আর কত পোড়া লাশ!

ফারজানা ইসলাম লিনু

নিস্তব্ধ রাতের নিরবতা ভেদ করে পুরো শহর সেদিন কোলাহল মুখর। বিজয় দিবস পালনের আনন্দে ভাসছে দেশ। সময়টা ২০০৯ সালের বিজয় দিবসের সুচনালগ্ন। রাত বারোটা এক মিনিটে শহীদমিনারে পুষ্পস্তবক অর্পন করতে হবে, তাইতো পুত্র কন্যার বাবা ঘরে ফিরেননি তখনো।
সময়মতো ঘুমিয়ে পড়লেও মাঝপথে আমার ঘুমটা ভেঙে যায় হুট করে। ঘুম ভাঙার কারণ বের করার ব্যর্থ চেষ্টায় এ পাশ ওপাশ করি।
প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে ,গলা শুকিয়ে কাঠ। তীব্র অনিচ্ছায় উঠতে হয় আমাকে। ত্যাদড় ঘুম একবার ছুটলেই হয়েছে আর আসার নাম নেয় না। দেয়ালের ঘড়িটাতে তাকিয়ে দেখি রাত্রি প্রায় একটা।

বাথরুমে যাওয়ার আগে বাচ্চাদের রুমে উঁকি দেই একবার। ছানাপোনা তিনজন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। অন্য রুমে মা, ননদ মুক্তি , ভাগনি ফারিতা ও চৌদ্দ দিন বয়সী ভাগনে ফিদাকে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন।

ঘুম ভাঙলে বাচ্চারা ভয় পেতে পারে তাইতো ডাইনিং রুমে আলো জ্বলে সারারাত। জগ থেকে পানি ঢেলে এক নিঃশ্বাসে পান করি। এক গ্লাসেও তেষ্টা মেটেনা এই শীতের রাতে।

রুমে ফিরে টের পাই হালকা ঝাকুনিতে কাঁপছে পুরো বাসা। ভুমিকম্প নয়তো! ঝাঁকুনির সাথে ডাইনিং রুমের লাইট নিভে, জ্বলে। আলোর কম্পনে আমার চোখ কাঁপে, মাথা আরো বেশি ঘুরে।

কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়াতে আমার মাথা ঘুরছে মনে হয়। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠলে আমার এই রকম হয় কখনো কখনো।

পোড়া রাবারের উৎকট গন্ধটা নাকে লাগে। পাশেই ছিল গ্রুপ ফোরের অফিস। মাঝে মাঝে তারা মশা তাড়াতে টায়ার পোড়ায়। আজও মনে হয় টায়ার পোড়াচ্ছে।
পৌষে মাস সবে শুরু হয়েছে। কনকনে ঠান্ডার শুভাগমন হয়নি তখনো। তারপরও কেউ কেউ শুকনো পাতায় আগুন জ্বালিয়ে ওম নেয়।

পেছনের বাসার শাপলা পুকুরের তিন পাশে ঘন জঙ্গল। বাঁশঝাড়ও আছে একটা। বাঁশবনে প্রায় রাতেই হুতুম পেঁচা ডাকে। জোনাকিরা অমাবস্যার রাতে কিলবিল করে।
কয়েক ঘর ভাড়াটে আছে বাড়িটাতে। সকালে সবাই মিলে পুকুরে কাপড় কাঁচে, থালা বাসন মাজে। মাঝে মাঝে কলহ বাঁধায়। কলহ বিবাদের কিচিরমিচিরে কৌতুহল না থাকলেও পুকুরের সৌন্দর্য্য আমাকে টানে।

ছুটির সকালে মার রুমের জানালায় বসে আনমনে পুকুরটা দেখি। বাঁশবাগানের ছায়া ভেদ করে ভোরের সুর্য শাপলার গায়ে আলো ছড়ায়। নয়নাভিরাম এই দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো যায় না সহজে। আমি ফিরে যাই আমার ফেলে আসা দিনে। ভাবতে বড় ভালো লাগে ইট পাথরের শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে আমার ছেলেবেলা কেমন ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। কতদিন থাকে, কে জানে?

এই মধ্যেরাতে মাথা ঘুরা অনুভূতি এড়াতে রুমের জানালার গ্রিল ধরে পুকুরের পানে তাকাই। কিছুই দেখা যায় না। আজকে জোনাকি পোকা নেই একটাও।

মাঝারি বিশাল কোন বৃক্ষের ডালে বসে হুতুম পেঁচা থেমেথেমে ডাকছে আপনমনে। অলক্ষণে হুতুম পেচার ডাক নিয়ে আশৈশব কত কি শুনেছি।

এসবে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু আজ বড় ভয় লাগে। অজানা কোন আশংকা মনে ভর করে। এখনো পুত্রকন্যার বাবা যে ঘরে ফিরেননি।

সাত পাঁচ ভেবে আবার এক ঢোক পানি খেতে ডাইনিং টেবিলের পাশে দাড়িয়ে চারপাশে তাকাই। থমথমে পরিবেশে রুমের আলো যেন কেমন উঠানামা করছে। পানির গ্লাস হাতে একটু আন্দাজ করতে চাই ব্যাপারটা। নাহ কিছুই আঁচ করতে পারিনা। কিন্তু কি এক অস্বস্তিকর অস্বাভাবিকতা বিরাজ করছে।

প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বিছানার দিকে পা বাড়িয়েছি, অমনি ভয়ংকর এক বিকট শব্দে ইলেকট্রনিক সার্কিট ব্রেকারে আগুন ধরে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখের সামনে প্লাস্টিকের কাভার ফেটে আগুনের লেলিহান শিখা আমার পথ আটকে দেয়। আমার বাচ্চারা পাশের রুমে অবরুদ্ধ প্রায়। নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে প্রাণপণে চিৎকার দিয়ে মাকে ডাকি। ঘুমন্ত বাচ্চাদের টেনে হিচড়ে একজন একজন করে বের করে আনি। কাজের মেয়ে গুলোকেও টেনে নিয়ে আসি।

রাক্ষুসে আগুনের লেলিহান শিখা পেরিয়ে সবাইকে অক্ষত উদ্ধার করতে পারলেও চৌদ্দ দিন বয়সী আমার ভাগ্নে ফিদার কথা ভুলে যায় সবাই। নিমিষেই আগুন পুরো ডাইনিং রুম ছেয়ে ফেলে। সেই আগুন উপেক্ষা করে এক দৌড়ে মুক্তি তার ছেলে ফিদাকে নিয়ে আসে।

আগুনের স্ফুলিঙ্গ সমানে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়। ঘর থেকে বের হওয়ার পথটুকু প্রায় বন্ধ। আগুন জ্বলছে দাউদাউ। আমি পাগলের মত এদিক ওদিক দৌড়াই।

পাশের বাসার খালু ও তাসফিক এসে আগুন নেভানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তিন তলা থেকে চিৎকার দিয়ে দোতলার বাবুকে ডাকি।

বাবু মনে হয় বাসায় নেই, নয়তো ঘুমাচ্ছে। নিচের গেইটে তালা দেয়া। চাবিও নেই আমাদের কাছে। অবরুদ্ধ এই ভবনে মনে হয় আজ পুড়ে মরবো সবাই।

বন্ধ গেইটের ভেতর থেকে অসহায় আর্তনাদ আমাদের। কিছু প্রতিবেশি চিৎকার, চেঁচামেচি শুনেও নিরব, ভেবেছেন ডাকাত পড়েছে আমাদের বাসায়। হাত বাড়িয়ে নিচ তলার কলিংবেল নাগাল পাইনা। সিড়ির কোনায় সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে বাড়িওয়ালা চাচাকে ডাকতে থাকি অসহায়ের মত।

আগুন শব্দটা কানে পৌছাতে চাচা বিদ্যুৎ বেগে মেইন সুইচ বন্ধ করেন। ঘোর অন্ধকার সিড়িতে আমাদের এলোপাথাড়ি দৌড়। তিন তলায় ফিরে দেখি খালু আর তাশফিক প্রাণপণে তীব্র আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা তখনো করছেন।

খালু আর তাসফিকের জীবন বাজি রাখা চেষ্টা ও সময়মতো মুমিত চাচার মেইন সুইচ বন্ধ করাতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুনে নিশ্চিত পুড়ে মরা থেকে তিন বাচ্চা নিয়ে আমি, দুই বাচ্চা নিয়ে আমার ননদ, মা ও তিনজন কাজের মেয়ে বেঁচে যাই।

হয়তো বা এই বিধ্বংসী আগুন আমাদের ঘর ছাড়িয়ে পাশের ফ্লাট ও নিচের ফ্লাট গুলোতে ছড়িয়ে পড়তো। ঘুমন্ত জনা পঁচিশেক লাশের মিছিল পরের দিন দেশব্যাপী গন মাধ্যমের প্রধান নয়তো মধ্যেম শিরোনাম হত। কয়েক দিন হা হুতাশের পর এক সময় সবাই ভুলে যেত।

স্বল্প সময়ের আগুনের উত্তাপে ঘরের দেয়াল ও এলুমিনিয়ামের দরজা খানিকটা পুড়ে কালো হয়ে গেলেও জান মালের কোন বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। ভবনের ভেতরের রাবার মোড়ানো তারে আগুন লেগেছে অনেক আগেই। তাইতো ভবনে হালকা কাঁপুনি অনুভূত হয়েছিল। সবাই ঘুমে থাকায় টের পায়নি কিছু।

অক্ষত জীবন ফিরে পেয়ে মহান স্রষ্টার কাছে নিয়ত শুকরিয়া, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে ভুলি না আমরা। দুঃস্বপ্নের সেই রাতের স্মৃতি নামক মৃত্যুভয় এখনো তাড়া করে আমাদের । মনে হলে গায়ে কাঁটা দেয়। আল্লাহর অশেষ কৃপা যে সেই রাতে অসময়ে, অকারণে আমার ঘুম ভেঙেছিল। ঘুমন্ত অবস্থায় ভয়াল আগুনে সব

সবার আগে আমার তিন সন্তান ও ঘরের দুই সাহায্যকর্মি পুড়ে ছাই হত। আস্তে আস্তে আমারা সবাই ভয়াল আগুনের শিকারে পরিণত হতাম।

এই ঘটনার মাত্র কয়েক মাস পর নিমতলির আগুনে পুড়ে অঙ্গার হলো একশো চব্বিশটা তাজা প্রান। সেই অগ্নিকান্ড নিয়ে কিছুদিন পত্র পত্রিকা ও গন মাধ্যমে সরব ক্যাচাল চললেও এক সময় তা থেমে যায়। ক্যামিকেলের গোডাউন সরানো সহ নানা কার্যকরী উদ্যোগের কাগুজে প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবায়ন হয় নি কোনটা। তাইতো এত বছর পর চকবাজারে আবারও নির্মমভাবে প্রান হারাতে হল আশি জনের বেশি মানুষকে। পোড়া লাশের গন্ধে পুরনো ঢাকার বাতাস ভারী। স্বজন হারানোর আর্তনাদে প্রকম্পিত চারিধার, সারাদেশ শোকে মূহ্যমান। আর কত অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, আর কত স্বজন হারানোর বেদনা বহন করতে হবে আমাদের?

নিমতলি আর চকবাজারের আগুনের কাছে তো আমার বাসার আগুন কিছুই ছিল না। তারপরও মনে হয় কত ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। অনাকাঙ্ক্ষিত ও অসময়ের মৃত্যু আমাদের কারো কাম্য নয়। স্রষ্টার কৃপার পাশাপাশি আমাদেরও সচেতন হতে হবে। লোভ লালসা, ব্যক্তিস্বার্থ সবকিছুকে পায়ে ঠেলে সমষ্টিগত স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে।

তাইতো কাগুজে প্রতিশ্রুতি নয়, শোক প্রকাশ নয়, চাই সবার সচেতনতা ও সরকারের সার্বজনীন সহযোগিতা। এই মৃত্যুপুরীতে ভালোভাবে বেঁচে থাকার ন্যুনতম আকুতি।

বারংবার এই মৃত্যুর মিছিলে শরিক হতে চাইনা আমরা।

ফারজানা ইসলাম লিনু,গল্পকার ও শিক্ষক

Advertisement