আসামজুড়ে উত্তেজনা: বাংলাদেশ কতটা সতর্ক?

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: বাংলাদেশের পাশের জনপদ আসাম এ মুহূর্তে উত্তেজনায় উত্তাল। এ নিয়ে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কতটা সচেতনতা রয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু দম বন্ধ করে আসাম অপেক্ষা করছে এই দিনের জন্য। নতুন করে ২২ হাজার সৈনিক পাহারায় বসানো হয়েছে সেখানে। ভারতের কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীকেও সতর্কতায় রাখা হয়েছে।

কে আসামের নাগরিক, কে নয়, তারই ঘোষণা হবে আজ। স্থানীয়ভাবে একে বলা হচ্ছে ‘এন-আর-সি’। এনআরসি মানে ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেন’। আজ আসামের ৩ কোটি ২৯ লাখ অধিবাসীর এনআরসি প্রকাশ করা হবে। পুরো আসামবাসী তারপর থেকে বিভক্ত হয়ে পড়বে দুভাগে। যুগের পর যুগ সেখানে বসবাস করেও অনেকেই আজ থেকে ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন। ‘বিদেশি’দের সংখ্যাটা কত বড় হবে, সে নিয়ে চূড়ান্ত আঁচ-অনুমান চলছে। তবে সংখ্যাটা যতই হোক, ভারতের জমিনে যেকোনো ‘বিদেশি’ মানেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে অভিযুক্ত।

এনআরসি তৈরির প্রক্রিয়ায় আসামে নাগরিকত্বের মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়েছে ১৯৭১-এর ২৪ মার্চকে। খুবই উসকানিমূলকভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি তারিখকে (২৫ মার্চ, ১৯৭১) সেখানে স্থানীয় অধিবাসীদের নাগরিকত্বের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ভারতে আসাম ছাড়া আর কোনো রাজ্যে যে এনআরসি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, সেও লক্ষ করার মতো একটা বিষয়।

১৯৮৫ সালে কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই ইস্যুতে ভারত সরকারকে এক চুক্তি করতে বাধ্য করেছিল। জাতীয় কংগ্রেস এই ইস্যু নিয়ে প্রথম রাজনীতি শুরু করে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর কংগ্রেসের করা চুক্তিকে ব্যবহার করে আসামের নাগরিকদের মাঝে ‘বিদেশি’ চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া বেগবান হয়। দেশটির সুপ্রিম কোর্টও একে দ্রুততর করতে চাপ দেন। আদালতের আদেশ বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থানকে নৈতিক শক্তি জোগায়। দুটোর মাঝে কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সেটা কেবল আঁচ-অনুমানের বিষয়।

যাঁরা এনআরসি থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা করছেন, তাঁদের অনেকেই ঐতিহাসিকভাবে বাংলাভাষী। বাংলায় কথা বলেন বলেই ধর্মে হিন্দু ও মুসলমান। আসামের এই অধিবাসীদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দেওয়া সহজ হচ্ছে ভারতীয় প্রচারমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের প‌ক্ষে। অনেকটা মিয়ানমারের আরাকানের রোহিঙ্গাদের মতোই ঘটনা এটা। রোহিঙ্গারা লাখে লাখে বাংলাদেশ ঢুকে পড়ার আগে ওই বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকে কিছুই অবহিত করতে পারেনি—আসামের আসন্ন মানবিক বিপর্যয়েও বাংলাদেশের নিশ্চুপতা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।

স্থানীয়ভাবে ভয় বিরাজ করছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘বিদেশি’ চিহ্নিত করামাত্র অনেক অধিবাসী সেখানে আটক কিংবা আক্রান্ত হতে পারে। নাগরিকত্ব হারানো মানে কেবল ভোটাধিকার হারানোই নয়—সম্পদের মালিক হতে না পরার প্রশ্নও চলে আসে। এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে, এরূপ নাগরিকত্বহারা মানুষেরা কি তাঁদের এত দিনকার সম্পদ বিক্রি করতে পারবেন? তাঁদের পরিবারগুলোর সন্তানেরা যে যেখানে শিক্ষাজীবনে রয়েছে, তাদের পরিণতি কী হবে?

ইতিমধ্যে সেখানে উসকানিমূলকভাবে ৩০০ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালও খোলা হয়েছে ‘বিদেশি’দের বিষয়ে। এসব ট্রাইব্যুনাল প্রায় ২০ হাজার ব্যক্তিকে বিদেশি চিহ্নিত করার কাজ শেষ করেছে। আরও লাখ লাখ মোকদ্দমা সেখানে মীমাংসার জন্য ঝুলছে।

ছয়টি কারাগারে বিদেশিদের আটক রাখার জন্য যে ডিটেনশন সেন্টার রয়েছে, সেগুলো অবশ্য ইতিমধ্যে উপচে পড়ছে। কেন্দ্রীয় সরকার নতুন ডিটেনশন সেন্টার খোলার জন্য বড় আকারের বরাদ্দ দিয়েছে।

ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল বিজেপির অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল ‘আসাম থেকে বাংলাদেশিদের বের করে দেওয়া’। বিজেপি তখন এও ধারণা দিয়েছিল, কেবল ‘মুসলমান বিদেশি’দের তারা বের করতে চাইছে। কিন্তু চূড়ান্ত এনআরসি করার সময়ে দেখা যাচ্ছে প্রচুর বাংলাভাষী হিন্দুও নাগরিকত্ব হারাতে চলেছেন এবং উদ্যোগটি মূলত ‘বাংলাভাষী’বিরোধী রূপ নিয়েছে।

এদিকে আসামজুড়ে শঙ্কা, উদ্বেগ ও উত্তেজনার মুখে স্থানীয় সিনিয়র মন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা বলছেন, এটা একটা খসড়া প্রতিবেদন। আপাতত যারা ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত হবে, তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে না। তালিকা সংশোধনেরও সুযোগ থাকবে। অসন্তুষ্টরা তাদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন করতে পারবে। মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়ালও গত বৃহস্পতিবার একইরূপ আশ্বাস দিয়েছেন।

এসব আশ্বাস স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিগত দোদুল্যমানতা প্রকাশ করছে। লাখ লাখ মানুষকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সে বিষয়ে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার বা আসাম সরকার—কারওই কোনো প্রস্তুতি আছে কি? পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো অবশ্য তাদের পুলিশকে উচ্চ সতর্কতায় রেখেছে। সেখানেও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে নাগরিকত্বহারা আসামিদের ঢুকে পড়ার শঙ্কায়। কেবল বাংলাদেশেই এই বিষয়ে সুনসান নীরবতা দেখা যাচ্ছে; যদিও বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে হয়তো নতুন করে কয়েক লাখ রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক জড়ো হতে পারে।

Advertisement