ইলিশ কূটনীতি বনাম তিস্তা রাজনীতি

।। হাসান শাহরিয়ার।।

গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শুরুতে বাংলাদেশ যখন মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে বদ্ধপরিকর, তখন প্রথম শুনলাম আমেরিকা ও চীনের মধ্যে শুরু হয়েছে ‘পিংপং ডিপ্লোমেসি’। অর্থাৎ টেবিল টেনিস খেলা দিয়ে তাদের কূটনীতির সূত্রপাত। এর আগে ওয়াশিংটন আর ইসলামাবাদের কূটনৈতিক বেইমানির কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে চীন সফর করলেন। এই তিন দেশই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও জনগণের আশা-অভিলাষের বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তানের মিডিয়াকে বলা হলো, ‘কিসিঞ্জার অ্যাবোটাবাদে বিশ্রাম নিচ্ছেন।’ এর পর অবশ্য নিক্সন চীন সফর করেন। এই ঘটনার ২৫ বছর পর শুনলাম ‘ইলিশ কূটনীতি’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ঘটা করে পদ্মার বাঘা বাঘা ইলিশ বেছে উপহার দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর করকমলে। আহদ্মাদে আটখানা হয়ে উঠলেন স্পষ্টভাষী, নিরহঙ্কার ও বঙ্গের হিতৈষী জ্যোতি বসু। বিনা বাধায় বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গা চুক্তি সম্পাদিত হলো।

এখন পদ্মার ইলিশ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার জনগণকে খুশি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইলিশ রফতানি নিষিদ্ধ। তবু আইন পরিবর্তন করে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে একটি অংশ এরই মধ্যে কলকাতা পৌঁছে গেছে। পাঁচশ’ টন ইলিশের অবশিষ্টাংশ যাবে আগামী সপ্তাহে দুর্গাপূজার সময়। দিদিখ্যাত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন জোগানোর একমাত্র কারণ তিস্তা নদী। তিনি গোঁ ধরেছেন- বাংলাদেশের মানুষ মরে গেলেও তিস্তার পানির এক ফোঁটাও দেবেন না। আর বাংলাদেশ পণ করেছে- ছলে-বলে-কৌশলে হলেও তিস্তার ভাগ আদায় করে নেবে।

তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের চিলমারীতে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে পড়েছে। হাসিনা ও মনমোহন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল- তিস্তার ৪৫০ কিউসেক পানি প্রবহমান রেখে অবশিষ্ট ৪৮ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৫২ শতাংশ ভারত। প্রথমে ১৫ বছরমেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি হবে। পরে পানিপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে। মমতা বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের লোকেরা চাষাবাদের জন্য তিস্তার ওপর নির্ভরশীল। তার ধারণা, পানির হিসাবে ৩৫ হাজার কিউসেক যদি বাংলাদেশ পায়, তাহলে উত্তরবঙ্গের সেচ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে; বিপন্ন হবে কৃষি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে তার আসল রূপটি বেরিয়ে আসে। ‘আপনারা কি চান আমি একবার এসেই সব সমস্যার সমাধান করে চলে যাই?’ তাদের পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘তিস্তা নিয়েও তো ইতিবাচক পরিবেশের কথা শুরু হলো। আপনাদের জল চাই, সেটা আমি বুঝি। তিস্তার জল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও কিছু সমস্যা রয়েছে। শুস্ক মৌসুমে উত্তরবঙ্গে জলই থাকে না। আর জলই যদি না থাকে, তাহলে সেটা দেওয়া যাবে কীভাবে?’ মমতা নিশ্চয়ই জানেন, তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত না হওয়ার কারণে শুস্ক মৌসুমে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে। ফলে তখন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়।

আসলে বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। স্থানীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণেই তিনি চুক্তিতে বাদ সাধছেন। বাংলাদেশকে এই পরিমাণ পানি দিলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষির ক্ষতি হবে না- তা তিনি ভালো করেই জানেন। তিনি যে কমিশন গঠন করেছিলেন, তা এসব দিক পর্যালোচনা না করে বিবেচনায় নিয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণ।

আট বছর আগে মহাকরণে যাওয়ার পর ক্ষমতার ভারে বদলে গেলেন মমতা দেবী। তাকে ঘোড়ারোগে পেয়ে বসল। অচিরেই তিনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন এবং সমালোচকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য জেলে পাঠাতে শুরু করলেন। যে গণমাধ্যম তাকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিল, সেই গণমাধ্যমই হয়ে উঠল তার চক্ষুশূল। তখন কেউ কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন :বিনা কারণে ধৈর্যচ্যুতি তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। পশ্চিমবঙ্গ এখন আর সেই অর্থে তাঁর কবজায় নেই। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এমন শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে যে, প্রতিদিনই মমতার তৃণমূলের বড় বড় নেতা অমিত শাহ কিংবা বিজেপির অন্য কারও পা ছুঁয়ে দলবদল করছেন। মমতা উল্টোরথে উঠেছিলেন, এখন নতুন করে হিসাব-নিকাশ করে সোজা পথে হাঁটার চেষ্টা করছেন, তবে সময় অনেক পার হয়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে সখ্য দীর্ঘদিনের। আট বছর আগে মমতার দল যখন নির্বাচনে জয়লাভ করে, তখন সব প্রটোকল ভেঙে হাসিনা তাঁকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তবে মমতা তার মূল্যায়ন করেননি; বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনার উদারতার কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি। কয়েক বছর আগে মমতা ঢাকা এলে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। প্রটোকল ভেঙে শহীদ মিনারে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন এবং বাড়িতে নিজে এসে গাড়িতে তুলে দেন। তাঁর সফরের আগে বলা হয়েছিল, তিনি চমক দেখাবেন। কংগ্রেস সরকারের দুর্বলতার কারণে যে তিস্তার পানি চুক্তি তিনি ইতিপূর্বে বিনা কারণে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন- সে প্রশ্নে তাঁর কোনো স্পষ্ট জবাব ছিল না। ঢাকায় আসার পর বলেছিলেন, আস্থা রাখুন; শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সমাধান মিলে যাবে। পরদিন প্রতিশ্রুত কোনো চমক না দেখিয়ে বিষয়টি ‘ভেবে দেখব’ বলে মৌখিক আশ্বাস দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি বলেছেন, তড়িঘড়ি করে এ সমস্যার সমাধান তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ কিছু ‘বাধ্যবাধকতা’ রয়েছে। তবে এ প্রশ্নে তিনি কোনো সমাধানের ইঙ্গিত না দেওয়ায় বাংলাদেশিরা মর্মাহত হয়েছিলেন। তবে তিস্তা প্রশ্নে তিনি যা-ই বলুন না কেন, বাংলাদেশিরা যে অতিথিপরায়ণ- শেখ হাসিনা তা আবার প্রমাণ করেন। মমতা ও তাঁর সফরসঙ্গীদের খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টি ছিল যেন এক এলাহি কাণ্ড। তালিকায় ছিল কালিজিরা চালের ভাত, সবজি, ডাল, ভাপা ইলিশ, ইলিশ ভাজা, শর্ষে ইলিশ, ইলিশের ডিম ভাজি, ইলিশের তেল, চিতলের মুইঠ্যা, রূপচাঁদা ভাজা, রুই কালিয়া, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, খাসির রেজালা, মুরগি ভুনা এবং কুমিল্লার রসমালাই ও মিষ্টি দই। এই খাওয়া খেয়ে তাঁর সফরসঙ্গীদের অনেকেই ঢেঁকুর তুলে বলেছিলেন, ইলিশের এত পদ জীবনেও কোনোদিন খাইনি। ঘি যেমন সবার পেটে সয় না, তেমনি কারও কারও নাকি পেট-কামড়ানি হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ৩ অক্টোবর দিল্লি সফরে গেছেন। তিনি ‘ইন্ডিয়া ইকোনমিক ফোরামে’ যোগ দেওয়ার পর ৫ তরিখে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসবেন প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে। আলোচনার বিষয়ের শেষ নেই। স্বাভাবিকভাবেই তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়টি শীর্ষে থাকবে। কিন্তু লাভ হবে না কিছুই। কারণ সাম্প্রতিক সফরে মমতা ও মোদি এ প্রশ্নে কোনো কথাই বলেননি। আর পূজার সময় মমতা দেবী কলকাতার বাইরে যান না। তিস্তার অবস্থা এখন ত্রিশঙ্কু। তবু বরাবরের মতো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তিস্তার বিষয়টি তিনি ভেবে দেখবেন। কিন্তু তাঁর এই ভাবা কবে শেষ হবে, তা শুধু তিনিই বলতে পারেন। এখন এটি স্পষ্ট, তিস্তার পানি ভাগাভাগির সমাধান শিগগিরই হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ও ভারত ইতিমধ্যে নিরাপত্তা, বাণিজ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, যোগাযোগ, উন্নয়ন সহায়তা, পরিবেশ, শিক্ষা. অবকাঠামো উন্নয়ন, সংস্কৃতি ও স্বাস্থ্য খাতে চুক্তি করেছে। তালিকায় অন্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ব্লু ইকোনমি, পারমাণবিক অস্ত্রের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, আকাশসীমার গবেষণা, সাইবার নিরাপত্তা। শেখ হাসিনার এবারের সফরে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে এবং রোহিঙ্গা ও নাগরিকপঞ্জি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে না হলেও মতবিনিময় হবে। তবে ভারতের ঋণের বিষয়টি আদৌ আলোচিত হবে কি-না, সেই সন্দেহ অনেকের মনেই রয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে ৭৮৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সামান্য কিছু অনুদানও রয়েছে। মাত্র ১০ শতাংশ দিয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে অবশিষ্ট টাকা ছাড় দিচ্ছে না।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একজন ঝানু রাজনীতিবিদ। বিজেপি সভাপতি এবং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে সঙ্গে নিয়ে গত নির্বাচনে তিনি মমতাকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছেন। এতে বোধ করি কিছুটা হলেও শিক্ষা হয়েছে তাঁর। গত মাসে নিজ উদ্যোগে মোদির সঙ্গে দেখা করতে যান দিল্লিতে। পশ্চিমবঙ্গে একটি কয়লা খনি উদ্বোধনের নিমন্ত্রণও করে আসেন। তিস্তার পানি বণ্টন প্রশ্নে দিল্লি আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে। বাদ সাধছেন মমতা দেবী। দুর্গাপূজা উপলক্ষে শেখ হাসিনার ইলিশ উপহার মমতার কাছে অনেকটা ছাইভাতের মতো। তবে খুব বেশিদিন বাকি নেই। এই ছাইভাতই তাঁকে গোগ্রাসে গিলতে হবে।

প্রবীণ সাংবাদিক, ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিজেএ) এবং জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি

Advertisement