॥ ইমরান আহেমদ চৌধুরী ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর )
থমথমে পরিস্থিতি চলতে লাগলো – ১ মার্চ স্কুল এ আর ক্লাস হয় না । বিশাল বিশাল জাইয়ান্ট ধরনের সিনিয়র ছাত্ররা (এক জনের নাম মনে আছে আমান– টি, এ রোডের আমানিয়া হোটেলের মালিকের ছেলে) এসে সব ছোট ক্লাসের ছাত্রদের ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে যেত মিছিল, মিটিং এ যোগদান করার জন্য । জীবনেও এরকম স্বাধীনতা পাই নাই কখনও, জীবনেও কোনদিন ক্লাস ফাঁকি দেবার সাহস করি নাই এবং প্রয়োজনও মনে করি নাই । কিন্তু, সবচে’ বড় যে কাজটি করল এই মিছিল এবং মিটিংগুলো সেটা হোল আমার চোখ – কান খুলে গেল – কিভাবে ওরা আমাদেরকে নিগৃহীত করছে, কিভাবে ওরা আমাদের ন্যায্য দাবী আমদের বিজয়ী দল কে দিচ্ছে না, ওরা আমাদেরকে নির্মম ভাবে বৈশম্যের শিকার করছে । কিভাবে ওরা সামরিক জ্যান্তার রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে ১৯৫৮ সাল থেকে। বঞ্চিত করছে আমাদের সম্পদ থেকে আমাদেরকে । চলতে পারে না এই বৈষম্য আর । কেমন জানি রাজনৈতিকভাবে ঘটে গেলো এক নতুন জাগরণ আমার মধ্যে নিজের অজান্তে । দিনের পর আমি এবং আমার আরও কয়েক জন ক্লাস এর বন্ধুরা প্রতিদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কোর্ট পয়েন্ট মিলিত হতাম পরবর্তী প্রোগ্রামের জন্য । আমরা হলাম কয়েকজন মিছিল এর সম্মুখ এর গ্রুপ । তারপর নেতারা এবং তার পর মাইকের রিক্সা এর পর কাফেলা ; কোর্ট পয়েন্ট থেকে মিছিল বের হত অথবা ট্যাঙ্কের পাড় থেকে তারপর পুরা শহর প্রদক্ষিণ করতাম হেঁটে হেঁটে । বেশ উপভোগ করতাম, নিজেকে অনেক লম্বা বড় সড় ভাবতে শুরু করলাম।
দিন শেষে তিন আনা দিয়ে দুবরাজের মুরি ভাজি অথবা চানাচুর চিবুতে চিবুতে আমি আর আমার আহেমদি মুসলিম বন্ধু ফারুকি একটা রিকসা নিয়ে অথবা হেটে হেটে বাসায় ফিরতাম সন্ধ্যা হবার আগেই। বাসায় এসে সবাইকে বক্তৃতা দিয়ে দিয়ে বলতাম কি কি করলাম এবং কেন ওরা আমাদের দাবী মানছে না । কিভাবে ওদেরকে ভাষা আন্দোলন এবং ছয় দফা আন্দোলনের মত এবারও আমাদের দাবী মানাতে বাধ্য করাতে হবে । আম্মা বেশ অনুপ্রাণিত আমার বক্তৃতায় – আমি বাসায় এসে প্রায় সবার বক্তৃতাই হুবহু নকল করে ডেমো দিতাম আর বাসাশুদ্ধ সবাই কে হাসাতাম। এভাবেই আমার সম্পৃক্ততা হল আন্দোলনের সাথে । পরিস্থিতি ধীরে ধীরে কেমন যেন থম থমে হয়ে যেতে লাগলো । শহরে পাকিস্তান আর্মি নিয়াজ মোহাম্মদ ফুটবল এবং ওয়াপদা রেস্টহাউজ এলাকায় বিরাট এক ক্যাম্প করে ফেলল । শহরে আর্মির গাড়ি টহল দেওয়া শুরু করল ক্রমশ, এদিকে সংগ্রাম কমিটিও আস্তে আস্তে ফইটতলা বাদুঘর, পুইন্নট, এবং আসে পাশের গ্রামগুলোতে নেটওয়ার্ক করতে লাগলো গোপনে ; কুইছ, বল্লম, রামদা, তলওয়ার, ড্যাগার, গাঁদাবন্দুক, টুটূ বোর রাইফেল, একনালা বা দুনালা বন্দুক, এয়ার গান, তীর ধনুক নিয়ে আস্তে আস্তে তৈয়ার হতে শুরু করলো । মহল্লা, পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠতে থাকল সিভিল ডিফেন্স, আনসার, মুজাহিদ প্রশিক্ষণ, স্কুল, কলেজের ছাত্ররা আমাদের বড় ভাইয়েরা দলে দলে যোগদান করতে থাকল– নিজেকে কেমন যেন একটু ছোট ভাবতে লাগলাম ঐ দলে বয়েসের জন্য না ঢুকতে পেরে । থমথমে ভাব সাব দেখে একটু ভয়ও পেয়ে গেলাম মনেমনে । দুই দিন আর ভয়ে বের হলাম না, আম্মা বারণ করে দিল ।
সব বাড়িতে এবং বাসায় সবাই অস্ত্র পাতি নিয়ে তৈরি হতে লাগলো । বঙ্গবন্ধুর সেই জ্বালাময়ী ৭ ই মার্চের ভাষণ এর চর্চা চারিদিকে । সবার মুখে সেই একই কথা এর উপর আর কোন ভাষণ হতেই পারে না , উনিই আমাদের অবিসংবাদিত নেতা ; আমাদের পথ প্রদর্শক, শ্রেষ্ঠ মহামানব , যার প্রত্যেক কথা যেন আদেশ এবং শিরোধার্য । সে যে কি এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিকিরণকারি এক আদেশ তা ভাষায় প্রকাশের ভাষা আমার নাই, তদুপরি তখন আমি নিজেই ছিলাম ১০ বছর ১০ মাস বয়সী কত টুকুই বা বুঝি। তারপরও সবার মুখে শুনতে শুনতে এক সময় উপলব্ধি করতে লাগলাম কি যে এক অমোঘবানী ছিল সেই ভাষণে । গুটি গুটি পায়ে ক্রমান্বয়ে সময় ও তারিখ এসে হোঁচটখেয়ে মুখ তুবড়ে যেন পড়ে গেল – সেই ভয়াল সকল কালোরাতের চেয়েও কালো রাত …। ২৫ শে মার্চ …… ।
২৭শে মার্চ সকালে বের হয়ে পরলাম আবার – আমাদের প্রধান যাওয়ার জায়গা ছিল ট্যাংকের পার, কোর্ট পয়েন্ট, সাচ্চু ভাইয়ের বাসা, নয়ত আলী আজম সাহেবের বাসা ।সকালে ট্যাংকের পার যেয়ে সবার সাথে মিলিত হয়ে দলবল নিয়ে আসলাম মাতৃ সদন এলাকায় তিন রাস্তারলমোড়ে – তখন দেখলাম কয়েক শ লোক দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দুই পারে । আমারা ওখানেই দাঁড়িয়ে গেলাম । একটু পরেই আসা শুরু করল আঁক টা মিলিটারি কনভয় ( গাড়ির শোভা যাত্রা) । মানুষে লোকারণ্য কুমারসিংহ রোড আর ট্যাংকের পার – জেলখানা রোড আর সরাইল – কালিকচ্ছ রোড এ মানুষ ধরবার জায়গা নাই । সবাই আর্মির গাড়ি দেখতে দাঁড়িয়ে । সামনের জিপে বসে ছিল আঁক বইর সেনানী , ঠোটে একটা সিগারেট, ক্যাপটা চেগুভারার ক্যাপের মত, ছুলগুলো বেশ বড় বড় , গাড়ি থেকে নেমে সবাই কে হ্যাট নেড়ে অভিবাদন দিল – আর পাবলিক জয় বাংলা বলে গগন বিদারী আওয়াজে এলেকা প্রকম্পিত করে ফেলল । আম্মার কাছে শুনেছিলাম ট্রোজান যুদ্ধ বিজয়ী একেলিস এর কথা আর আজ দেখলাম সচক্ষে মনে হল, সোল্ডারে লেখা ইস বেঙ্গল লালচিন্দি উড় উপড়ে আর বাম হাতের বাহুতে এক হিংস্র রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন দেওয়া ব্যাজ । মনে মনে সে দিন প্রতিজ্ঞা করলাম বড় হলে আমি খালেদ মুসারাফ এর মত ইস্ট বেঙ্গলে অফিসার হিসেবে যোগদান করব । তার নাম এর জয়ধ্বনি পড়তে শুরু করলো ।
গাড়িগুলো এগিয়ে গেল টি এ রোড ধরে স্টেশন হয়ে আর্মি ক্যাম্পের দিকে আমরাও পিছু নিলাম ঐ কনভয়ের । ২৫ তারিখের খবর ঢাকা থেকে আস্তে আস্তে আসতে শুরু হল; ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঢাকা থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার মানুষ রিক্সা, ভ্যান, ট্রেন এবং লঞ্চ এ করে সব এক কাপড়ে ভেগে চলে এসেছে – অনেকের কাছ থেকে শুনলাম সেই বিভীষিকার সত্য গল্প । বাসার সবাই মনে মনে অপেক্ষা করল এই বুঝি আমদের বড় বোন মানু আপা এসে পরল বলে । কিন্তু কোথাও তার দেখা পাওয়া গেল না । ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কয়জন বালক বয়সী আমি, ফারুকী, নিপু, দুলাল ও প্রাণনাথ টি এ রোড ধরে রেল গেট দিয়ে নিয়ায মোহাম্মাদ স্কুলের দিকে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম অনেক বড় বড় মিছিল রেল লাইন ধরে ধেবে আসছে তাল শহর এর দিক থেকে ; হাতে উদ্যত বল্লম, রাম দা’ আর তীর ধনুক । আমারা ওদের দিকে অগ্রসর হয়ে রেল স্টেশন পার হতেই শুনলাম বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করেছে সকাল ১০ টার দিকে গগনবিদারী জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত পুরা এলাকা ; বাঙ্গালি সৈনিক রা আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে আমাদের সাথে । মুখে মুখে একই নাম মেজর সাফফাত জামিল বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাহিনী সব কয়টি পাঞ্জাবি দের কব্জা করে ফেলেছে এবং ওদের সবগুলোকে বন্দি করে ফেলেছে। এখন হাতে সময় কম তাড়াতাড়ি কুমিল্লা এবং ঢাকা থেকে রেল লাইন দিয়ে ট্রেনে এবং কুমিল্লা থেকে যাতে পাঞ্জাবিরা না আসতে পারে তাই সব রোড ও রেল লাইন রোড ব্লক দিয়ে ওদের আসা বন্ধ করতে হবে । (চলবে)