ইস্ট লন্ডন মসজিদে সেমিনার : শান্তিপুর্ণ সমাজ বিনির্মাণে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা অপরিহার্য

ইস্ট লন্ডন মসজিদের উদ্যোগে ফেইথ ইন নেইবার বা ‘প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক’ শীর্ষক আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, শান্তিপুর্ণ সমাজ বিনির্মাণে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে পরস্পর পরস্পরের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা অপরিহার্য। বিশেষকরে মুসলিম সমাজে প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে ইসলামধর্মে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাঁরা মহানবী (সাঃ) এর একটি বাণীর উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, যাঁর মুখ ও হাত থেকে তাঁর প্রতিবেশী নিরাপদ নয়, সে কখনো প্রকৃত মুসলিম হতে পারবে না। সেমিনারে তথ্য প্রকাশ করে বলা হয়, ৬ কোটি নাগরিকের ব্রিটেনে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ একাকিত্বে ভূগে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার মানুষ নেই। এই ডিসেম্বরের শেষ দিকে খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিনেও লাখ লাখ মানুষ নির্জন ঘরে একাকী দিন কাটাবেন। তাই মুসলমানদের কর্তব্য ধর্মবর্ণ নির্বেশেষে প্রত্যেক প্রতেবেশীর প্রতি যত্নশীল হওয়া। আর বিশেষ করে এই খ্রিষ্টমাসে।

৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিকেলে লন্ডন মুসলিম সেন্টারের প্রথমতলায় দুই শতাধিক মুসলিম নন-মুসলিমের অংশগ্রহণে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ইস্ট লন্ডন মসজিদের ডাইরেক্টর দেলওয়ার খানের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠিত সেমিনার বক্তব্য রাখেন হাউজ অব লর্ডসের সদস্য লর্ড নাজির আহমদ, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র জন বিগস, মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের সেক্রেটারি জেনারেল হারুন খান, ইস্ট লন্ডন মসজিদ এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টারের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইমাম ও খতীব শায়খ আব্দুল কাইয়ূম, টাওয়ার হ্যামলেটস পুলিশের সাবেক ডেপুটি বারা কমাণ্ডার ডাল বাবু, ব্রাডফোর্ড কাউন্সিল অব মস্কের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব লাহের, লন্ডন সিটিজেন্স নেতা ফিল ওয়ারবাটন, জৌসেফ ইন্টারফেইথ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মেহরী নেকনাম ও সেমিনারের মূল স্পনসর মোহাম্মদ আরিফ জাবাদানী। শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে অনুবাদসহ তেলাওয়াত করেন ইয়াকিন রাহমান। এতে ইস্ট লন্ডন মসজিদ ইভনিং মাদ্রাসার ছাত্ররা নাশিদ পরিবেশন করে।

বক্তারা আরো বলেন, একজন খারাফ প্রতিবেশী শুধু আরেক প্রতিবেশীর জন্যই সমস্যা নয়, গোটা সোসাইটির জন্যই সমস্যা। প্রতিবেশী বলতে আমরা বুঝি পাশ্ববর্তী ঘরে যিনি বসবাস করেন। কিন্তু প্রতিবেশীর অর্থ অনেক ব্যাপক। কাজের জায়গায় সহকর্মীও একজন প্রতিবেশী। তাই সর্বক্ষেত্রেই আমাদেরকে একজন ভালো প্রতিবেশী হতে হবে। একজন ভালো মানুষ হতে হবে। আর ভালো মানুষ হতে পারলেই সমাজে শান্তি আসবে।

লর্ড নাজির আহমদ বলেন, যাঁরা ধর্মে বিশ্বাসী তাঁরা যেমন আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট তেমনি যাঁরা ধর্মে বিশ্বাসী নয় তাঁরাও একই আল্লাহর সৃষ্ট। তাই প্রবিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার রাখার ক্ষেত্রে আস্তিক-নাস্তিক কোনো তারতম্য থাকা উচিত নয়। প্রত্যেকের প্রতিই সমান মনোভাব ও ভালোবাসা রাখতে হবে। মেয়র জন বিগস বলেন, শান্তিপুর্ণ আবাসস্থল হিসেবে টাওয়ার হ্যামলেটস লন্ডনের অন্যতম একটি বারা। নানা কারণে এই বারায় বসবাস করতে মানুষ অধিক পছন্দ করেন। এর একটি কারণ হচ্ছে- লন্ডন সিটির সঙ্গে টাওয়ার হ্যামলেটসের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত: বহুসাংস্কৃতিক, বহুজাতিক ও বহুধার্মিক মানুষের সমন্বয়ে এটি একটি বৈচিত্রপুর্ণ বারা। এখানকার মানুষের মধ্যে পারস্পারিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ খুবই গভীর।

ইমাম শায়খ আব্দুল কাইয়ূম বলেন, আমাদের প্রত্যেককে ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। একজন পিতা হিসেবে, একজন স্বামী হিসেবে পরিবারের কাছে ভালো মানুষ হতে হবে। আর ভালো মানুষ হতে পারলে ভালো প্রতিবেশীও হওয়া যাবে। তিনি বিভিন্ন হাদীসের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, একজন ব্যক্তি তখনই ভালো মুসলিম হতে পারে যখন তার মুখ ও হাত থেকে তাঁর প্রতিবেশী নিরাপদ থাকতে পারে। তিনি বলবেন, মুসলিম এমন ব্যক্তি যাঁর অনিষ্ট থেকে একটি গাছের পাতাও অনিরাপদ থাকবেনা। অপ্রয়োজনে একটি গাছের পাতাও একজন মুসলিম নষ্ট করবে না।

ইস্ট লন্ডন মসজিদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, লন্ডন ব্যস্ত নগরী। এই নগরের মানুষও খুবই ব্যস্ত। কেউ কারো খোঁজ নেয়ার সময় নেই। অনেকের কাছেই তাঁর প্রতিবেশী অপরিচিত আগুন্তক মানুষের মতো মনে হয়। অথচ রাসুল (সাঃ) বলেছেন, তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত একজন ভালো মুসলিম হতে পারবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার প্রতিবেশী তোমার কাছে অনিরাপদ থাকবে। তুমি তোমার জন্য যা ভালো মনে করবে তোমার প্রতিবেশীর জন্যও তা কামনা করবে। তোমার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকলো আর তুমি উদরপুর্তি করে খেয়ে ঘুমালে। তাহলে তুমি প্রকৃত মুসলিম নও।

ব্রাডফোর্ড কাউন্সিল অব মস্কের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব লাহের বলেন, অবহেলা মানুষের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষের জন্ম দেয়। তাই মানুষকে অবহেলা করা থেকে বাঁচতে হবে। তাছাড়া মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও অনুগ্রহ প্রদর্শনে আমরা কার্পন্য করে থাকি। এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে উদার হতে হবে।

সেমিনারের মূল স্পনসর মুহাম্মদ আরিফ জাবাদানী বলেন, আল্লাহ তায়ালা যাঁদের সম্পদ দিয়েছেন পরকালে তাঁদের কাছ থেকে প্রতি পেন্সের হিসাব নেবেন। জানতে চাইবেন কীভাবে আমরা আমাদের সম্পদ ব্যয় করেছি। তিনি তাঁর শেষ বয়সে ভালো কাজে নিজের সম্পদ উৎসর্গ করার চেষ্টা করছেন। ‘ফেইথ ইন নেইবার’ বা প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক শীর্ষক সেমিনার আয়োজনও তাঁরই একটি অংশ। তিনি জানান, সম্প্রতি প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক বিষয়ক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন যা ব্রিটেনের বিভিন্ন মসজিদ, ইসলামিক সেন্টার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যাচ্ছে।

Advertisement