেক পরিচ্ছন্ন ও গোছানো শহর হয়ে উঠেছে কলকাতা। প্রচুর মানুষ আছে, প্রচুর গাড়ি আছে। যানজট নেই। ভিড় আছে। কিন্তু হুড়োহুড়ি নেই। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? ওরা ট্রাফিক আইন মানছে। আমরা মানছি না। ওরা শৃঙ্খলা মেনে চলাচল করছে, আমরা করতে পারছি না। কেন? জবাব সোজা। ওরা শহরটাকে নিজের বলে মনে করতে পারছে। আপন মনে করতে পারছে। শহরের মালিকানার অংশীদার মনে করতে পারছে। কিন্তু আমরা পারছি না। কেন পারছি না? এটার জবাবও সোজা। শহরটাকে আপন মনে করে এবং এর মালিকানার ভাগীদার মনে করে আমরা ট্যাক্স দিই। এর বিনিময়ে শহর যাঁরা চালান, তাঁদের কাছে আমরা প্রাপ্য কিছু সুবিধা চাই। কিন্তু তা পাই না। এই না পাওয়া এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে এ নিয়ে খেদ প্রকাশ করাও আমরা ছেড়ে দিয়েছি। এটিকে আমরা নিয়তি বলে ধরে নিয়েছি। ফলে এই শহরকে নিজের শহর ভাবতে আমাদের কষ্ট হয়। বছর শেষে আয়কর অফিস গুনে গুনে করের টাকা নেয়। কিন্তু কোনো কর্তৃপক্ষ সেবা দেয় না। মাস শেষে পানির বিল ঠিকমতো দেওয়ার পরও দেখা যায়, দুর্গন্ধযুক্ত পানি পড়ছে ট্যাপ থেকে। কখন পরিষ্কার পানি আসবে, তা কর্মকর্তাদের মর্জির ওপর ঝুলে থাকে। দিনের পর দিন এভাবে চলতে থাকে।

আমরা দেখি, অনেক সচিব থেকে শুরু করে জাতির বিবেকখ্যাত অনেক সাংবাদিক এবং গুরুত্বপূর্ণ লোক প্রতিনিয়ত উল্টো পথে গাড়ি চালিয়ে আসেন এবং তাঁদের পথ আটকালে তাঁরা বিরাট গোসসা হন। তাঁদের একটা টেলিফোনে কী কী হতে পারে, তা তাঁরা ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে কোনো রকম লজ্জাশরম না করে বিশদে বলে ফেলেন। আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম, আইন ভেঙে এক ব্যক্তি ভুল জায়গায় গাড়ি পার্ক করেছেন। সেই গাড়ি সরিয়ে নিতে বলায় পুলিশ কর্মকর্তাকে তিনি ‘দুই টাকার চাকর’ সাব্যস্ত করে খুব বকা দিলেন। তিনি পুলিশকে আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে জানিয়ে দিলেন, তিনি বিরাট ঘরের সন্তান। তাঁর বাবা একজন এমপি। তাঁর মতো ডজন ডজন পুলিশ অফিসার তিনি উল্টো পকেটে গুঁজে রাখেন। সুতরাং তাঁকে গাড়ি সরিয়ে রাখতে বলার মতো বেয়াদবি করার এখতিয়ার পুলিশ কর্মকর্তার নেই। আমরা দেখি, পরিচ্ছন্ন নগরের পক্ষে আয়োজিত সভা–সেমিনারে বক্তৃতা দেওয়া লোক কলা খেয়ে খোসাটা অবলীলায় রাস্তায় ফেলে দেন।

আমরা দেখি, যে রাস্তা দিয়ে ভ্যান, রিকশা চালানো নিষেধ, সেখানে ট্রাফিক পুলিশের হাতে আলগোছে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে রিকশা নিয়ে সহজেই ঢুকে পড়া যায়।

এই অবস্থা যখন দিনের পর দিন চলতে থাকে, তখন নগরবাসীর এই শহরকে নিজের শহর মনে করা কষ্টকর হয়ে যায়। সাধারণ নগরবাসীর প্রায় সবাই যখন ভাবতে শুরু করে এই শহর তার নয়, এই শহরে সে আগন্তুকমাত্র; তখন এই নগরের ভালো–মন্দ নিয়ে তার মাথা ঘামাতে ইচ্ছা হয় না। আইনকানুন ভাঙলে যেহেতু সাজা পাওয়ার ভয় কম, সেহেতু আইনকানুন নিয়েও আমাদের মাথাব্যথা নেই।

অদ্ভুত বিষয় হলো, এই আমরাই যখন ইউরোপ–আমেরিকা কিংবা অন্য কোনো উন্নত দেশে যাই, তখন কী সুন্দর আইন মেনে চলি। সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়াই। যেখানে–সেখানে থুতু ফেলার কথা তো ভাবতেই পারি না। দেশের মাটিতে ফেরার পরই মনে হতে থাকে, উল্টো পথে না গেলে পাবলিক প্রভাব–প্রতিপত্তির কথা টের পাবে না।

ফুটপাতে পথচারীদের হাঁটাচলা করার কথা, কিন্তু সেখানে মোটরসাইকেল শুধু উঠছেই না, পথচারীদের ফুটপাত থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য মোটরসাইকেল আরোহী সমানে হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। আমরাও সসম্মানে পথ ছেড়ে দিচ্ছি।

আমাদের এই ঢাকায় যে মিছিল বা যে সমাবেশ যত বেশি জনজীবন অচল করতে পারে, সেই মিছিল বা সমাবেশ তত বেশি স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। আমরা একজন আরেকজনের এসব কাজকর্ম দেখে উদ্দীপ্ত হই। ইচ্ছে হলেই আইন ভাঙি। আইন ভাঙার মধ্যে যে পৈশাচিক আনন্দ আছে, তা আমরা জানি। কিন্তু আইন মানার মধ্যে যে ঐশ্বরিক তৃপ্তি আছে, তা জানি না। কবে জানব কে জানে!

Advertisement