উন্নতির আকাঙ্ক্ষা ও শিক্ষার জিদ

প্রতীক বর্ধন :: যে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, রাজনৈতিক হানাহানি, পারস্পরিক অবিশ্বাস—সেই দেশ এত উন্নতি করছে কীভাবে, তা বুঝতে বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের গলদঘর্ম হওয়ার জোগাড়। সে জন্য বাংলাদেশের উন্নয়নকে তারা প্যারাডক্সিক্যাল বা আপাতস্ববিরোধী ব্যাপার হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। দেশের প্রাণটি দেখতে পান না বলে তাদের কাছে ব্যাপারটা স্ববিরোধী মনে হয়। সেটা হলো মানুষের উন্নতির আকাঙ্ক্ষা।

এ বছর ৩০ আগেই দেশের সব মানুষের তিনবেলা ভাত জুটত না। গত শতকের ষাটের দশকে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রই আধপেটা খেয়ে পড়াশোনা করতেন। কিন্তু বজ্রকঠিন সংকল্প নিয়ে তাঁরা পড়াশোনা করেছেন। পরবর্তীকালে তাঁদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্র তাঁদের অবহেলা করলেও কোন কাজটিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, সেটি তাঁরা ঠিকই বোঝেন।

গত সপ্তাহে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর বাজেটের প্রভাব নিয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, উন্নয়ন সমন্বয় ও আইসোশ্যালের একটি যৌথ জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে পেশাগত কারণেই যাওয়ার সুযোগ হয়। সমীক্ষার প্রতিবেদনে দেখা যায়, যে ৪ হাজার ৮০০ মানুষের মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়েছিল, তাদের ৬৪ ভাগের কাছে শিক্ষাই প্রধান অগ্রাধিকার। অথচ এই শিক্ষা খাতে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ সংখ্যাগত হিসাবে বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে অনেক বছর ধরে একই জায়গায় রয়েছে। কিন্তু মানুষ বুঝে গেছে, শ্রেণিগত উন্নতির জন্য শিক্ষাই প্রধান হাতিয়ার। সে জন্য মানুষ শতকষ্ট সহ্য করেও সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের বিদ্যালয়ে আনার জন্য সরকার যেসব কর্মসূচি চালাচ্ছে, তার বড় প্রভাব আছে।

জেলা শহরগুলোতে কোচিং সেন্টার ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলের হিড়িক দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, টাঙ্গাইল জেলা সদরে কয়েকটি কোচিং সেন্টার ও তাদের একাডেমিক স্কুলের কারণে শহরের হালচালই বদলে গেছে। উপজেলা সদর ও গ্রাম থেকে অনেক পরিবারই সন্তানের পড়াশোনার জন্য জেলা সদরে এসে থাকছেন। কয়েক বছরের মধ্যে শহরের সব পুরোনো বাড়ি ভেঙে বা তার সামনে নতুন ভবন বানানো হয়েছে। তাঁরা সেসব বাড়িতে থাকছেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য প্রাণপাত করছেন। শহরের অনেক গৃহকর্মী কিশোরী গ্রামের স্কুলের খাতায় নামটা রেখে দেয়। বছর শেষে পরীক্ষা দিতে যায় তারা। শহরে যাঁরা নিম্ন বেতনের চাকরি করছেন, তাঁরাও বাড়িতে (গ্রামে) ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছেন, যদিও তা জিপিএ–৫ প্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই। কিন্তু তাঁদের এই চেতনা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়বাড়ন্ত দেখলেও ব্যাপারটা আঁচ করা যায়। এত এত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শুধু সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরাই পড়ছেন তা নয়, অনেক কৃষকের ছেলেমেয়েরাও এখন সেখানে পড়ছেন। বলা বাহুল্য, অনেক কষ্ট করেই তাঁরা পড়াশোনা করেন। সে জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ করা হলে তাঁরা ফুঁসে ওঠেন। সরকারও শেষ পর্যন্ত তাঁদের দাবি মানতে বাধ্য হয়।

এমনকি দরিদ্র মানুষের মধ্যে যাঁরা সন্তানদের মূল ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারছেন না, তাঁরা সন্তানদের মাদ্রাসায় দিচ্ছেন। সেখানে অন্তত তাদের খাওয়াপরার চিন্তা করতে হচ্ছে না। এ অবস্থায় শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

তবে সরকারের কিছু নীতির সুফলও মানুষ পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসের সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে যে ১ কোটি ৪ লাখ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করছে, তাদের মধ্যে ৫৬ লাখই মেয়ে। যে দেশে একসময় নারীশিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হতো, সেই দেশে এমন তথ্য সত্যিই চমকপ্রদ। মূলত সরকার ও দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত দুটি প্রকল্প এ দেশে এই নীরব পরিবর্তন এনেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম বিএনপি সরকার উপবৃত্তি চালু করে। এতে যেমন মানুষ মেয়েশিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রণোদনা পেয়েছে, তেমনি সরকারি-বেসরকারি নানা প্রচারণায় মানুষের মধ্যে সচেতনতাও সৃষ্টি হয়েছে।

রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রসঙ্গ ঠিক এখানেই চলে আসে। কারণ, ১৯৯১ সালের প্রথম বিএনপি সরকার উপবৃত্তি চালু করার পর প্রতিটি সরকারই তা চালিয়ে গেছে। উপবৃত্তি প্রথমে শুধু মেয়েদের দেওয়া হতো, পরে তাতে ছেলেদেরও যুক্ত করা হয়। অথচ বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, এক সরকার ক্ষমতায় আসার পর আগের সরকারের অনেক প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে। দুই প্রধান দলে শীর্ষ নেতা নারী হওয়ায় নারীশিক্ষার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। সে জন্যই এই সফলতা।

যা হোক, অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বললেন, মানুষের অগ্রাধিকার ঠিকই আছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, সরকারের অগ্রাধিকার ঠিক নেই। সরকার যে এত এত বড় অবকাঠামো বানাচ্ছে, তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও গুণগত শিক্ষা দরকার। এই বরাদ্দ দিয়ে তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দারিদ্র্য বিমোচনে বা শিক্ষার হার বাড়ানোয় যেমন ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি এখন গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায়ও সেই গুণগত শিক্ষায় জোর দেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা যেন চোখ বুজে আছি।

Advertisement