আবু সাফা পরাজিত, গাজীপুরে সুরুজের অবাক বিজয়

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ৬ মে গাজীপুরের সিটি নির্বাচন স্থগিত শুনেই কেন জানি আবু সাফাকে মনে পড়ল। আবু সাফাকে আপনারা কি ভুলে গেছেন? প্রধানমন্ত্রীর পদ তখন বর্তমানের কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়া অলংকৃত করে আছেন। তিনি কিংবা তাঁর মিত্ররা চাননি যে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে গিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ফৌজদারি অপরাধের পূর্ববৃত্তান্তের মতো আটটি তথ্য প্রকাশ করা হোক। কিন্তু আদালত তো রায় দিয়ে ফেলেছেন যে প্রার্থীদের আটটি তথ্য দিতে হবে। তাই নেপথ্যের কুশীলবেরা কলকাঠি নাড়লেন, তাঁদের আবিষ্কার হলেন আবু সাফা। বউ-ছেলে-মেয়ে ফেলে বহুদিন নিরুদ্দেশ ছিলেন তিনি। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে তাঁকে কখনো দেখেছে—এমন লোক আমি পাইনি। কিন্তু তথ্য প্রকাশের বিপক্ষে ‘জনস্বার্থে’ দায়ের করা তাঁর লিভ টু আপিল তেলেসমাতি ঘটিয়ে ফেলল। কতশত লিভ টু আপিল পড়ে থাকে, কিন্তু এই সংসারবিবাগি ভবঘুরের দায়ের করা লিভ টু আপিলের মাহাত্ম্য ছিল অবাক করা।

হাওয়া ভবন তখন এক বিশেষ অনুভূতির নাম। হাওয়া-অনুভূতিতে আঘাত দিলে তখন বিরাট শাস্তি। দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আলবত ছিল। কিন্তু অলিখিত সেন্সরশিপের কারণে ওই অনুভূতি সুরক্ষায় আমরা ‘আত্মসচেতন’ জাতি হয়ে উঠছিলাম। হাইকোর্টের রায়ে সংক্ষুব্ধ ছিল বিএনপি।

সেই দিনের কথা কখনো ভুলব না। আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেছেন যে হাইকোর্টের রায় যাতে আটটি তথ্য প্রকাশ করার নির্দেশ ছিল, সেটা বাতিল করা হলো। খবর রটল, আবু সাফাই টিকে গেলেন। কিন্তু একজন ড. কামাল হোসেন আপিল বিভাগে ঠায় বসে থাকলেন। মাননীয় বিচারকগণ এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেছেন। বিরতিতে সবাই চলে গেছেন। ঘোষণা না দিয়ে অনশনে গেলেন কামাল হোসেন। আর অবাক বিষয়, তাতে কাজ হলো। হাকিম নড়ল না, হুকুম নড়ল। হাইকোর্টের রায় সমুন্নত হলো। আপিল বিভাগ তাঁদের আদেশ রিকল করলেন। এভাবেই আমরা আটটি তথ্য জানার অধিকার ছিনিয়ে আনতে পারলাম। আবু সাফার পরাজয় হলো।

আবু সাফাকে কারা নামিয়েছিল, তা জানতে আবু সাফার সন্ধান পেতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সফল হইনি। এবারে অবশ্য গাজীপুরের রিট আবেদনকারী আজহারুল ইসলাম সুরুজের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি।

রিট আবেদনকারী সম্পর্কে আমাদের উচ্চ আদালতের রায় আছে, আদালতের সামনে তাঁর হাতে ক্লিন হ্যান্ডে বা পরিচ্ছন্ন হাতে আসতে হবে। কিন্তু গাজীপুরের মেয়র নির্বাচন যাঁর রিটের কারণে আটকে গেল, সেই আজহারুল ইসলাম সুরুজ পরিচ্ছন্ন হাতে আসেননি। পারিবারিক ঐতিহ্যগতভাবে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হলেও দুটি উচ্চ পর্যায়ের সরকারি তদন্ত কমিটি দালিলিকভাবে প্রমাণ করেছে, তিনি হাইকোর্টে হলফ করে মিথ্যা বলেছিলেন। তিনি গাজীপুরের যে ছয়টি মৌজা সাভারের বলে দাবি করে ২০১৫ সালে রিট করেছিলেন, তার একটিতে নিজের ঠিকানা ডোমনাগ উল্লেখ করেছিলেন। ডোমনাগ গাজীপুরের ছয়টি মৌজার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু ২০১৭ সালের অক্টোবরের তদন্ত প্রতিবেদন বলেছে, তাঁর বাড়ি ডোমনাগে নয়।

গত রোববার রাতে তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে দুই দফা আলোচনায় তাঁর কথাবার্তা কিছুটা স্ববিরোধী মনে হয়েছে। যেমন তিনি বলেছেন, ডোমনাগসহ ছয়টি মৌজাবাসীর নাম কখনো গাজীপুরের ভোটার তালিকায় যায়নি। অথচ ১৯৭৮ সালের পরে কখনোই ডোমনাগের তালিকা সাভারভুক্ত হয়নি।

৬০ ছুঁই ছুঁই সুরুজের প্রয়াত পিতা আওয়ামী লীগ করতেন। তিনি যথার্থ গর্বের সঙ্গে স্মরণ করেছেন যে বীরাঙ্গনাদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে তাঁর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। তাঁরা কয়েক বিঘা জমি দিয়েছিলেন। সেই জমিতেই পরে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

২০১১ সালের পরে ২০১৬ সালে তিনি নৌকা প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ রকম পূর্ববৃত্তান্তের একজন মানুষের ছয়টি মৌজা কেটে তাঁর চাহিদামতো নিজের শিমুলিয়া ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস বিফলে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার তাঁকে নাকচ করেছিল। কারণ, প্রশ্নটা সন্দেহাতীতভাবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিষয়। অনেক সময় জ্যারিমেন্ডারিং (কৌশলগত নির্বাচনী রাজনৈতিক বিবেচনায় সীমানা নির্ধারণ করা) বিরাট আইনি প্রশ্ন তৈরি করে বৈকি। সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে আমাদের রাজনীতি মশহুর। কিন্তু সুরুজের বিষয়টি তা নয়। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের কোনো প্রার্থী অন্তত প্রকাশ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হননি। তিনি নিজেও গাজীপুরে যেতে চান না। ২০১৬ সালে নির্বাচিত হয়েছেন। পরের নির্বাচন আসবে ২০২১ সালে। সুতরাং দ্রুত সিদ্ধান্ত পাওয়ার মতো জরুরি কোনো স্বার্থ তাঁর ছিল না। তা ছাড়া ছয় মৌজার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে।

তবে গাজীপুরের ডিসির কাছ থেকে যখন জানলাম যে ওই ছয়টি মৌজার উল্লেখযোগ্য লোকজন যাতায়াত এবং রাষ্ট্রীয় ত্রাণ বা সুযোগ-সুবিধা নিতে সাভারমুখী হওয়ার প্রবণতা দেখিয়ে থাকে। এ কারণে জনসেবক হিসেবে তিনি ছয় মৌজার ভোটাধিকার সাভারে আনতে চান, তাতে যুক্তি থাকতে পারে।

জনাব সুরুজ অকপটে স্বীকার করেন, গাজীপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হোক, সেটা তাঁর চাওয়া ছিল না। যদিও রিট আবেদনে তিনি নির্বাচন স্থগিত চেয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘দরখাস্তে কোথায় কী যে আইনি লেখা হয়েছে’! তাঁর সন্তোষ হলো, এই বিষয় নিয়ে কত দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, এত দিন কেউ তাঁকে পাত্তা দেয়নি। একাধিক আইনজীবী, ব্যারিস্টার নিয়োগ দিয়েছেন, একাধিক রিট করেছেন। এতকাল কোনো কাজ হলো না। এবার তাঁর খুশির সীমা নেই।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সাভার ও গাজীপুরের প্রশাসন ওই রিট আবেদনকারীর তোলা প্রশ্ন সুরাহা করতে সব রকম প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়েছিল। এমনকি সাভার ও গাজীপুরের জেলা ও সদর থানা প্রশাসনকে দিয়ে গণশুনানি করেও এর নিষ্পত্তি করা হয়। সেই শুনানিতে সাভার ও গাজীপুরের ইউএনও অংশ নিয়েছিলেন। এমনকি তফসিল ঘোষণার এক মাস আগেও স্থানীয় সরকার বিভাগ আদালতে রিটের বিষয় খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হয়েছিল। ডিসি আমাদের বলেন, হাইকোর্টের কোনো আদেশ ছিল না। বরং রিটকারী তাঁর দরখাস্ত ‘নট প্রেস’ করেছিলেন।

সুতরাং এটা পরিষ্কার যে ভোট বন্ধ করে সুরুজের দাবি মানা বা না-মানার মধ্যে জনগুরুত্বসম্পন্ন কোনো ব্যাপার ছিল না। সুরুজ তাঁর ২০১৫ সালের রিটের পরিশিষ্টে সাভারের ভূমি রাজস্ব দপ্তরের একটি ‘প্রতিবেদন’ যুক্ত করেছেন। তদন্ত কমিটি দেখেছে, এটি কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করে তৈরি করা। তিনি রিটে নিজেকে ডোমনাগ মৌজার অধিবাসী দাবি করাকে কমিটির পক্ষ থেকে মিথ্যা বলা বিষয়ে সুরুজ বলেন, কমিটির এই মন্তব্য মিথ্যা।

সুরুজ প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ২০১৫ সালে তাঁর দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর ফলাফল জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাঁর কথায়, ‘এসব তদন্ত বিষয়ে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। আমার ইউনিয়নের ছয় মৌজা সাভারে রাখার দাবি নিয়ে প্রশাসনে যার কাছেই গিয়েছি, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।’ তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, আপনি নির্বাচন বন্ধ চান না, কিন্তু কী চান? সুরুজ বারবার বলেন, ‘আমার একটিই দাবি, দক্ষিণ বাড়ইবাড়ি, ডোমনা, শিবরামপুর, পশ্চিম পানিশাইল, দক্ষিণ পানিশাইল ও ডোমনাগ—এই ছয় মৌজা গাজীপুরের ভোটার তালিকায় নয়, সাভারে থাকুক।

এরপর তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব এ কে এম আফতার হোসেন প্রামাণিকের নাম শুনেছেন? তাঁর উত্তর: না। এরপর প্রশ্ন করা হলো, ২০১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর জনাব প্রামাণিকের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় তদন্ত কমিটি বলেছে, ওই ছয়টি মৌজার ভূমির নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ এবং সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কার্যক্রম গাজীপুরেই সম্পন্ন হয়। এসব তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে সুরুজ অকপট স্বীকারোক্তি করলেও তাঁকে কে বোঝাবে, এসব সত্য হলে তার কোনো আইনগত অবস্থান নেই বলেই প্রতীয়মান হয়। এখানে কোনো অবৈধতার প্রশ্ন নেই, প্রশ্ন থাকতে পারে দাবি পূরণের।

উল্লেখ্য, হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ প্রতিপালন করতেই ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর সরকার গঠিত প্রথম তদন্ত কমিটি ওই ছয় মৌজার ইতিহাস পর্যালোচনা করে। কমিটি বলেছে, ১৯৭৮ সালে ওই ছয়টি মৌজা সাভার থেকে সরিয়ে গাজীপুরের জয়দেবপুর প্রশাসনিক এলাকায় ন্যস্ত করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারই ওই ছয় মৌজাকে গাজীপুরের কাশিমপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত করেছিল। অথচ সুরুজ হলেন সাভারের ১ নম্বর শিমুলিয়া ইউপির চেয়ারম্যান। তাহলে তিনি যে বললেন, এর আগের নির্বাচনে ওই ছয় মৌজার ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ তাঁকে ভোট দিয়েছিলেন! এটা তো বিকারগ্রস্ততা মনে হয়। ১৯৭৮ সালে তাঁর বয়স যখন ১৮, তখন থেকে ওই ছয় মৌজার মানুষ কখনো সাভারের কাউকে ভোট দেননি।

২০১৩ সালে তৎকালীন টঙ্গী ও গাজীপুর নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন হয়। এরপর থেকেও যথারীতি এই ছয় মৌজার ভোটাররা গাজীপুরের ভোটার হিসেবেই সংসদ ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে চলছেন। উল্লিখিত তথ্য টেলিফোনে তাঁকে জানাতে চাইলে তিনি তা আগ্রহের সঙ্গে শোনেন। এরপর তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখি, এসব সত্য হলে আপনার দাবির আইনগত ভিত্তি কি থাকে? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি অতশত আইন বুঝি না। এটা হলো আমার দাবি। এই ছয়টি মৌজায় ৮ থেকে ১০ হাজার ভোটার আছে। এই এলাকার লোকজন যুগ যুগ ধরে রাষ্ট্রের তরফে যত ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা এসেছে, তা তারা সাভারের প্রশাসনিক পরিদপ্তর থেকেই পেয়ে আসছে। আর এখন ভোটের সুবিধাটাও তারা সাভারে পেলেই খুশি হবে। ভোটার হিসেবেও সাভারের সঙ্গে থাকলে তাদের বেশ সুবিধা হবে।’

এই হলো সংক্ষেপে আমাদের সুরুজ-কাহানি। আবু সাফা পরাজিত। সুরুজ বিজয়ী।

Advertisement