ইতিহাস তো কেউ পড়তে চায় না!

আবদুল মান্নান ::

বাংলা একাডেমির একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ জোর দিয়ে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে বলেন, সবাইকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও বাংলা ভাষা সম্পর্কে জানতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বাংলার ছাত্রী ছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাস তার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। সুতরাং এই বিষয়গুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি বলবেন, অতীতে বলেছেন, আগামীতেও বলবেন, তাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা কিছুটা হলেও ভিন্ন। ধরা যাক, স্কুল পর্যায়ে এই দুটি বিষয় নিয়ে কী হচ্ছে, তার একটু হিসাব মেলানো যাক। সরকারি বা বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে এই বিষয়ে তেমন সমস্যা আছে বলে শোনা যায়নি। হয়তো কারিকুলাম নিয়ে সমস্যা আছে। বাংলা কারিকুলাম নিয়ে সমালোচনা বেশি শোনা যায়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের রচনা বা কবিতা বাদ দিয়ে অনেক নতুন রচনা বা কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা স্কুল পর্যায়ে না পড়লেও তেমন ক্ষতি নেই। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক-সাহিত্যিকদের রচনা বাদ দিয়ে পাঠ্যবই রচনা করা একটি বড় ধরনের অপরাধ। তীব্র সমালোচনার মুখে ইতিমধ্যে তার কিছু কিছু সংশোধন হয়েছে বলে জেনেছি। ইতিহাসের ক্ষেত্রেও অনেকটা সে রকম। সাধারণত স্কুল পর্যায়ের ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে একটি ধারাবাহিকতা থাকে। হোক না সেটা বাংলাদেশের ইতিহাস। শুরু হোক দেশভাগ থেকে। শেষ হোক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী দেশ গঠন, সংবিধান প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। বর্তমানে তৃতীয় শ্রেণি থেকে একটু-আধটু ইতিহাস পড়ানো হয়। তাতে মুক্তিযুদ্ধের কিছু উল্লেখ থাকে। ওপরের দিকে আসলে পাঠ্যসূচিতে কিছু উৎকর্ষ আনা হয়। উল্লেখ্য, স্কুলের প্রাথমিক পর্যায়ে ইতিহাসগুলো খুবই সাদামাটাভাবে রচিত হয়েছে; যার ফলে শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ের প্রতি চরম অনীহা কাজ করে। এ পর্যায়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দু’একটি ঘটনা যদি তুলে ধরা হতো, তা হলে পড়ূয়ারা তাতে আগ্রহী হবে। তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, নবম ও দশম শ্রেণিতে শুধু কলা ও মানবিকবিদ্যা নিয়ে যারা পড়ে, তাদের বিশদ আকারে ইতিহাস পড়তে হয়, অন্যদের নয়। এটি মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটি পাকিস্তানি মডেলের কাছাকাছি। পাকিস্তান সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ. যেখানে স্কুলে ইতিহাস পড়ানো হয় না। পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম ইতিহাসবিমুখ বলে সে দেশের সার্বিক অবস্থা এত নাজুক। বাংলাদেশের সরকারি স্কুলগুলোতে বাংলার অবস্থান বলেছি। সমস্যা হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে। এই স্কুলগুলোতে (কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে) বাংলা বা নিজ দেশের ইতিহাস কোনোটাই পড়ানো হয় না। এই স্কুলগুলোতে একজন বাচ্চাকে পড়াতে হলে গড়ে মাসে লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এদের আবার বাহারি সব নাম আছে। আমি শত বা পঞ্চাশ বছরের পুরনো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর কথা বলছি না। বলছি গত তিন দশকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর কথা। এখানে পাঠ্যসূচির প্রথম পাঠ হচ্ছে- কথাবার্তায়, চালচলনে, আচার-আচরণে কীভাবে স্মার্ট হওয়া যায়, তা শেখা। সেই স্মার্ট হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে, স্কুল বা এমনকি বাড়িতেও বাংলা বলা যাবে না। ভর্তির আগে বাবা-মাকে ইন্টারভিউ দিতে হয়। তাদের বলা হয়, বাড়িতে বাচ্চাদের সঙ্গে সবসময় ইংরেজি বলতে হবে। এসব স্কুলের বাচ্চারা ‘মাম্মি’, ‘ড্যাডি’ বলতে যতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, ‘বাবা’, ‘মা’ বলতে ততটা বিরক্ত। কোনো কোনো বাড়িতে বড়জোর ‘আব্বা’, ‘আম্মা’ বলতে শোনা যায়। আর আজকের বাচ্চারা তো ‘আন্টি’, ‘আঙ্কেল’ বলতে পাগল। এসব স্কুলে বাংলাদেশের ইতিহাস তো একেবারেই প্রবেশ নিষেধ। এই স্কুলগুলো যারা পরিচালনা করেন, তারা ভ্রান্তভাবে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজকে’ ইতিহাস মনে করেন। একবার এই জাতের স্কুল ইংরেজি মিডিয়ামের একজন প্রিন্সিপালের (হেডমাস্টার বা হেড মিস্ট্রেস নন) কাছে জানতে চাইলাম, তাদের স্কুলে বাংলা বা ইতিহাস কেন পড়ানো হয় না। সোজা উত্তর- ‘আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীরা তো ‘ও’ বা ‘এ’ লেভেল পাস করে দেশে থাকবে না। এসব বিষয় পড়ে কী হবে। আমি তো লা-জবাব। বাংলাদেশের ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাব্যবস্থায় একটি চরম নৈরাজ্য চলছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বাংলা মিডিয়ামও যে একেবারে ভালো চলছে, তা নয়। সরকারের নতুন শিক্ষামন্ত্রীর এসব বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া না হওয়ার ওপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সফলতা-ব্যর্থতা নির্ভর করে না। সার্বিকভাবে নির্ভর করে আমাদের নতুন প্রজন্ম কী শিখছে, কেমন করে শিখছে, কারা শেখাচ্ছেন, কী পরিবেশে শিখছে, তার ওপর। নতুন শিক্ষামন্ত্রী আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। তার একটা বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন আছে। তার নিজের অভিজ্ঞতাটা যদি তিনি কাজে লাগান, অনেক কিছুরই পরিবর্তন হতে পারে। তার একটা বাড়তি সুবিধা আছে। তার উপমন্ত্রী বেশ উদ্যমী। জন্ম থেকেই তাকে চিনি। দু’জনে মিলে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষাক্ষেত্রে একটি মিনি বিপ্লব আনতে পারেন। স্কুল শিক্ষাটাই হচ্ছে ওপরের শিক্ষার বুনিয়াদ। সেটা ঠিক না হলে ওপরে ঠিক করা কঠিন।

বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ পর্যায়ে বাংলাদেশের ইতিহাস, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়কে তেমন কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কলেজে কলা ও মানবিক বিদ্যায় স্নাতক পর্যায়ে বাংলা পড়ানো হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যের সময়কালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ফুল কমিশন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে দুটি বিষয় আবশ্যিক বিষয় হিসেবে পড়তে হবে। প্রথমটি ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’। কোর্স দুটি মাইনর হিসেবে পড়তে হবে। এ বিষয় দুটি পড়ানোর জন্য দুটি পাঠ্যবইও মঞ্জুরি কমিশনের উদ্যোগে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথমটি গ্রন্থনা করেছেন জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর দে, ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থটি রচনা করেছেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ একুশে পদকপ্রাপ্ত ড. মুনতাসীর মামুন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মাহবুবুর রহমান। কোর্স দুটির জন্য সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নোটিশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নানাবিধ কারণে তা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া এই কোর্স দুটি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেনি। একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্ন তুলেছে, প্রকৌশলীদের বাংলা ও ইতিহাস পড়ে কী হবে? কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস কোর্সটি পড়ানো শুরু করলেও বিষয়টি ইতিহাসের শিক্ষক দিয়ে না পড়িয়ে অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে পড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষকদেরও এই বিষয়টি পড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন টক শো পণ্ডিত শিক্ষক মন্তব্য করেছেন, ইতিহাস বিষয়টি পড়ানোর জন্য ইতিহাসের শিক্ষক লাগবে কেন? উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষকও তো ইতিহাস পড়াতে পারেন! সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে ২০১৬ পর্যন্ত কখনও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো না বা জাতীয় দিবস পালন করা হয়নি। মঞ্জুরি কমিশনের অনড় অবস্থানের কারণে সেখানে পরিস্থিতি পাল্টেছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রথমবারের মতো অফিস কক্ষে বঙ্গবন্ধুর ছবি উঠল, সেদিন নাকি চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। কয়েকজন বিভাগীয় প্রধান বঙ্গবন্ধুর ছবি অফিস কক্ষে আছে বলে সেখানে অফিস করেন না। এমন অবস্থায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হবে বা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পড়ানো হবে, তা এখনও অচিন্তনীয়।

জাপানে স্কুলের বাচ্চাদের নিজ দেশ সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া ছাড়া প্রাইমারিতে আর কোনো বিষয় পড়ানো হয় না। সে জন্য জাপানিদের দেশপ্রেম নিয়ে কখনও কেউ প্রশ্ন তোলে না আর এই দেশপ্রেমের কারণেই দেশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে দুই দশকের মধ্যেই উন্নত দেশের কাতারে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি পরতে পরতে অসঙ্গতি আর বিশৃঙ্খলা। এসব নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই চারদিক থেকে হাজার রকমের বাধা। বাবার মতো শেখ হাসিনা দেশকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। বলেন, লাখো শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে সোনার মানুষ চাই। কিন্তু সোনার মানুষ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাই তো সিস্টেম বা বিদ্যমান ব্যবস্থা নষ্ট করে দিচ্ছে। সবার আগে তো সেই সিস্টেমকে মেরামত করতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে এই সিস্টেম শিকড়বিহীন পরগাছা বা উদ্বাস্তু তৈরি করবে। খাঁটি দেশপ্রেমিক নয় আর প্রধানমন্ত্রী সুযোগ পেলেই তার প্রত্যাশার কথা বলবেন; কিন্তু পরিস্থিতির হেরফের হবে না। এই সিস্টেমে আর একজন বঙ্গবন্ধু বাদ দিলাম, একজন শেখ হাসিনার জন্ম দেওয়াও সম্ভব নয়।

চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

Advertisement